বুধবার, ১০ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসনের অভাবে বিদেশি বিনিয়োগ আসে না

একান্ত সাক্ষাৎকারে ড. হোসেন জিল্লুর রহমান

মানিক মুনতাসির

প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসনের অভাবে বিদেশি বিনিয়োগ আসে না

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান ও ব্র্যাকের চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেছেন, প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসনের অভাব আর আমলতান্ত্রিক জটিলতার কারণে আমাদের এখানে বিদেশি বিনিয়োগ আসে না। এলেও আমরা তা ধরে রাখতে পারি না। এর সঙ্গে রয়েছে নীতি বাস্তবায়নের বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব। ফলে

গ্যাস-বিদ্যুৎ আর অবকাঠামোগত সমস্যা অনেকটা কেটে গেলেও এসব কারণে বিদেশি বিনিয়োগ আসছে না। কভিড পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া অনেকটাই দ্রুত করা সম্ভব হয়েছে। এর কারণ, মানুষ জীবন ও জীবিকার বিতর্কে জীবিকাকেও অগ্রাধিকার দিয়েছে। একইভাবে দেশের কৃষি খাত কিন্তু এক দিনও থেমে থাকেনি। মানুষ নিজের প্রয়োজনে ছুটে বেড়িয়েছে। যদিও এখানে সামষ্টিক অর্থনীতি বড় একটা ধাক্কা সামাল দিতে পেরেছে কিন্তু পারিবারিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এখনো নাজুক পর্যায়ে। এ ছাড়া দেশের ব্যাংকিং খাতে বর্তমানে সবচেয়ে বড় সংকট জবাবদিহিতার সংকট। যার ফলে এ খাতের অনিয়ম-দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকারের পুরো বিস্তারিত পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : কভিড পরবর্তী এই মুহূর্তে আমাদের সামগ্রিক অর্থনীতি কোন অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে বলে আপনি মনে করেন?

হোসেন জিল্লুর রহমান : আমরা কোথায় আছি এটা একটা প্রশ্ন। আরেকটা হচ্ছে কভিড না থাকলে আমরা যেভাবে এগোচ্ছিলাম সে অনুপাতে আমরা এখন কোথায় থাকতাম। এখানে প্রথমে বলি কভিড তো আমাদেরকে একটা বড় ধাক্কা দিয়েছে। দেশের ভিতরে এবং বিশ্ব অর্থনীতিও অনেক বড় ধাক্কা খেয়েছে। এখানে প্রাথমিক একটা ভয় ছিল কিন্তু এই যে জীবন আর জীবিকা, এই বিতর্কে বাংলাদেশ খুব দ্রুতই জীবিকার দিকে ঝুঁকে পড়ে। এটা হচ্ছে এক ধরনের প্রয়োজনের তাগিদে রাস্তায় নেমে পড়া। আর অর্থনৈতিক ধাক্কা সামলাতে আমরা খুব দ্রুতই মাঠে নেমে গিয়েছিলাম। এখানে এক বছরের ব্যবধানে আমাদের অর্থনীতিটার কী হলো সেটার উত্তর খুঁজতে হবে দুভাবে। এক. সামষ্টিক অর্থনীতি। অপরটি হলো পারিবারিক অর্থনীতি। এর ফলে যেটা হলো-সেটা হচ্ছে আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতিটা যে ধাক্কা খেয়েছিল সেটা সামাল দেওয়া গেছে। কিন্তু পারিবারিক অর্থনীতিটা এখনো বেশ নাজুক অবস্থায় রয়েছে। অনেক মানুষ বেকার হয়ে গেছে। বেশির ভাগ মানুষের আয় কমে গেছে। নতুন করে কেউ কাজ পাচ্ছেন না। তবে আমাদের রপ্তানি বা রেমিট্যান্স, কৃষিসহ অভ্যন্তরীণ খাতগুলো আশঙ্কার চেয়ে অনেক কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে আমাদের যে সেবা খাত সেটা কিন্তু এখনো বিপর্যস্ত। দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচিও থেমে গেছে। কিন্তু এখানে আমাদের সার্বিকভাবে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ কম। কেননা অনেক খাতই এখনো চালু হয়নি। ফলে এখানে উপখাত ধরেই বক্তব্য দিতে হবে। বা মূল্যায়ন করতে হবে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : কভিড পরিস্থিতির কারণে মানুষের আয় কমে গেছে। এর প্রভাব জীবন যাত্রাকে কীভাবে প্রভাবিত করছে বলে আপনি মনে করেন?

হোসেন জিল্লুর রহমান : এখানে বলতে হয়, আমাদের প্রবৃদ্ধির যে মূল চালিকা শক্তি তার মধ্যে দুটি হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। একটা হলো-গার্মেন্টস আর অন্য হলো রেমিট্যান্স। এর বাইরে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ হলো কৃষি। আবার এখানে ৫৫ শতাংশই কিন্তু সেবা খাতের অন্তর্ভুক্ত যেটা এখনো বিপর্যস্ত। ফলে আমাদের আয় তো কমেছেই। প্রায় ৭০-৭৫ শতাংশ মানুষের আয় কমে গেছে। এর ফলে মানুষের জীবন যাত্রাতেও পরিবর্তন এসেছে। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষের যে খাদ্যাভ্যাস এবং চলাফেরা সেখানে বেশি পরিবর্তন এসেছে। অনেকেই বসবাসের ক্ষেত্রে নিচের গ্রেডে নেমে গেছেন।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : সম্প্রতি বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যাওয়ার চূড়ান্ত মনোয়ন পেয়েছে এতে বাংলাদেশের সামনে নতুন যেসব চ্যালেঞ্জ এসেছে সেগুলো সম্পর্কে কিছু বলুন।

হোসেন জিল্লুর রহমান : এখানে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো-শুধু অর্থনীতির উন্নয়নই কিন্তু সব নয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সুশাসন, মানব সম্পদ এসব বিষয়কেও গুরুত্ব দিতে হবে। এখন তো মানব সম্পদ উন্নয়নটা সবচেয়ে দুশ্চিন্তার জায়গা হিসেবে দেখা দিয়েছে। কেননা করোনার কারণে অন্য খাতগুলো ঘুরে দাঁড়ালেও শিক্ষা খাতকে তো কোনোভাবেই আগের অবস্থায় নেওয়া যায়নি। এরই মধ্যে শুরু হয়েছে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন প্রক্রিয়া। ফলে সামনের দিনগুলোতে এই শিক্ষা, স্বাস্থ্য আর মানব সম্পদ উন্নয়নটা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এর বাইরে যেসব বিষয় রয়েছে-যেমন রপ্তানি, রেমিট্যান্স মানুষের গড় আয় এসব তো কিছুটা হলেও অগ্রগতি রয়েছে। আর করোনা মোকাবিলার ক্ষেত্রে আমরা খুব একটা দক্ষতা দেখাতে পারিনি। এখানে সমন্বিতভাবে কী করা যায় বা কী করা যেত সেগুলো নিয়ে ভাবতে হবে। ফলে করোনার ধাক্কায় বিপর্যস্ত মানব সম্পদ ব্যবস্থাকে আবার কীভাবে আগের জায়গায় নিয়ে যাওয়া যাবে সেটা এখনো অনিশ্চিত। আবার এখানে নতুন প্রবৃদ্ধির চালক খুঁজতে গেলে শুধুমাত্র সস্তা শ্রম দিয়ে সেটা ধরা যাবে না। এখানে দক্ষ শ্রমিক দরকার। যার ফলে শিক্ষার মানটাকে উন্নত করতে হবে। স্কুলে ঢোকা মানেই কিন্তু শিক্ষিত হওয়া নয়। স্কুলে যাচ্ছি কিন্তু শিক্ষিত হচ্ছি কিনা, স্কিলড হচ্ছি কিনা সেটা একটা নতুন প্রশ্ন হিসেবে দেখা দিয়েছে। আগামীর জন্য কিন্তু এগুলো বেশ বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : বর্তমান, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও সার্বিক অর্থনীতি নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?

হোসেন জিল্লুর রহমান : বিনিয়োগ বা কর্মসংস্থান বলতে-এখন তো সেটাই বড় চ্যালেঞ্জ। এগুলোর জন্য কতগুলো প্রণোদনাও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেগুলো কতটা কাজে লেগেছে সেটাই প্রশ্ন। এসব প্যাকেজে তো একটা শ্রেণিই বেশি উপকৃত হয়েছে। যেমন-এসএমই খাত এখনো তাদের ন্যায্যটা পায়নি। বলা হচ্ছে এসএমই খাতে ৬০ শতাংশ বিতরণ হয়েছে কিন্তু বাস্তবে সেটা কত। হয়তো তারও কম। এখন কিন্তু বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান মানে শুধুই কলকারখানা নয়। এখন শিক্ষা খাতে ব্যয় করাও একটা বিনিয়োগ। কেননা এ খাতের মান উন্নয়ন না হলে তো দক্ষ লোক তৈরি হবে না। এখানে হিউম্যান রিসোর্স গভর্নেন্স প্রতিষ্ঠা করা বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : সরকারের ভিতরে নানা অনিয়ম-দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতার বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?

হোসেন জিল্লুর রহমান : সুশাসন আর স্বচ্ছতা বলতে কিন্তু শুধু সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান করা নয়। এই যে দেখেন রংপুরের একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে যা চলছে, সেটার যে, ভিসি তাকে কীভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সেখানে সুশাসন, বা যোগ্যতার যাচাই করা হয়েছিল? নিশ্চয়ই তা করা হয়নি। ফলে নিয়োগের ক্ষেত্রে সুশাসন ও যোগ্যতম ব্যক্তিকে নিশ্চিত করতে হবে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : করোনার বিপর্যস্ত হয়ে পড়া অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে প্রসঙ্গে কিছু বলুন।

হোসেন জিল্লুর রহমান : এখানে তো আগেই বলেছি যে, জীবন-জীবিকার প্রশ্নে আমরা জীবিকাকেই বেছে নিয়েছিলাম। ফলে আমাদের অর্থনীতির পুুনরুদ্ধারটাও দ্রুত শুরু হয়েছে। কিন্তু আমরা তো করোনাকে পাত্তাই দিইনি। আবার সার্বিকভাবে আমরা স্বাস্থ্য খাতকে গুরুত্ব দিইনি। এখানে স্বাস্থ্য ব্যয়টা আসলে অনেক বেশিই। কৃষি খাতের কাজ তো কখনোই থেমে থাকেনি। মানুষ জীবিকার তাগিদে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মহামারীর আতঙ্কের মধ্যেও কাজ করেছে। যার ফলে অর্থনীতির পুনরুদ্ধারটাও বেশ দ্রুতই শুরু হয়েছে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজগুলো অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে কতটা কার্যকর ভূমিকা রেখেছে?

হোসেন জিল্লুর রহমান : সার্বিকভাবে বলা যায় এগুলো বেশ কার্র্যকর ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু এগুলোকে আরও কার্যকর করার সুযোগ ছিল। এখানেও এক ধরনের বৈষম্য কাজ করেছে। যারা সুবিধা পেয়েছেন তারাই পেয়েছেন। যারা পাননি। তারা আসলে পাননি। কারণ এ প্যাকেজগুলো বাস্তবায়ন করা হয়েছে ব্যাংকের মাধ্যমে এখন আমাদের সব লোক ব্যাংকের সঙ্গে যুক্ত নন। এখানে ক্ষুদ্রঋণ দাতা সংস্থাগুলোকেও কাজে লাগানো যেত। এখনো সে সুযোগ কাজে লাগানোর সময় রয়েছে। সরকারের হয়তো সদিচ্ছা ছিল সবাইকেই সুবিধা দেবে। কিন্তু এরপর যে পদ্ধতিটা বেছে নিল সেটা হয়তো সঠিক ছিল। এটাকে অন্যভাবে বাস্তবায়ন করলে আরও বেশি সংখ্যাক মানুষ এর উপকার পেত।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : আপনি কি মনে করেন করোনা বিদেশি বিনিয়োগ ধরার জন্য বেশ ইতিবাচক ছিল। আমরা সে সুযোগ কতটা কাজে লাগাতে পেরেছি?

হোসেন জিল্লুর রহমান : এখানে আমলাতান্ত্রিক হয়রানির বাস্তবতাটা একটা বড় ধরনের এটার ক্ষেত্রে আমরা মূলত উপযুক্ত পরিবেশটা এখনো তৈরি করতে পারিনি। এ ছাড়া আমাদের যে প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন সেটাও নিশ্চিত করতে পারিনি। ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যে, আসবেন আর সেবা পাবেন সেটাও নিশ্চিত করা যায়নি। আমাদের ভূমি নিবন্ধনে দীর্ঘস্থায়ী জটিলতা রয়ে গেছে। যতই আমরা একমুখী সেবার কথা বলি আসলে আমাদের জটিলতার অবসান কিন্তু হয়নি। আমাদের সস্তা শ্রম আছে, গ্যাস বিদ্যুৎ অবকাঠামোরও উন্নয়ন হয়েছে। তারপরও বিদেশি বিনিয়োগ হচ্ছে না। এর অন্যতম কারণ প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসনের অভাব। আরেকটা বড় কারণ হলো-যারা বিনিয়োগ করতে আসেন তাদের তো এখানে বসবাসও করতে হয়। তখন সেখানে বসবাসের জন্য যেসব এলিমেন্ট প্রয়োজন হয় সেগুলোতেও ধাক্কা খায়। এখানে উপযুক্ত পরিবেশ বলতে সেটাই বোঝায়। ফলে বলা যায় যেসব কারণে বিদেশি বিনিয়োগ আসছে না সেগুলো হলো-প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসনের অভাব, নীতি বাস্তবায়নের বিশ্বাসযোগ্যতার ঘাটতি এবং বাসযোগ্যতার একটা বড় ধরনের ঘাটতি আছে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : ব্যাংকিং খাতের অবস্থা সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?

হোসেন জিল্লুর রহমান : এখানে সবচেয়ে বড় স্পর্শকাতর এবং সবচেয়ে বড় দুর্বলতা দাঁড়িয়ে গেছে জবাবদিহিতার সার্বিক অনুপস্থিতি। অনেক সময় দেখা যায় যে, তারল্য ঘাটতি বা অন্য কিছু কিন্তু এখন এ খাতে সবচেয়ে বড় সংকট হলো জবাবদিহিতার সার্বিক অনুপস্থিতি। এটাকে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলে ব্যাংক খাতের দুর্নীতি কোনোভাবেই কমানো সম্ভব হবে না।

সর্বশেষ খবর