বুধবার, ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

ক্যাম্পাস সংকটের সমাধান কীভাবে

হল ছাড়েনি সাধারণ ছাত্ররা, মার্চের শুরুতে খুলে দেওয়ার দাবি ভিপি নূরের, নতুন করে সব পরীক্ষা স্থগিত

নিজস্ব প্রতিবেদক

ক্যাম্পাস সংকটের সমাধান কীভাবে

হল খুলে দেওয়ার দাবিতে গতকাল কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ -বাংলাদেশ প্রতিদিন

বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু ও আবাসিক হল খুলে দেওয়ার দাবি থেকে সরে আসেনি সাধারণ শিক্ষার্থীরা। গতকালও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এ দাবিতে বিক্ষোভ ও সংবাদ সম্মেলন করেছে ছাত্র-ছাত্রীরা। বিক্ষোভের মাঝেই ১৩ মার্চ স্নাতক শেষ বর্ষ ও স্নাতকোত্তর পরীক্ষার্থীদের হলে ওঠানোর সিদ্ধান্ত বাতিল করে আগামী ১৭ মে থেকেই হল খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তালা ভেঙে হলে প্রবেশ করা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থী এখনো হল ছাড়েনি। আগামী ১ মার্চের মধ্যে হল ও ক্যাম্পাস খুলে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। গতকাল এক বিক্ষোভ সমাবেশে ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নূর শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির গত সোমবারের ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে অথবা মার্চের শুরুতেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আবাসিক হল খুলে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। অন্যদিকে, শিক্ষামন্ত্রীর ঘোষণা পেয়ে সব বিশ্ববিদ্যালয় তাদের সব ধরনের পরীক্ষা স্থগিত করেছে। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের প্রশ্ন, করোনা মহামারীর এগারো মাসের বেশি ছুটির পর খুলে দেওয়ার দাবি নিয়ে তৈরি হওয়া সংকটের সমাধান হবে কোনপথে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক জানান, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত বহাল রাখতে নিজেদের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) প্রশাসন। আগামী ১৩ মার্চ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক শেষ বর্ষ ও স্নাতকোত্তর পরীক্ষার্থীদের হলে ওঠানোর সিদ্ধান্ত বাতিল করে আগামী ১৭ মে থেকেই হল খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা। এই সময়ের মধ্যে চূড়ান্ত কোনো পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে না। গতকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলের জরুরি সভায় এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, ১৩ মার্চকে সামনে রেখে শিক্ষার্থীদের হলে ওঠাতে আয়োজন ছিল, কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমরা ১৭ মে থেকে শিক্ষার্থীদের হলে ওঠানোর উদ্যোগ নিয়েছি। তাই যেসব পরীক্ষার রুটিন ঘোষণা করা হয়েছে সেগুলোও স্থগিত করা হলো। তিনি বলেন, সব শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ভ্যাক্সিনের আওতায় আনা হবে। এখন হল খোলার জন্য টিকা নেওয়া পূর্বশর্ত। ভর্তিপরীক্ষা নিয়ে উপাচার্য বলেন, এটা বিশ্ববিদ্যালয় খোলা ও হল খোলার তারিখগুলোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। পাশাপাশি ঢাবি অধিভুক্ত সাত কলেজেও আগামী ১৭ মে পর্যন্ত সব পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে। গত সন্ধ্যায় সাত কলেজের সমন্বয়কারী অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামালের নেতৃত্বে এক বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

এদিকে, মার্চের শুরু থেকে হল খোলার দাবিতে গতকাল উপাচার্যকে স্মারকলিপি দেয় শিক্ষার্থীদের একটি অংশ। আন্দোলনকারীদের মুখপাত্র জুনাইদ হুসেইন খান বলেন, আমাদের ৭২ ঘণ্টার আলটিমেটাম চলছে। এর মধ্যে আমরা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছি। আলটিমেটাম শেষে পরবর্তীকর্মসূচি ঘোষণা দেব। 

হল ছাড়তে নারাজ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা : জাবি প্রতিনিধি জানান, আগামী ১৭ মে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল খুলে দিতে শিক্ষামন্ত্রীর ঘোষণা মেনে হল ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) ছাত্রলীগ। কিন্তু নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে এখনো হল ছাড়তে নারাজ বিশ্ববিদ্যালয়টির সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এদিকে, গতকাল দিনভর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিভিন্নভাবে শিক্ষার্থীদের আবাসিক হল থেকে বের করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু হল ছাড়তে নারাজ শিক্ষার্থীদের বারবার বলেও হল থেকে বের করা যায়নি।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানিয়েছে, যতক্ষণ পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা হলে অবস্থান করবে ততক্ষণ পর্যন্ত শিক্ষকরা শান্তিপূর্ণ চেষ্টা চালিয়ে যাবেন শিক্ষার্থীদের  বোঝানোর জন্য এবং রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে হল ছেড়ে দেওয়ার জন্য। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ বলছে, শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশনার পর কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ থেকেও নির্দেশনা এসেছে। আমরা যারা ছাত্রলীগ করি তাদের এই নির্দেশ অমান্য করার সুযোগ নেই। ছাত্রলীগের হল ছাড়ার সিদ্ধান্তের বিষয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা বলেন, এটা তাদের দলীয় বিষয়। তারা হল ছাড়তে পারে। তবে আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা নিরাপত্তার জন্য হলে উঠেছি। হলেই থাকব। প্রসঙ্গত, গত শুক্রবার ক্যাম্পাস পার্শ্ববর্তী গেরুয়া গ্রামের বাসিন্দারা জাবি শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে। পরদিন শনিবার শিক্ষার্থীরা আবাসিক হলের তালা ভেঙে ভিতরে প্রবেশ করে হলে থাকতে শুরু করেছেন।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় : ইবি প্রতিনিধি জানান, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে ১ মার্চের মধ্যে আবাসিক হল খুলে দেওয়া এবং পরীক্ষা চালুর দাবি জানিয়েছেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) শিক্ষার্থীরা। গতকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডায়না চত্বরে সংবাদ সম্মেলন করে শিক্ষার্থীরা এসব দাবি করেন তারা। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে শিক্ষার্থী জি কে সাদিক বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের এমন আচরণ শিক্ষার্থীদের হতাশ করেছে। এমন হঠকারী সিদ্ধান্ত আমরা প্রত্যাখ্যান করছি এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রতি আহ্বান রাখছি অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে হল-ক্যাম্পাস খুলে শিক্ষাকার্যক্রম স্বাভাবিক করুন। অন্যথায় শিক্ষার্থীরা এখনো পর্যন্ত সর্বোচ্চ যে ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে সেটা আর বজায় থাকবে না। আগামী ১ মার্চের মধ্যে হল ও ক্যাম্পাস খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করুন। অন্যথায় শিক্ষার্থীরা হলে প্রবেশের ব্যবস্থা নিজেরাই করে নিতে বাধ্য হবে। তাঁরা আরো বলেন, শিক্ষামন্ত্রীর ঘোষণার পর ইতোমধ্যে ইবিতে সব ধরণের পরিক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। আমরা মনে করি এটি চরম হটকারী সিদ্ধান্ত। কারণ ইতিমধ্যে অনেক বিভাগের পরীক্ষা চলছে, কিছু বিভাগে পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে। যার ফলে শিক্ষার্থীরা বাড়ি থেকে এসে মেস বা বাসা ভাড়া নিয়ে ক্যাম্পাসের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে অবস্থান করছেন। এমন পরিস্থিতিতে পরীক্ষা বন্ধ করে দিয়ে শিক্ষার্থীদের বিপাকে ফেলা হয়েছে। আবাসিক হল খুলে দিতে ও পরীক্ষা চালুর দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করেন শিক্ষার্থীরা। পরে তাদের তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শেখ আবদুস সালামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় উপাচার্য অধ্যাপক ড. শেখ আবদুস সালাম শিক্ষার্থীদের বলেন, আমি শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে একমত। তবে আমরা শিক্ষামন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কিছু করতে পারব না।

হল খুলে দেওয়ার দাবি ভিপি নূরের : গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে আয়োজিত বিক্ষোভ সমাবেশে ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নূর বলেন, ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে ২৪ মে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রীর ঘোষণা আমরা প্রত্যাখ্যান করছি। আপনাদের এ সিদ্ধান্ত শিক্ষার্থীদের জন্য সর্বনাশা সিদ্ধান্ত। চলতি ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে হোক কিংবা মার্চের শুরুতে; অতি দ্রুত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল খুলে দিতে হবে। নূর আরও বলেন, শিক্ষামন্ত্রীর সোমবারের ঘোষণার কারণে যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা কার্যক্রম চলছিল তা বন্ধ হয়ে গেছে। শিক্ষামন্ত্রীকেই ঘোষণা দিয়ে এসব শিক্ষা কার্যক্রম পুনরায় চালু করতে হবে। ডাকসুর সাবেক ভিপি আরও বলেন, বিশ্বের কোনো দেশেই এক বছরের বেশি সময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকেনি। অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে করোনার প্রকোপ কম। দেশের বিভিন্ন খাতের কার্যক্রমও স্বাভাবিকভাবে চলছে। তাই অনতিবিলম্বে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতে হবে। নিজেদের উদ্যোগে তালা ভেঙে হলে প্রবেশ করা শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগের সমালোচনা করে নূর বলেন, ছাত্র সমাজকে নিয়ে খেলবেন না। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠানকে সিদ্ধান্ত নিতে দিন। বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদের আয়োজিত এ বিক্ষোভে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা অংশ নেন। 

সব বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা স্থগিত : ‘বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দিয়ে ক্লাস শুরুর আগে কোনো পরীক্ষা হবে না’ শিক্ষামন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে চলমান ও আসন্ন বিভিন্ন পরীক্ষা স্থগিত করেছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। পরীক্ষা বাতিলের ঘোষণা দেওয়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়।

প্রসঙ্গত, গত সোমবার দুপুরে এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি জানান, ২৪ মে বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়া হবে। এর আগে ১৭ মে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো খুলে দেওয়া হবে। এ সময় পর্যন্ত কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে না বলেও জানান তিনি।

সর্বশেষ খবর