বৃহস্পতিবার, ১১ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

বিষে ভরা ঢাকার বাতাস

দূষিত শহরের শীর্ষে । ধুলার নগরীতে চলাফেরা দায় । দূষণের অর্ধেকই গাড়ির কালো ধোঁয়ায় । রাজধানী ঘিরে অবৈধ ইট ভাটা । রাত যত গভীর বাতাস তত দূষিত

মাহমুদ আজহার, শামীম আহমেদ ও জয়শ্রী ভাদুড়ী

বিষে ভরা ঢাকার বাতাস

রাজধানীর অনেক সড়কে ধুলার মধ্য দিয়েই চলতে হয় -রোহেত রাজীব

বিষে ভরা এখন রাজধানীর ঢাকার বাতাস। পুরনো লক্কড়ঝক্কড় গাড়ির কালো ধোঁয়া এ বিষযুক্ত বাতাসের প্রধান কারণ। ধুলার নগরীতে এখন চলাফেরা করাও দায়। রাজধানীর আশপাশ এলাকার ইট ভাটা থেকে নির্গত ধোঁয়ায়ও মারাত্মক দূষিত হচ্ছে বাতাস। রাত যত গভীর হয় ঢাকার বাতাস তত বেশি দূষিত হয়। এতে বাড়ছে ফুসফুসের ক্যান্সার, শ্বাসকষ্ট, যক্ষ্মা, নিউমোনিয়াসহ নানা রোগ। ঢাকার দূষণ নিয়ে বারবার উচ্চ আদালতের কঠোর বার্তা সত্ত্বেও নেই কার্যকর ব্যবস্থা।

ঢাকার অস্বাস্থ্যকর বাতাস থেকে রক্ষায় ৮ মার্চ নগরবাসীর জন্য কিছু পরামর্শ দেয় বিশ্ব বায়ুমান পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এয়ার ভিজুয়াল। এর মধ্যে রয়েছে ‘ঘরের বাইরে শরীরচর্চা করা যাবে না। বন্ধ রাখতে হবে বাসাবাড়ির দরজা-জানালা। ঘর থেকে বাইরে বেরোলে অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে। ঘরের বাতাস দূষণমুক্ত করতে চালিয়ে রাখতে হবে বায়ু বিশুদ্ধকরণ যন্ত্র।’ ঢাকাবাসীকে গত শীতের শুরু থেকে প্রতিদিনই এ পরামর্শ দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বায়ুমান পর্যবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠানটি। এই সময়ে কয়েক দিন পরপরই বিশ্বের দূষিত নগরীর শীর্ষে উঠে আসছে ঢাকার নাম।

এয়ার ভিজুয়ালের প্রতিবেদন অনুযায়ী এখন বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকায় শীর্ষে ঢাকা। কখনো উঠে এসেছে এক নম্বরে। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ৮ মার্চ দিনভর ঢাকার বাতাস ছিল অস্বাস্থ্যকর। ওইদিন বিকাল ৩টায় কারওয়ান বাজারে একিউআই (বায়ু মান সূচক) স্কোর ছিল ১৬৫; দূষণে ঢাকা ছিল বিশ্বের মধ্যে ষষ্ঠ। বিকাল ৪টায় কারওয়ান বাজারের একিউআই স্কোর হঠাৎ বেড়ে ২৮৩-তে গিয়ে দাঁড়ায়, যা চরম অস্বাস্থ্যকর। এ পরিস্থিতিতে শ্বাসকষ্ট বা হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তি, বয়স্ক ও শিশুদের সব ধরনের বাহ্যিক কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকতে পরামর্শ দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে দীর্ঘায়িত পরিশ্রম এড়াতে বলা হয়। রাত ৯টায় গড় দূষণমাত্রা ২৪৩ স্কোর নিয়ে বিশ্বের শীর্ষ দূষিত নগরীর তালিকায় উঠে আসে ঢাকার নাম। ১৯০ স্কোর নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল চীনের শেনিয়াং ও ১৭৯ স্কোর নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে ছিল ভারতের দিল্লি। এয়ার ভিজুয়ালের তথ্যানুযায়ী কোনো এলাকায় বায়ু মান সূচকে (একিউআই) স্কোর ৫০-এর নিচে থাকলে তাকে স্বাস্থ্যকর ধরা হয়। স্কোর ৫১ থেকে ১০০ হলে সহনীয়, ১০১ থেকে ১৫০ বিশেষ শ্রেণির মানুষের জন্য অস্বাস্থ্যকর, ১৫১ থেকে ২০০ হলে অস্বাস্থ্যকর, ২০১ থেকে ৩০০ খুবই অস্বাস্থ্যকর ও ৩০১ থেকে ৫০০ হলে তা বিপজ্জনক।

গভীর রাতেও বাড়ছে দূষণ : ঢাকার নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় গভীর রাতেও বাড়ছে দূষণ। ৮ মার্চ রাত ১টায় কারওয়ান বাজারে দূষণমাত্রা ছিল ২৪৬, রাত ২টায় ২০২। রাত ৩টায় কমতে শুরু করে। ওই রাতে পুরো ঢাকায় গড় দূষণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায় রাত ২টায়। স্কোর ২২১। রাত ৩টায় ২১৪। এরপর কমতে থাকে। ফেব্রুয়ারিতে বেশ কয়েক দিন দূষণে বিপজ্জনক পর্যায়ে চলে আসে ঢাকা। ২৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকার একিউআই স্কোর ছিল ৩২৮। এমন পরিস্থিতিতে সবাইকে দরজা-জানালা বন্ধ করে ঘরে থাকতে পরামর্শ দেওয়া হয়। কারণ প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ২৫০ থেকে ৫০০ মাইক্রোগ্রাম পিএম ২ দশমিক ৫ (অতিসূক্ষ্ম বস্তুকণা) উড়তে থাকে। আর এ কণা ফুসফুসের গভীরে পৌঁছে মারাত্মক ক্ষতি করে।

পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়নের কারণে বায়ু দূষিত হচ্ছে। রাজধানীতে প্রচুর নির্মাণকাজ হচ্ছে যা ধুলা তৈরি করছে। অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণকাজ, আবাসিক এলাকায় শিল্পকারখানা, ইট ভাটা থেকে শুরু করে কোনোটাই নিয়ম মেনে করা হয় না। বাতাসে যে পরিমাণ সালফার ডাইঅক্সাইড থাকে তা পানিতে মিশে চোখে জ্বালাপোড়া করায়। এতে ফুসফুসে প্রদাহ থেকে শুরু করে অনেক ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা দেয়। তা ছাড়া বাতাসে যে ধূলিকণা আছে তার মধ্যে পিএম-২ দশমিক-৫-এর নিচে যেসব উপাদান সেগুলোই সবচেয়ে ক্ষতিকর। আইনের প্রয়োগ না থাকায় ঢাকার দূষণ এখন অতিমাত্রায় দৃশ্যমান।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সর্বত্র গ্যাস ফিলিং স্টেশন না থাকায় দূরপাল্লার বাস-ট্রাকে তরল জ্বালানি ব্যবহৃত হয়। প্রতি রাতে এসব বাস-ট্রাক রাজধানীতে ঢুকছে। নির্মাণসামগ্রী, কৃষিপণ্য নিয়ে রাতে ঢাকায় ঢুকছে হাজার হাজার ট্রাক। ফলে বাস ও ব্যক্তিগত গাড়ি বন্ধ থাকার পরও রাত ১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত রাজধানীর বায়ু সর্বোচ্চ দূষণের কবলে পড়ছে।

ধুলার নগরীতে চলাফেরা দায় : রাজধানীজুড়ে চলছে সরকারের অনেক মেগা উন্নয়ন প্রকল্প। চলছে ব্যক্তিগত ও বেসরকারি নির্মাণকাজ। কোথাও ধুলা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করে কাজ চলছে না। এসব নির্মাণ এলাকা দিয়ে একটি যানবাহন গেলেই পেছনের পুরো এলাকা ধুলায় ঢেকে যাচ্ছে। আবার দূষণ কমাতে সড়কে নির্মাণসামগ্রী না রাখতে দুই সিটি করপোরেশন নির্দেশ দিলেও এখনো রাজধানীর অলিগলিগুলো ইট-বালু-পাথরের দখলে। বালুর ওপর দিয়ে দ্রুতগামী যানবাহন ছুটে যাচ্ছে ধুলা উড়িয়ে। এ ছাড়া কিছু অভিজাত এলাকা ছাড়া রাজধানীর অধিকাংশ ওয়ার্ডের রাস্তাঘাটের করুণ দশা। নতুন ওয়ার্ডগুলোর অবস্থা সবচেয়ে করুণ। ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়ে যানবাহন যাওয়ার সময় ধুলায় ঢেকে যাচ্ছে আশপাশের দোকান-বাড়িঘর। রাজধানীর বাসিন্দারা বলছেন, দরজা-জানালা বন্ধ রাখার পরও ঘরের আসবাব-ফ্লোর দিনের মধ্যে কয়েকবার মুছতে হয়। মোছার এক-দুই ঘণ্টার মধ্যেই ফের ধুলার আস্তর পড়ছে।

বাড়ছে কালো ধোঁয়া : রাজধানী থেকে টু স্ট্রোক ইঞ্জিনের গাড়ি তুলে দেওয়ার পাশাপাশি যানবাহনে সিএনজি ব্যবহার শুরু হওয়ায় কমতে থাকে দূষণ। তবে বর্তমানে অনেক গাড়ি তরল জ্বালানিতে ফিরতে শুরু করেছে। সেই সঙ্গে ফিটনেসবিহীন গাড়ি বেড়ে যাওয়ায় বাড়ছে দূষণ। ২০১২ সালে পরিবেশ অধিদফতরের জরিপে রাজধানীর বায়ুদূষণের জন্য ইট ভাটার ধোঁয়াকে ৫৮ এবং ধুলা, অন্যান্য ধোঁয়া, জৈববস্তু পোড়ানো ও অন্যান্য কারণকে ৪২ ভাগ দায়ী করা হয়। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী ঢাকার বায়ুদূষণের অন্যতম বড় উৎস ইট ভাটা। রাজধানীর আশপাশ থেকে ইট ভাটা সরানোর পরামর্শও ছিল বিশ্বব্যাংকের। দূষণ কমাতে ঢাকা ও আশপাশের পাঁচ জেলায় ৬২ শতাংশের বেশি অবৈধ ইট ভাটা বন্ধ করে দেয় পরিবেশ অধিদফতর। এর পরও ঢাকা শহরের বায়ুমানের উন্নতি হয়নি। ২০২০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের জরিপে দেখা যাচ্ছে, বর্তমানে রাজধানীর বায়ুদূষণের জন্য অর্ধেক (৫০ ভাগ) দায় তরল জ্বালানি পোড়ানো ধোঁয়ার, যা মূলত যানবাহন ও শিল্পকারখানার। ৪০ ভাগ দূষণের উৎস খড়, কাঠ, তুষের মতো জৈববস্তুর ধোঁয়া ও সূক্ষ্ম বস্তুকণা। বাকি ১০ ভাগ দূষণ ইট ভাটায় পোড়ানো কয়লা থেকে ঘটছে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাব অনুযায়ী দেশে মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি ৫ লাখের মতো। এর বড় একটি অংশই ঢাকায় চলাচল করে। নিয়মিত অভিযান চালানো হলেও প্রতি বছর মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি ২০-৩০ শতাংশ হারে বাড়ছে। এগুলো বাতাসে কালো বিষাক্ত ধোঁয়া ছাড়ছে। পরিবেশ অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী ২০২০ সালের জুন থেকে এ বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত যানবাহনের কালো ধোঁয়ার বিরুদ্ধে ৩৮টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে বিভিন্ন যানবাহনকে ৬ লাখ ৮৮ হাজার ৯০০ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

ইট ভাটার দূষণ চলছেই : ঢাকার বায়ুদূষণের অন্যতম প্রধান কারণ অবৈধ ইট ভাটা। কিছু ইট ভাটা বন্ধ করা হলেও ঢাকার আশপাশের অনেক ইট ভাটা এখনো চলছে খেয়ালখুশিমতো। নেই পরিবেশ ছাড়পত্র, ঘটাচ্ছে মারাত্মক দূষণ। এ ক্ষেত্রে নেই সরকারি কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণ। পরিবেশ অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী সারা দেশে মোট ইট ভাটা ৮ হাজার ৩৩টি। এর মধ্যে ২ হাজার ৫১৩টির পরিবেশ ছাড়পত্র নেই। বাস্তবে ঢাকার আশপাশেই অন্তত ৫ হাজার অবৈধ ইট ভাটা রয়েছে। ঢাকার পাশেই সাভার ও আশুলিয়ায় প্রায় আড়াই শ অবৈধ ইট ভাটা রয়েছে। সোমবারও ভ্রাম্যমাণ আদালত ছয়টি ইট ভাটায় অভিযান চালিয়ে ৬৮ লাখ টাকা জরিমানা করে। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ ইট ভাটাই অবৈধ। বছরের পর বছর এগুলো মারাত্মক দূষণ ঘটিয়ে চলেছে।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর