শনিবার, ১৩ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

বঙ্গবন্ধু বললেন সর্বশক্তি দিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাও, দেশ স্বাধীন হবেই ইনশাল্লাহ

কাজী ফিরোজ রশীদ

বঙ্গবন্ধু বললেন সর্বশক্তি দিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাও, দেশ স্বাধীন হবেই ইনশাল্লাহ

২৫ মার্চ নূরে আলম সিদ্দিকীর নির্দেশে নূরে আলম সিদ্দিকীসহ অলি আহমেদ, আবদুল কুদ্দুস মাখন, মোস্তফা মহসীন মন্টুসহ আমরা রাতে মোহাম্মদপুর যাই। কারণ বিহারিরা স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেনি। বিহারিরা আমাদের মারার ষড়যন্ত্র করছিল। আমরা বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি করে সেখান থেকে বের হয়ে যাই। ইতিমধ্যে রাজারবাগ/ পিলখানা এলাকায় আক্রমণ করেছে পাক সাঁজোয়া বাহিনী। বঙ্গবন্ধু আমাদের যুদ্ধের নির্দেশ দিয়ে বেরিয়ে যেতে বললেন। বঙ্গবন্ধু বললেন, সর্বশক্তি দিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাও দেশ স্বাধীন হবেই ইনশাল্লাহ।

হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ রাতে ঘুমন্ত বাঙালি জাতির ওপর চরম বর্বরোচিত গণহত্যা শুরু করে। তাদের উন্মত্ততায় বাংলাদেশের জনপদগুলো দাউ দাউ করে জ্বলছিল।

চারদিকে শুধু নর-নারীর আর্তনাদ। জনপদ আর জনপদে সারি সারি লাশ। হানাদারদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের ডাকে (‘যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে’) উদ্বুদ্ধ হয়ে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে ২৫ মার্চ থেকে চূড়ান্ত বিজয় পর্যন্ত যে যুদ্ধ আমরা করলাম তাতে আমাদের যে বীরত্ব তা পৃথিবীর বিভিন্ন যুদ্ধের ইতিহাসে বিরল। ২৫ মার্চের পর থেকে কয়েক সপ্তাহ ধরে আমরা প্রতিরোধযুদ্ধ করি, এরপর শুরু হয় স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর নামে সর্বাত্মক পরিকল্পিত মুক্তিযুদ্ধ। সে যুদ্ধে ভারতের জনগণ, সরকার ও সেনাবাহিনীর ছিল অকুণ্ঠ সহযোগিতা। ’৭০ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার একটি আসনে (সূত্রাপুর-যাত্রাবাড়ী-লালবাগ) নবাব বংশের সন্তান তৎকালীন মুসলিম লীগ সভাপতি খাজা খয়েরউদ্দিনকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ওই নির্বাচনের সময় পাকিস্তানে সামরিক আইন বহাল ছিল। জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান ছিলেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। তিনি লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার (এলএফও) নামক যে ফরমান জারি করেছিলেন তারই ভিত্তিতে নির্বাচন হয়েছিল। সে নির্বাচনে সবচেয়ে তাৎপর্যময় ভূমিকা রেখেছিলেন ছাত্রলীগ নেতারা। আমরা জগন্নাথ কলেজে ক্যাম্প বানিয়ে দিন-রাত দুই শিফটে ২ হাজার ছাত্রলীগ নেতা-কর্মী বাড়ি বাড়ি গিয়ে বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগের প্রতীক নৌকায় ভোট দেওয়ার আবেদন জানিয়ে লিফলেট বিতরণ করি। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে দুটি বাদে সব আসনে জিতেছিল। ’৭১-এর ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসার কথা ঢাকায়। কিন্তু ১ মার্চ হঠাৎ ইয়াহিয়া ঘোষণা করেন, অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হলো। বিক্ষোভে ফেটে পড়ল গোটা দেশ। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে শহর-বন্দর-গ্রামে সংগ্রাম কমিটি গড়ে উঠল। মূলত সেদিন থেকেই বাংলাদেশের প্রশাসন পরিচালিত হতে থাকে বঙ্গবন্ধুর হুকুমে। ছাত্রলীগ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী ও সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ এবং ডাকসুর সহসভাপতি আ স ম আবদুর রব ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদ্দুস মাখনের নেতৃত্বে গঠিত হলো স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। এ জন্য পরবর্তীতে জনতা এ চার নেতাকে ‘চার খলিফা’ বলে অভিহিত করে। স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জাতীয় পতাকা উত্তোলন, ইশতেহার পাঠ এবং ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেন। আমরা প্রতিটি স্থানে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন শুরু করি। আমরা সাত-আটজন মিলে হাই কোর্ট ভবনে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করি। প্রকৃতপক্ষে ৭ মার্চের ভাষণের আগ থেকেই ছাত্রলীগ ভিতরে ভিতরে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। বঙ্গবন্ধু অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে, নির্বাচনে বিজয়ী বাঙালিদের হাতে পাকিস্তানিরা ক্ষমতা অর্পণ করবে না। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ যে মঞ্চে দাঁড়িয়ে ভাষণ দেন আমরা সে মঞ্চের শৃঙ্খলা কমিটির দায়িত্বে ছিলাম। সেদিন বঙ্গবন্ধু ১৯ মিনিটের ভাষণে যা বললেন তাতে আমাদের বুঝতে আর বাকি রইল না যে, আমাদের সামনে যুদ্ধ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। ইতিমধ্যে আমরা নারায়ণগঞ্জ রাইফেলস ক্লাব থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রাবাস ইকবাল হলে (বর্তমান নাম সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) এনে রাখি। কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মোস্তফা মহসীন মন্টু ভাইকে ১ মার্চ বের করে নিয়ে আসি। মন্টু ভাই পাঞ্জাবি সামরিক অফিসার হত্যা মামলায় কারাগারে আটক ছিলেন। তখন কারাগারেও শুরু হয় বিদ্রোহ। মন্টুর সঙ্গে কারাগার থেকে বের হয়ে এলো ডাকাত। লোকটা তার অস্ত্র আমাদের হাতে তুলে দেয়।

লেখক : কো-চেয়ারম্যান, জাতীয় পার্টি ও সংসদ সদস্য।

অনুলিখন : শফিকুল ইসলাম সোহাগ।

সর্বশেষ খবর