বৃহস্পতিবার, ১১ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

শব্দদূষণে জব্দ নগরজীবন

নিজস্ব প্রতিবেদক

সকাল ১০টা। রাজধানীর শাহবাগ মোড় দিয়ে যাতায়াত করছে শত শত যানবাহন। কার আগে কে যাবেন এই প্রতিযোগিতার সঙ্গে চালকরা বাজিয়ে চলেছেন বিকট শব্দে হর্ন। রাস্তার দুই পাশে হাসপাতালের দেয়ালে টাঙানো রয়েছে ‘সামনে হাসপাতাল, হর্ন বাজাবেন না।’ কিন্তু এদিকে ভ্রƒক্ষেপ নেই চালকদের। শুধু শাহবাগ নয়, পুরো রাজধানীর চিত্রই এটি। শব্দদূষণের মাত্রা স্থানভেদে কেমন হবে তার নির্দেশনা দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তাদের হিসাব অনুযায়ী কোনো এলাকায় ৬০ ডেসিবেল মাত্রার বেশি শব্দ হলে তা দূষণের আওতায় পড়বে। অফিসকক্ষ ও শ্রেণিকক্ষে শব্দের মাত্রা হবে ৩০-৪০ ডেসিবেল, হাসপাতাল এলাকায় ২০-৩৫ ডেসিবেল, রেস্তোরাঁয় ৪০-৬০ ডেসিবেল শব্দমাত্রা সহনীয়। ৬০ ডেসিবেলের বেশি শব্দে মানুষের সাময়িক শ্রবণশক্তি নষ্ট হতে পারে এবং ১০০ ডেসিবেল শব্দে মানুষ চিরতরে শ্রবণশক্তি হারাতে পারে।

শুধু তাই নয়, অতিরিক্ত শব্দের কারণে মানুষ আক্রান্ত হয় বিভিন্ন ধরনের ব্যাধিতে। নাক-কান-গলা রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মনিলাল আইচ লিটু বলেন, ‘স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করলে ব্যস্ত জায়গায় শব্দমাত্রা সর্বোচ্চ ৬০-৭০ ডেসিবেল থাকতে হবে। কিন্তু আমরা বিভিন্ন সময় গবেষণা করে দেখেছি, ঢাকার ফার্মগেট, শাহবাগ, মিরপুর, পল্টন, মতিঝিল, কারওয়ান বাজার, গাবতলী, মহাখালীর মতো ব্যস্ত এলাকায় শব্দের মাত্রা সব সময় ৯০-১০০-এর বেশি থাকে। শব্দদূষণের কারণে মানুষের শ্রবণশক্তি কমে যাচ্ছে। হেডফোন ব্যবহারেও মানুষকে সচেতন হতে হবে।

জাতীয় নাক, কান, গলা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু হানিফ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শব্দ দূষণের কারণে শ্রবণ শক্তি কমার পাশাপাশি মানুষের স্মৃতি শক্তি লোপ পাচ্ছে। মাথা ব্যথা, অনিদ্রা ও মানসিক অস্থিরতায় ভুগছে মানুষ। উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে শব্দ দূষণ। যারা বেশি সময় ধরে অতিরিক্ত শব্দের মধ্যে থাকেন তাদের আচরণ সাংঘর্ষিক হয় এবং মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। আর এর সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে শিশু এবং বয়স্কদের ওপর। পশ্চিম রাজাবাজার এলাকার ফরিদুর রহমান বলেন, ‘আমার ছেলে পড়াশোনায় অমনোযোগী এবং বন্ধুদের সঙ্গে অধিকাংশ সময় মারামারি করে। আস্তে আস্তে তার আচরণ আরও সাংঘর্ষিক হয়ে উঠলে তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাই। চিকিৎসক আমাদের অনেক পরামর্শের সঙ্গে ছেলেকে অতিরিক্ত শব্দ থেকে দূরে রাখতে বলেন।’ শব্দদূষণের গুরুত্ব বিবেচনায় রেখে ১৯৯৭ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে শহরকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়েছে; নীরব এলাকা, আবাসিক এলাকা, মিশ্র এলাকা, শিল্প এলাকা ও বাণিজ্যিক এলাকা।

এসব এলাকায় দিন ও রাতভেদে শব্দের মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ আইন অনুযায়ী হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকার নির্ধারিত কিছু প্রতিষ্ঠান থেকে ১০০ মিটার পর্যন্ত এলাকাকে নীরব এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই চিহ্নিত এলাকাগুলোয় মোটর গাড়ির হর্ন বাজানো বা মাইকিং করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

এরপর ২০০৬ সালে বাংলাদেশ শব্দদূষণ নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। এ নীতিমালা অনুযায়ী আবাসিক এলাকায় সকাল ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সর্বোচ্চ শব্দসীমা ৫৫ ডেসিবেল এবং রাত ৯টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত ৪৫ ডেসিবেল। একইভাবে নীরব এলাকার জন্য এ শব্দসীমা যথাক্রমে সর্বোচ্চ ৫০ ও ৪০ ডেসিবেল, মিশ্র এলাকায় ৬০-৫০ ডেসিবেল, বাণিজ্যিক এলাকায় ৭০-৬০ ডেসিবেল এবং শিল্প এলাকায় ৭৫-৭০ ডেসিবেল সর্বোচ্চ শব্দসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর ওপরে শব্দ সৃষ্টি করাকে দন্ডনীয় অপরাধ হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে। কিন্তু আইনের কোনো বাস্তবায়ন চোখে পড়ে না রাজধানীতে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর