সোমবার, ৮ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

মধ্যপ্রাচ্যে থামছে না সহিংসতা

শামীম আহমেদ

ভাগ্যের চাকা বদলাতে ২০১৮ সালের জুনে রিক্রুটিং এজেন্সি  মেসার্স এমএইচ ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের (আরএল-১১৬৬) মাধ্যমে গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে ওমান পাড়ি জমান লক্ষ্মীপুরের হালিমা (ছদ্মনাম)। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টায় সালামএয়ার (ওএমএস ৩৯৭) বিমানযোগে দেশে ফিরে আসেন ওই নারী। কোলে চার মাসের এক কন্যাসন্তান। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমে এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ অফিসে গিয়ে তিনি জানান, তার সন্তানের পিতা একজন ওমানি নাগরিক। ওমানে গিয়েই তিনি শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হন। নির্যাতনের একপর্যায়ে অন্তঃসত্ত্বা হলে তাকে ওমান পুলিশের কাছে তুলে দেওয়া হয়। এরপর ওমান ডিপোর্টেশন ক্যাম্পে থাকা অবস্থায় তার সন্তানের জন্ম হয়। সেখান থেকেই তাকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। হালিমা এখন মানসিকভাবে অসুস্থ। শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন। তাকে ব্র্যাকের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। সম্প্রতি সৌদি আরব থেকে পাঁচ নারী অন্তঃসত্ত্বা হয়ে ও ওমান থেকে দুই নারী সন্তান নিয়ে দেশে ফিরেছেন। সংসারে আলো জ্বালাতে বিদেশে পাড়ি জমানো এই নারীরা এখন পরিবার ও সমাজের চোখে অচ্ছুত। শুধু নির্যাতন নয়, অনেক নারী ফিরছেন লাশ হয়ে। প্রতি বছর এই সংখ্যা বাড়ছে। ব্র্যাকের অভিবাস কর্মসূচির তথ্যানুযায়ী, গত পাঁচ বছরে ১১টি দেশ থেকে নারীর ৪৮৭টি মরদেহ দেশে এসেছে। এদের মধ্যে ২০১৬ সালে ৫৭টি, ২০১৭ সালে ১০২টি, ২০১৮ সালে ১১২টি, ২০১৯ সালে ১৩৯টি এবং করোনাকালীন নিয়মিত বিমান চলাচল না থাকলেও ২০২০ সালে নারীর ৭৭টি মরদেহ দেশে এসেছে। এর মধ্যে আত্মহত্যায় ৮৬, স্ট্রোকে ১৬৭, দুর্ঘটনায় ৭১ ও অন্যান্য কারণে ৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে ১১৫ জনের। খুন হয়েছেন দুইজন। এর মধ্যে সৌদি আরব থেকে ১৯৮টি, জর্ডান থেকে ৮৮টি, লেবানন থেকে ৭১টি, ওমান থেকে ৫৩টি, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ৩৯টি ও অন্যন্য দেশ থেকে ৩৮টি মরদেহ দেশে এসেছে। সম্প্রতি প্রথমবারের মতো সৌদি আরবে এক বাংলাদেশি নারী আবিরনকে হত্যার ঘটনায় সৌদি এক নাগরিকের ফাঁসির রায় হয়েছে। নির্যাতনের মুখে অনেকেই হারিয়ে ফেলছেন মানসিক ভারসাম্য। কেউ ফিরছেন পঙ্গু হয়ে। গত ৮ জানুয়ারি মধ্যরাতে সৌদি এয়ারলাইনস এসভি ৮০২ বিমানযোগে জেদ্দা থেকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে দেশে ফেরেন আসিয়া (ছদ্মনাম) নামের আরেক নারী গৃহকর্মী। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামার পর আসিয়ার উদ্দেশ্যহীন চলাফেরা এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশের নজরে আসে। মানসিক ভারসাম্যহীন থাকায় আসিয়ার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় আর্মড পুলিশ। পরদিন সকালে আসিয়াকে ব্র্যাকের সেফ হোমে হস্তান্তর করা হয়। এদিকে সম্প্রতি সৌদি আরব থেকে পা ভেঙে ফেরত পাঠানো হয় তানিয়া আক্তারকে। সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে ২০১৮ সালের ১৭ এপ্রিল রিক্রুটিং এজেন্সি এমএইচ ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের মাধ্যমে সৌদি আরব পাড়ি জমান তানিয়া। সেখানে একটি বাড়িতে কাজ দেওয়া হয়। ওই বাসা থেকেই তানিয়া তার স্বামী রাসেলকে ফোনে নির্যাতনের বিষয়ে জানান। তানিয়া ফোনে বলেন, ‘বাপে-পুতে একলগে শুইতে চায়, আমি না গেলে আমাকে মারে’। এই ফোন রেকর্ডটি রাসেল রেখে দেন। নির্যাতনের একপর্যায়ে তানিয়াার পা ভেঙে দেওয়া হয়। পুলিশের সহযোগিতায় সৌদি আরবের কিং খালিদ হাসপাতালে কিছুদিন চিকিৎসা নিয়ে নির্যাতনের চিহ্ন নিয়ে দেশে ফেরেন তানিয়া। রাসেলের অভিযোগ, এ বিষয়ে রিক্রুটিং এজেন্সিতে যোগাযোগ করলেও তারা ব্যবস্থা নেয়নি। দেশে ফেরা নারী গৃহকর্মীদের অধিকাংশই অভিযোগ করেছেন যে, সেখানে তারা নিয়োগকর্তা এবং মকতব (সৌদিস্থ রিক্রুটিং এজেন্সি)-এর প্রতিনিধি দ্বারা শারীরিক, মানসিক এবং যৌন নির্যাতনসহ ঠিকমতো খাবার না দেওয়া, চুক্তি অনুযায়ী বেতন না দেওয়া, নির্ধারিত সময়ের অধিক কাজ করানোসহ বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হয়েছেন। বিদেশে নারী কর্মীদের ওপর অমানুষিক নির্যাতনের চিত্র ওঠে এসেছে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির প্রতিবেদনেও। সৌদি আরবফেরত ১১০ নারী গৃহকর্মীর সঙ্গে কথা বলে কমিটি ২০১৯ সালের ২৬ আগস্ট একটি প্রতিবেদন দেয়। তাতে বলা হয়, ৩৫ শতাংশ নারী শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরে এসেছেন। ৪৪ শতাংশ নারীকে নিয়মিত বেতন দেওয়া হতো না। ২১ শতাংশ নারী কর্মীকে পর্যাপ্ত খাবার দেওয়া হতো না। ২০১৫ সালে সৌদি আরবে নারী কর্মী পাঠানোর সমঝোতা স্বাক্ষর করার পর থেকেই বিপুলসংখ্যক নারী বিদেশে যাওয়া শুরু করেন। বাড়তে শুরু করে রিক্রুটিং এজেন্সির সংখ্যাও। ১৯৯১ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৯ লাখ ২৪ হাজার ৪১৫ নারী কাজের উদ্দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। ২০২০ সালে করোনাকালীনও বিদেশ গেছেন ২১ হাজার ৯৩৪ জন নারী। ২০১৫ সাল পর্যন্ত মাত্র ১৫ রিক্রুটিং এজেন্সির বিদেশে নারী কর্মী পাঠানোর অনুমতি থাকলেও এখন এমন এজেন্সি ৬২১টি। নারী অভিবাসনকে গতিশীল করতে সরকার নানা উদ্যোগ নিলেও নারীর জন্য আজও নিরাপদ হয়নি বিদেশের শ্রমবাজার। ব্র্যাকের অভিবাস কর্মসূচি প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, বিমানবন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের তথ্য বিশ্লেষণে আমরা দেখেছি, গত পাঁচ বছরে ৪৮৭ নারীর মরদেহ দেশে এসেছে। সৌদি আরবেই মারা গেছেন ২০০ জন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মৃত্যু সনদে উল্লেখ আছে আত্মহত্যা। বিদেশে নারী কেন আত্মহত্যা করে এটা খতিয়ে দেখা দরকার। আবার নারীদের বিদেশে পাঠানোর নামে সিরিয়া কিংবা দুবাইতে বিক্রি করে  দেওয়ার ঘটনাও ঘটছে। নারী অভিবাসনের ক্ষেত্রে ‘নারী অভিবাসন নীতিমালা’ যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে নারী অভিবাসীর অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। প্রতিটি নারী কর্মীকে বিদেশে পৌঁছার আগে সে দেশের সিমকার্ড দিতে হবে। এছাড়া নারী কর্মী প্রেরণকারী রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে যথাযথ মনিটরিং ও অভিযুক্ত রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা জরুরি। কর্মী নির্যাতনকারী প্রতিটি অভিযুক্ত নিয়োগকর্তাকে সে দেশের আইন অনুযায়ী বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে।

সর্বশেষ খবর