বৃহস্পতিবার, ৪ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে নতুন ভাবনা

অপপ্রয়োগ রোধে আসতে পারে বিধি । যুক্ত হবে তদন্ত ছাড়া মামলা না নেওয়ার বিধান

আরাফাত মুন্না

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে এবার নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে সরকার। আইন সংশোধন না করেও এর অপপ্রয়োগ বন্ধে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের নিয়ে এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে আইন মন্ত্রণালয়। এ ক্ষেত্রে কোনো অভিযোগ ওঠার পর পুলিশের তদন্তের আগে মামলা না নেওয়া বা গ্রেফতার না করার বিধান যুক্ত করে আসতে পারে বিধি। আইন মন্ত্রণালয়সূত্র বাংলাদেশ প্রতিদিনকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। নানা বিতর্কের মধ্যেই ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করে সরকার। আইনটি যখন খসড়া করা হয় তখনই গণমাধ্যম ও মানবাধিকার কর্মীরা আপত্তি তুলেছিলেন আইনের অপপ্রয়োগের আশঙ্কা থেকে। তারা আইনটির অজামিনযোগ্য ধারা, অভিযোগের পর পুলিশি তদন্ত ছাড়াই গ্রেফতারসহ অনেক ধারায় আইনের অপব্যবহার নিয়ে আশঙ্কার কথা জানিয়েছিলেন। তবে সব আপত্তি  উপেক্ষিত হয়। আইন পাসের পর বেশ কিছু ঘটনায় আইনটি নিয়ে প্রশ্নও ওঠে। সর্বশেষ এ আইনে নয় মাস আটক থাকা লেখক মুশতাকের মৃত্যুর পর অভিযোগ উঠেছে, ছয়বার আবেদন করেও জামিন মেলেনি তাঁর। নতুন করে বিতর্কের মুখে পড়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। সূত্র জানান, মূলত আইনটির অজামিনযোগ্য ধারা এবং অভিযোগ পাওয়ার পর তদন্ত ছাড়াই গ্রেফতারের বিষয়টি নিয়ে বেশি বিতর্ক হচ্ছে। এ ছাড়া মুশতাকের মৃত্যুর পর বিভিন্ন মহল থেকে আইন সংশোধনে নতুন করে দাবি উঠেছে। তাই আইনের অপপ্রয়োগ বন্ধের পথ খুঁজতে আইনমন্ত্রীর নির্দেশে একটি টিম গঠন করে দেওয়া হয়েছে। জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এ আইনে কোনো অপরাধের অভিযোগ এলে পুলিশের তদন্তের আগে কাউকে গ্রেফতার করা যাবে না বা তার বিরুদ্ধে মামলা নেওয়া যাবে না এমন একটা ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। মন্ত্রী বলেন, ‘তিন-চার মাস ধরে আমরা এটা নিয়ে কাজ করছি। এরই মধ্যে মানবাধিকার কমিশনের সঙ্গে একটা বৈঠকও করেছি। আমি আমার মন্ত্রণালয়ে একটা টিমও তৈরি করে দিয়েছি, তারা এটা পর্যালোচনা করবেন।’ এর আগে সোমবার বিবিসি বাংলাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বিষয়টি নিয়ে জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের সঙ্গে আলোচনা করার কথা উল্লেখ করে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিল অফিসের সঙ্গে আমি আলাপ চালাচ্ছি। সারা বিশ্বের সঙ্গে আমরা এটার তুলনা করছি। মিসইউজ যেগুলো ধরা পড়ছে বা অ্যাবিউজ যেগুলো হচ্ছে সেগুলোর জন্য একটা চেক অ্যান্ড ব্যালান্স সিস্টেম কীভাবে ডেভেলপ করা যায়, এ আইনের মধ্যেই কীভাবে সেটা থাকতে পারে সে ব্যবস্থা আমরা করছি।’ তদন্ত না করে শুধু অভিযোগের ভিত্তিতে একজন মানুষকে গ্রেফতার করাটাও আইনের ব্যত্যয় মনে করেন সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শাফিক আহমেদ। তিনি বলেন, ‘অভিযোগ এলে আগে তদন্ত করে দেখতে হবে অভিযোগটা ঠিক আছে কি না, হুট করে একজনকে গ্রেফতার করলে তার সাংবিধানিক অধিকারও ক্ষুণœ হয়।’ আইনের অপপ্রয়োগ রোধে কী ব্যবস্থা হতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে শফিক আহমেদ বলেন, ‘প্রথমত আইনটি সংশোধন করা যায়। এ ছাড়া সংশোধন না করতে পারলে একটি বিধি প্রণয়ন করে অপপ্রয়োগের পথ বন্ধ করা যায়।’ তিনি বলেন, আইনের যেসব ধারার অস্পষ্টতার সুযোগে এর অপব্যবহার হচ্ছে বিধিতে ওই ধারাগুলো স্পষ্ট করে দিতে হবে। তাই আইনের অপপ্রয়োগ এবং এর দ্বারা মানুষকে হয়রানি বন্ধে আইনটি পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে বলে মনে করেন এই জ্যেষ্ঠ আইনজীবী।

যেসব ধারা নিয়ে বিতর্ক : ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে গুপ্তচরবৃত্তি, ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত, মানহানিকর তথ্য প্রকাশ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট, মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা জাতির পিতার বিরুদ্ধে প্রচারণার মতো বিভিন্ন অপরাধ ও এর সাজা নির্ধারণ করা হয়েছে। শুধু দেশে নয়, দেশের বাইরে বসে কেউ এ আইনের অধীনে এমন অপরাধ করলে এ আইনে বিচার করার বিধান রয়েছে। এ আইনের ১৪টি ধারার অপরাধ অজামিনযোগ্য। সেগুলো হলো ১৭, ১৯, ২১, ২২, ২৩, ২৪, ২৬, ২৭, ২৮, ৩০, ৩১, ৩২, ৩৩ ও ৩৪। আইনে ৩২ ধারায় ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি বেআইনিভাবে প্রবেশের মাধ্যমে কোনো সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা বিধিবদ্ধ কোনো সংস্থার অতিগোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত কম্পিউটার, ডিজিটাল যন্ত্র, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণ, প্রেরণ বা সংরক্ষণ করেন বা করতে সহায়তা করেন তাহলে সে কাজ হবে কম্পিউটার বা ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ। এর শাস্তি সর্বোচ্চ ১৪ বছরের কারাদন্ড বা ২৫ লাখ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ড। আবার এ অপরাধ অজামিনযোগ্য। আইনের ২৯ ধারায় মানহানিকর তথ্য প্রকাশ ও সম্প্রচারের বিষয়ে বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে মানহানি-সংক্রান্ত দন্ডবিধির (১৮৬০) সেকশন ৪৯৯-এ বর্ণিত অপরাধ সংঘটন করেন তাহলে শাস্তি তিন বছরের কারাদন্ড বা ৫ লাখ টাকা অর্থদন্ড। আবার অপরাধটি দ্বিতীয় বা বারবার করলে অনধিক পাঁচ বছর কারাদন্ড বা সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ড হবে। আইনের ২১ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ডিজিটাল মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা জাতির পিতার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রপাগান্ডা ও প্রচারণা চালান বা তাতে মদদ দেন তাহলে তা অপরাধ হবে। এ অপরাধের শাস্তি ১৪ বছর কারাদন্ড বা সর্বোচ্চ ১ কোটি টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ড। আর বারবার করলে যাবজ্জীবন কারাদন্ড বা সর্বোচ্চ ৩ কোটি টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন। ৩১ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা ডিজিটাল বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন বা করান যা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে, অস্থিরতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটায় বা ঘটানোর উপক্রম হয় তাহলে তা হবে একটি অপরাধ। এ জন্য তিনি সর্বোচ্চ সাত বছরের কারাদন্ড বা সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন। এ ধারার অপরাধে জামিন হবে না। আইনের ৪ নম্বর ধারা অনুযায়ী যদি কেউ বাংলাদেশের বাইরে এ আইনের অধীনে কোনো অপরাধ করেন, যা বাংলাদেশে সংঘটন করলে এ আইনের অধীনে দন্ডযোগ্য হতো তাহলে এ আইনের বিধানাবলি এভাবে প্রযোজ্য হবে, যেন ওই অপরাধ তিনি বাংলাদেশেই সংঘটন করেছেন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর