বুধবার, ৩ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

স্থানীয় নির্বাচন এখন অনিয়মের মডেল : মাহবুব

নিজস্ব প্রতিবেদক

স্থানীয় নির্বাচন এখন অনিয়মের মডেল : মাহবুব

স্থানীয় নির্বাচনেও হানাহানি, মারামারি, কেন্দ্র দখল, ইভিএম ভাঙচুর ইত্যাদি মিলে এখন একটা অনিয়মের মডেল তৈরি হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। গতকাল জাতীয় ভোটার দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় লিখিত বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। ‘আমার বক্তব্য’ শিরোনামে লিখিত বক্তব্যে মাহবুব তালুকদার বলেন, “এক কেন্দ্রিক স্থানীয় নির্বাচনের তেমন গুরুত্ব নেই। নির্বাচনে মনোনয়ন লাভই এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। নির্বাচন প্রক্রিয়ার সংস্কার না হলে এখন যে ধরনের নির্বাচন হচ্ছে, তার মান আরও নিম্নগামী হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।”

এই নির্বাচন কমিশনার বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য না হলে দেশে স্থিতিশীলতা, সামাজিক অস্থিরতা ও ব্যক্তির নৈরাশ্য বৃদ্ধি পায়। নৈরাশ্য থেকে নৈরাজ্য সৃষ্টি হওয়ায় আশঙ্কা থাকে। নৈরাজ্যপ্রবণতা কোনো গণতান্ত্রিক দেশের জন্য মোটেই কাম্য নয়। নির্বাচন কমিশনের ওপর সাংবিধানিক দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। এই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে না পারলে আমরা গণতন্ত্র অস্তাচলে পাঠানোর দায়ে অভিযুক্ত হব। সাম্প্রতিক সিটি নির্বাচনগুলোর ভোটের হার তুলে ধরে এ নির্বাচন কমিশনার বলেন, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ভোটের হার ছিল যথাক্রমে ২৫.৩৪ শতাংশ ও ২৯.০৭ শতাংশ। চট্টগ্রাম সিটি করাপোরেশন নির্বাচনে ভোট পড়েছে সাড়ে ২২ শতাংশ। এত কম ভোটে আমরা রাজধানী ঢাকায় দুজন এবং চট্টগ্রামে একজন নগরপিতাকে নির্বাচিত করেছি, যার নজির নিতান্ত বিরল। ইভিএম নিয়ে নিজের অবস্থান তুলে ধরে মাহবুব তালুকদার বলেন, এক সময় আমি বিভিন্ন কারণে ইভিএম বা ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন ব্যবহারের বিরোধী ছিলাম। বিশেষভাবে কোনো প্রস্তুতি ব্যতিরেকে ও সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মতি ছাড়া জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারে আপত্তি করেছি। বর্তমানে প্রধানত দুটি কারণে আমি ইভিএমে ভোট গ্রহণে আগ্রহী।

মত বদলের সেই দুই কারণ তুলে ধরে তিনি বলেন, ইভিএমে ভোট হলে নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্স ভরা সম্ভব হয় না। বিভিন্ন কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়ার বিড়ম্বনা থেকে ‘রক্ষা পাওয়া’ যায়। তবে ইভিএমে ভোট হলে ভোটার উপস্থিতি ও ভোটের পরিসংখ্যান আশঙ্কাজনকভাবে কমে যায়।

‘ইভিএম ব্যবহার করে আমরা সর্বত্র ভোট জালিয়াতি, কারচুপি, কেন্দ্র দখল ইত্যাদি অভিযোগ থেকে রেহাই পেয়েছি, এমন দাবি আমি অন্তত করি না। কিন্তু ইভিএম ব্যবহারের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো নিরসন করার উদ্যোগ গ্রহণ অপরিহার্য। নির্বাচন বিষয়ক অনিয়ম ও অভিযোগ যথাযথভাবে আমলে না নেওয়ায় আমরা প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের দায়ে অভিযুক্ত হতে পারি।’ তিনি বলেন, ‘ইভিএম ব্যবহার করে আমরা সর্বত্র ভোট জালিয়াতি, কারচুপি, কেন্দ্র দখল ইত্যাদি অভিযোগ থেকে রেহাই পেয়েছি, এমন দাবি আমি অন্তত করি না। কিন্তু, ইভিএম ব্যবহারের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো নিরসন করার উদ্যোগ গ্রহণ অপরিহার্য। নির্বাচন বিষয়ক অনিয়ম ও অভিযোগ যথাযথভাবে আমলে না নেওয়ায় আমরা প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের দায়ে অভিযুক্ত হতে পারি। তবে, ভবিষ্যতে ব্যালট ও ইভিএম- উভয় পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণ থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। কারণ, একই নির্বাচনে দুটি পদ্ধতি ব্যবহারের ফলে ভোটপ্রদানের শতকরা হারের অনেক তারতম্য পরিলক্ষিত হয়। এই পার্থক্যের অর্থ ভোট গ্রহণের ফলাফলে বিভেদ সৃষ্টি। ভোট গ্রহণে এ ধরনের বৈষম্য কাম্য নয়।’ তিনি আরও বলেন, বর্তমানে আমরা দেশব্যাপী পৌরসভা নির্বাচনের প্রায় শেষ পর্যায়ে আছি। আগামী এপ্রিল থেকে ধাপে ধাপে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। স্থানীয় নির্বাচনগুলোর গতিপ্রকৃতি দেখে আমার ধারণা হচ্ছে, বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনের যে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ ও ভারসাম্য রক্ষিত হওয়ার প্রয়োজন ছিল, তা হচ্ছে না। রাউজানের নির্বাচন বিষয়ে তিনি বলেন, “বাংলাদেশে সবচেয়ে চমক সৃষ্টিকারী পৌরসভা নির্বাচন হয়েছে চট্টগ্রামের রাউজানে। বিগত ২৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে সেখানে মেয়র ও ১২ জন কাউন্সিলর বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। ফলে রাউজান থেকে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও তখন তুলে নেওয়া হয়েছে। ইতিপূর্বে উপজেলা নির্বাচনেও ঠিক এভাবে রাউজানে সবাই বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। তবে এটা ‘নির্বাচন’ না বলে ‘মনোনয়ন’ বলাই সম্ভবত অধিকতর সঙ্গত। সারা দেশে যদি এই মডেলে সবাই বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জনপ্রতিনিধি হতে পারেন, তাহলে নির্বাচনে অনেক আর্থিক সাশ্রয় হয় এবং সহিংসতা ও হানাহানি থেকে রেহাই পাওয়া যায়। এতে নির্বাচন কমিশনের দায়-দায়িত্ব তেমন থাকবে না। এ অবস্থায় নির্বাচন কমিশনের আর প্রয়োজন হবে কি না, সেটা এক বড় প্রশ্ন।”

সর্বশেষ খবর