বৃহস্পতিবার, ১১ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা
সাক্ষাৎকার - মো. নুরুল আমিন, সাবেক সভাপতি এবিবি

ব্যাংকগুলোকে ব্যবহার করা হয়েছে অর্থ পাচারকারীদের স্বার্থে

আলী রিয়াজ

ব্যাংকগুলোকে ব্যবহার করা হয়েছে অর্থ পাচারকারীদের স্বার্থে

‘দেশের আর্থিক প্রবৃদ্ধিতে ব্যাংকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিনিয়োগ থেকে শুরু করে বৈদেশিক বাণিজ্য, শিল্পায়ন, রেমিট্যান্স সংগ্রহে ব্যাংকগুলো বড় ধররের ভূমিকা রেখেছে। এ ভূমিকা ম্লান হয়ে গেছে অর্থ পাচার এবং ইচ্ছাকৃত কিছু ঋণখেলাপির কারণে। দেশের আর্থিক অবকাঠামোর জন্য যে পরিমাণ প্রযুক্তি ও দক্ষতা উন্নয়ন প্রয়োজন ছিল, তা-ও আমাদের বড় ঘাটতি। অনেক ক্ষেত্রে দেশের মোট অর্থনীতির বাস্তবতা বিবেচনায় না নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এসব সিদ্ধান্তের কারণে ব্যাংকিং খাতে আমরা কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন করতে পারিনি। ব্যাংকগুলোকে অর্থ পাচারকারীদের স্বার্থে ব্যবহার করা হয়েছে।’ দেশের ব্যাংকিং খাতের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনের কাছে এক সাক্ষাৎকারে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি)-এর সাবেক সভাপতি,                  এনসিসি ব্যাংক ও মেঘনা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিশিষ্ট ব্যাংকার মো. নুরুল আমিন এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘আমরা যখন দেশের অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা করি তখন ব্যাংকিং কার্যক্রমের ভূমিকা সামনে চলে আসে। ব্যাংকের মাধ্যমেই দেশের এ বড় প্রবৃদ্ধির কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে, এখনো হচ্ছে। আবার আর্থিক অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা নিয়ে যখন আলোচনা হয়, ব্যাংকের চিত্র সামনে আসে। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ, অর্থ পাচার একটি বড় আলোচনার বিষয়। খেলাপি ঋণ নিয়ে আমাদের সংকট পূরনো। এর শুরু ১৯৮০ সালে। ওই সময় দেশের গার্মেন্ট খাতে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ শুরু হয়। রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী কিছু ব্যক্তি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে আর ফেরত দেননি। এরা ভাবতে শুরু করেন, ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে ফেরত দিতে হয় না। এ অনিয়ম থেকে ব্যাংকগুলো আর বেরোতে পারেনি।’ বিশিষ্ট এই ব্যাংকার বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক রেগুলেটর হিসেবে স্বাভাবিক ভূমিকা রেখেছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেম বা ভারতে রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার যে ভূমিকা, সে স্তরে উঠতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমের প্রধানের অনুমতি ছাড়া কোনো আর্থিক সিদ্ধান্ত নেন না যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। আমাদের এখানে বাংলাদেশ ব্যাংক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে পুরোপুরি স্বাধীন হতে পারেনি। অতীত থেকেই একটি স্বতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে এটি শক্ত ভূমিকা রাখতে পারেনি।’ নুরুল আমিন বলেন, ‘গত শতকের আশির দশকের পর যখন বেসরকারি খাতের ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হলো, আমাদের পুরো অর্থনৈতিক অবকাঠামো বাস্তব ভিত্তির ওপর ছিল না। আন্ডারইনভয়েসিং-ওভারইনভয়েসিং সম্পর্কে অনেকের ধারণাই ছিল না। এখন পর্যন্ত সে অবকাঠামো গড়ে তোলা যায়নি। ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের কিছু ব্যাক্তিও এ অনিয়মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। দেশের বাইরে ভুয়া কোম্পানি খুলে পণ্য রপ্তানি-আমদানি দেখান তারা। তারাই পণ্যের দর নির্ধারণ করেন। অফশোর ব্যাংকিংয়ের নামে ডলার পাচার হয়ে যায়। এত কিছু কেউ বুঝতে পারল না কেন? আন্ডারইনভয়েসিং বা ওভারইনভয়েসিংয়ের ক্ষেত্রে ব্যাংক যদি বুঝতে না পারে, কাস্টমসের তো ভুল হওয়ার কথা ছিল না। বাস্তবে দেখা গেল তারাও বুঝতে পারেনি। এটা আর্থিক অবকাঠামোর অদক্ষতা। এসব অদক্ষতা বিবেচনায় না নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।’ এবিবির সাবেক এই সভাপতি বলেন, ‘যারা অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। দুবাই, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, কানাডা, সেন্ট কিটসসহ বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচার করে তারা বাড়ি করেছেন, বিনিয়োগ করেছেন। বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমে যাদের নাম এসেছে, সুইস ব্যাংকে টাকা জমা রাখার ঘটনা আছে, কারও বিরুদ্ধেই কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এটা পুরো ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা প্রকাশ করে। কালো টাকার মালিকরাই নানা পদ্ধতিতে অর্থ পাচার করেছেন। আর পাচার বেশির ভাগ ঘটেছে ব্যাংকের মাধ্যমে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে না বোঝার কারণে এসব হয়েছে।’ এনসিসি ব্যাংকের সাবেক এই ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ব্যাংকিং খাত এখন ডিপোজিটরদের স্বার্থ দেখে না। স্বার্থ দেখে মালিক ও ঋণখেলাপিদের। তাদের নানাভাবে সহায়তা করা হয়। কিন্তু যে আমানতকারীদের অর্থে বিনিয়োগ হয়, তাদের কিছুই দেওয়া হয় না। যে পরিমাণ মুনাফা দেয় ব্যাংকগুলো আমানতকারীদের, সেটি মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম। শুল্ক, এক্সাইজ ডিউটি, ভ্যাট কাটার পর ৩ শতাংশের বেশি হয় না। কিন্তু বছর শেষে দেখা যাবে মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশের বেশি। নুুরুল আমিন বলেন, ‘আমাদের বিশাল অর্থনীতি। এত বড় অর্থনীতি ব্যাংকের মাধ্যমেই সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে হবে। যারা ঋণখেলাপি আছেন, কালো টাকার মালিক আছেন তাদের বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। যারা ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি হন, তাদের আদালতে রিট দায়েরের অবাধ সুযোগ বন্ধ করতে হবে। রিট করতে হলে ঋণের একটি অংশ ব্যাংককে পরিশোধ করতে হবে। ব্যাংকের ভূমিকা ছোট করে দেখা যাবে না। বোর্ড ম্যানেজমেন্টে যারা থাকবেন, তাদের ভূমিকা ব্যাংক পরিচালনায় সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। ব্যাংকিং কার্যক্রমে তাদের অংশ নিতে দেওয়া যাবে না। কাজের পরিধি মেনে চললে ব্যাংকিং খাত সঠিকভাবে ঘুরে দাঁড়াবে।’

সর্বশেষ খবর