বুধবার, ৩ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা
একনেকে প্রধানমন্ত্রী

মানুষের যেন খাদ্য সমস্যা না হয়

নিজস্ব প্রতিবেদক

মানুষের যেন খাদ্য সমস্যা না হয়

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, করোনাকালে সারা বিশ্বে যেখানে অর্থনীতি মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে, সেখানে আমরা যেভাবে অর্থনীতিকে চালু রেখেছি, সেটা বজায় রাখতে হবে। এখন গুরুত্ব দিতে হবে খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহে। মানুষের যেন খাদ্য সমস্যা না হয়। গতকাল জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় তিনি এ কথা বলেন। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সচিবরা রাজধানীর শেরেবাংলানগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে উপস্থিত থেকে এবং প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এনইসি সভায় অংশ নেন। এনইসি সভায় চলতি অর্থবছরের জন্য ১ লাখ ৯৭ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকার সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (এনইসি)।  

প্রধানমন্ত্রী            শেখ হাসিনা বলেন, সরকার করোনাভাইরাসের অস্বাভাবিক পরিস্থিতি থেকে দেশকে টেনে তুলছে। দেশকে একটি উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত করতে আন্তরিকভাবে কাজ করায় সব স্তরের মানুষের প্রতি তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, আমরা দেশে এই চলমান মহামারী কিছুটা নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়েছি। তবে, এই ভাইরাসটি বিদেশে কোথাও কোথাও রূপান্তরিত হয়ে আরও শক্তিশালী হিসেবে দেখা দিয়েছে। তাই, আমাদেরকে এটা থেকে দেশ ও জনগণকে রক্ষা করতে হবে। কভিড-১৯ অভিঘাত মোকাবিলায় সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এসব প্রচেষ্টাই দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছে এবং এ জন্যই বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। তিনি চলমান উন্নয়ন কর্মকাে  অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে অধিকতর সতর্ক ও মিতব্যয়ী হওয়ার জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনাদের মাথায় রাখতে হবে যে, বাংলাদেশ এখন একটি উন্নয়নশীল দেশ। তাই, আমরা অন্য কোনো দেশের সহায়তা চাইতে পারি না বরং আত্মসম্মান বজায় রেখে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আমাদের দেশ এগিয়ে যাবে।

শেখ হাসিনা বলেন, কাজের গতি বাড়াতে প্রকল্প পরিচালকদের প্রকল্প এলাকায় থাকতে হবে। সেই সঙ্গে একজন পরিচালককে একাধিক প্রকল্পে নিয়োগ করা যাবে না। একটি প্রকল্পে একজনই প্রকল্প পরিচালক থাকবেন। তাকে অন্য কোনো প্রকল্পে দায়িত্ব দেওয়া যাবে না। যথাসম্ভব আইনকানুন মেনে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সব প্রকল্পের কাজ শেষ করতে হবে। 

সংশোধিত এডিপি ১ লাখ ৯৭ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকা : এনইসি সভায় চলতি অর্থবছরের জন্য ১ লাখ ৯৭ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকার সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (এনইসি)। এর মধ্যে সরকারি তহবিলের ১ লাখ ৩৪ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক সহায়তা থেকে ৬৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হবে। অবশ্য স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব ১১ হাজার ৬২৮ কোটি ৯০ লাখ টাকাসহ সংশোধিত এডিপির সর্বমোট আকার দাঁড়াবে ২ লাখ ৯ হাজার ২৭১ কোটি ৯০ লাখ টাকা। সংশোধিত এডিপি বা চূড়ান্ত এডিপিতে বৈদেশিক সহায়তা খাতে কমছে সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা।

এ ছাড়া সভায়, বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ কর্তৃক প্রণীত ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা প্রতিবেদন এবং ২০২০-২০২১ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির জুলাই ২০২০ থেকে জানুয়ারি ২০২১ পর্যন্ত বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা প্রতিবেদন এনইসি সভায় উপস্থাপন করা হয়েছে এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) সেক্টর পুনর্বিন্যাস অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। সভা শেষে দুপুরে পরিকল্পনা বিভাগের সচিব মোহাম্মদ জয়নুল বারী সাংবাদিকদের সামনে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাসহ আরএডিপির তথ্য তুলে ধরেন। সচিব প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা তুলে ধরে বলেন, যথাসময়ে এবং যথাসম্ভব আইনকানুন মেনে সব প্রকল্প সমাপ্ত করার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন। সরকারের নেওয়া বিভিন্ন প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকল্প পরিচালকদের প্রকল্প এলাকায় থাকার নির্দেশনা দিয়েছেন। একই সঙ্গে একই ব্যক্তিকে যেন একাধিক প্রকল্পের পিডি হিসেবে দায়িত্ব না দেওয়া হয়, সে নির্দেশনাও দিয়েছেন বলে জানান সচিব।

এদিকে, এনইসি সভায় দারিদ্র্য বিমোচনের সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্ট প্রকল্পগুলোর অগ্রাধিকার বিবেচনায় রেখে ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বাজেট চূড়ান্ত করেছে পরিকল্পনা কমিশন। সংশোধিত এডিপিতে খাতভিত্তিক সর্বোচ্চ গুরুত্ব পেয়েছে পরিবহন খাত। এ ছাড়াও স্বাস্থ্য, পুষ্টি, জনসংখ্যা ও পরিবারকল্যাণ খাতে ১৪ হাজার ৯২১ কোটি ৮৮ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা মূল এডিপির ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশ। মূলত কভিড-১৯ মোকাবিলায় স্বাস্থ্য খাতকে এবারের সংশোধিত এডিপিতে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় সংশোধিত এডিপির আকার ১ লাখ ৯৭ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকা। তবে, এডিপির আকার ছিল ২ লাখ ৫ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা। পরিকল্পনা কমিশনের সচিব মোহাম্মদ জয়নুল বারী জানান, সংশোধিত এডিপির জন্য প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগ থেকে মোট ২ লাখ ৩ হাজার ৮৬৬ কোটি ৭৫ লাখ প্রাথমিক চাহিদা পায় পরিকল্পনা কমিশন। সবকিছু বিবেচনা করে সংশোধিত এডিপির আকার ১ লাখ ৯৭ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়। পরিকল্পনা সচিব বলেন, ২০২০-২০২১ অর্থবছরে সংশোধিত এডিপিতে সর্বমোট ১৭৮৫টি প্রকল্প। এর মধ্যে বিনিয়োগ প্রকল্প ১৬৪০টি, কারিগরি সহায়তা প্রকল্প ১৪৫টি এবং স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা বা করপোরেশনের ১০১টি প্রকল্পসহ ২০২০-২০২১ অর্থবছরে এডিপির সর্বমোট প্রকল্প ১৮৮৬টি। এ ছাড়া সংশোধিত এডিপিতে ৪৮৯টি প্রকল্প বরাদ্দবিহীন অননুমোদিত নতুন প্রকল্পের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বৈদেশিক সাহায্যে বরাদ্দবিহীন অননুমোদিত ১৩০টি নতুন প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সংশোধিত এডিপিতে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাে র প্রসার, অধিক কর্মসংস্থান, শিক্ষা-স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়ন, মহামারী কভিড-১৯ পরিস্থিতি মোকাবিলা, মানবসম্পদ উন্নয়ন, খাদ্য উৎপাদন, খাদ্য নিরাপত্তা ও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চয়তাকরণ করা হয়েছে।

দারিদ্র্য বিমোচন ও দেশের সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

খাতভিত্তিক সর্বোচ্চ গুরুত্ব ১০টি সেক্টরে : প্রস্তাবিত সংশোধিত এডিপিতে সর্বোচ্চ বরাদ্দপ্রাপ্ত ১০টি সেক্টরের মধ্যে পরিবহন খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৪৯ হাজার ২১২ কোটি ৮৬ লাখ, যা মোট বরাদ্দের ২৪ দশমিক ৯০ শতাংশ। এর পরে ভৌত পরিকল্পনা, পানি সরবরাহ ও গৃহায়ণ প্রায় ২৬ হাজার ৪৯২ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ১৩.৪০ শতাংশ। শিক্ষা ও ধর্ম খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২৬ হাজার ৪৯১ কোটি ৯৬ লাখ টাকা, যা মোট বরাদ্দের ১৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ। ভৌত পরিকল্পনা, পানি সরবরাহ ও গৃহায়ন খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২৪ হাজার ৫৭১ কোটি ৮০ লাখ টাকা, যা মোট বরাদ্দের ১২ দশমিক ৬৮ শতাংশ। পল্লী উন্নয়ন ও পল্লী প্রতিষ্ঠান খাতকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২১ হাজার ৯৪৫ কোটি ১৭ লাখ টাকা, বিদ্যুৎ খাতকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১৮ কোটি ২৮৯ লাখ ৭০ হাজার টাকা, মোট বরাদ্দের ৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ। স্বাস্থ্য, পুষ্টি, জনসংখ্যা ও পরিবারকল্যাণ খাতকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১৪ হাজার ৯২১ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। পানিসম্পদ খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১১ হাজার ৫৭৫ কোটি ৬৭ লাখ টাকা, কৃষি খাতকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৭ হাজার ৭৩৪ কোটি ৩০ লাখ টাকা, বিজ্ঞান, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৬ হাজার ৭০৮ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। শিল্প খাতকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৩ হাজার ৫০০ কোটি ৯ লাখ টাকা।

১০টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব : ১০টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ১০টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে ১ লাখ ৫০ হাজার ২৮২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, যা মোট সংশোধিত এডিপির সাড়ে ৭৬ শতাংশ। এরই ধারাবাহিকতায় স্থানীয় সরকার বিভাগে ৩৪ হাজার ১৭০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, যা মোট এডিপির ১৭ দশমিক ৪১ শতাংশ। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে ২৫ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, যা মোট এডিপির ১৩ দশমিক ১২ শতাংশ। বিদ্যুৎ বিভাগকে গুরুত্ব দিয়ে ২১ হাজার ৯৩৫ কোটি টাকা অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, যা মোট এডিপির ১১ দশমিক ১৭। এ ছাড়া রেলপথ মন্ত্রণালয়ে ১১ হাজার ৯৮৮ কোটি, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে ১১ হাজার ৯৭৯ কোটি টাকা অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, যা মোট সংশোধিত এডিপির ৬ দশমিক ১১ শতাংশ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে ১০ হাজার ৯০৩ কোটি এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ১০ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগে ৯ হাজার ৬৮৫, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে ৭ হাজার ৩৬৪ ও গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে ৫ হাজার ৮০৮ কোটি টাকা অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। 

মেগা প্রকল্পে বরাদ্দ কমেছে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা : বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) থেকে ১০ মেগা প্রকল্পে বরাদ্দ কমেছে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা (১ হাজার ৯৩০ কোটি ৪০ লাখ টাকা)। এসব প্রকল্পের অনুকূলে বরাদ্দ আছে ৩৩ হাজার ৩২১ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। সেখান থেকে কাটছাঁট করে সংশোধিত বরাদ্দ ধরা হয়েছে ৩১ হাজার ৩৯১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। ২০২০-২০২১ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসের অর্থাৎ জুলাই, ২০২০ থেকে জানুয়ারি, ২০২১ পর্যন্ত এডিপিতে মোট ব্যয় হয়েছে প্রায় ৬১ হাজার ৪৯ কোটি বা ২৮.৪৫ শতাংশ। একই সময়ে গত অর্থবছর ব্যয় হয়েছিল প্রায় ৬৮ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা বা ৩২.০৭ শতাংশ। জাতীয় অগ্রগতির হারে প্রথম সাত মাসের বিবেচনায় এবারই গত পাঁচ অর্থবছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। কারণ হিসেবে কভিড পরিস্থিতির কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা।

সর্বশেষ খবর