মঙ্গলবার, ২৩ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

ভুয়া বিলে কোটি টাকা আত্মসাতে পুলিশ ব্যাংক কর্মকর্তা সিজিএ অফিস চক্র

জালিয়াতির ৩৫ লাখ টাকা উত্তোলন করতে গিয়ে ধরা পড়েন এক পুলিশ পরিদর্শক ও এএসআই

মাহবুব মমতাজী

তিন বছর ধরে ভুয়া বিল বানিয়ে সরকারের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে আসছিল পুলিশ, ব্যাংক ও সিজিএ অফিসের একটি চক্র। তবে তাদের শেষরক্ষা হয়নি। সর্বশেষ ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ঢাকা রেঞ্জ ডিআইজি অফিসের নামে করা বেতন-ভাতার ৩৫ লাখ টাকার আরও একটি চেক জালিয়াতির মাধ্যমে পাস করিয়ে নেন চক্রের সদস্যরা।

ওই চেক রাজধানীর কাকরাইলের সোনালী ব্যাংক শাখায় জমা দিয়ে টাকা উত্তোলন করতে গিয়ে ধরা পড়েন চক্রের অন্যতম সদস্য পুলিশ পরিদর্শক মীর আবুল কালাম আজাদ ও এএসআই মোস্তাফিজুর রহমান। এরপর বরখাস্ত হন মীর আবুল কালাম আজাদ। আর চাকরিচ্যুত করা হয় মোস্তাফিজুর রহমানকে। ২০১৯ সালের ২৮ আগস্ট তাদের বিরুদ্ধে রমনা থানায় একটি মামলা করেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিরীক্ষা ও হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মো. শফিকুল ইসলাম। এরপর ওই দুজনকে গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করা হয়। বর্তমানে মামলাটি দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) তদন্তাধীন।

জানা গেছে, পুলিশের ঢাকা রেঞ্জ ডিআইজি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতার বিপরীতে মোটা অঙ্কের টাকার বিল তৈরি করত চক্রটি। জালিয়াতি করে তৈরি করা বিলটি পাসের জন্য নিয়ম অনুযায়ী জমা দিত মহা হিসাব নিয়ন্ত্রক অফিসের (সিজিএ) নির্ধারিত অডিটরের টেবিলে। বিল পাসের নিয়ম অনুযায়ী পুলিশ শাখার একজন অডিটর যাচাই-বাছাই করে বিলের কপিতে টোকেন লাগিয়ে দেন। এ কাজে ব্যবহার করা হয় অডিটরের আইডি ও পাসওয়ার্ড। টোকেন লাগানো শেষ হলে বিলে অডিটর নিজে স্বাক্ষর করেন এবং অডিট সুপারের স্বাক্ষর নেন। সুপার স্বাক্ষর শেষে বিলটি কম্পিউটারে এন্ট্রি দেন এবং নিজের আইডি থেকে বিলটি অ্যাপ্রুভ করেন। বিল অ্যাপ্রুভের পর তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে যায় অ্যাকাউন্টস অফিসারের আইডিতে। পরের ধাপে অ্যাকাউন্টস অফিসার তার আইডি থেকে ইলেকট্রনিকস ফান্ড ট্রান্সফার (ইএফটি) করে অডিটরের কাছে পাঠান। এ পর্যায়ে সিজিএ অফিসের তিনজন কর্মকর্তা বিলটি যাচাই-বাছাই করেন। পরে অডিটর ও সুপার বিলটি পাস করে ক্যাশ শাখায় পাঠান। ক্যাশ শাখা আইবিএএস প্লাস প্লাস (IBAS++) সিস্টেমে বিলটি এন্ট্রি দিয়ে পরে সেটি রেজিস্টারে তালিকাভুক্ত করে চেক ইস্যু করা হয়। পরবর্তী সময়ে বিলটি ব্যাংকে জমা দিয়ে উত্তোলন করা হয় টাকা। জালিয়াতির মাধ্যমে চেক উত্তোলনের ঘটনায় ৬ জানুয়ারি পুলিশ সদর দফতরের অতিরিক্ত ডিআইজি (ফিন্যান্স-১) মো. মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়ার স্বাক্ষরে ২৫ পাতার একটি প্রতিবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে পাঠানো হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৭ সালের ২৫ জুলাই থেকে ২০১৯ সালের ২৪ জুলাই পর্যন্ত ঢাকা রেঞ্জ ডিআইজি অফিসের বেতন-ভাতা শাখায় কর্মরত পুলিশ পরিদর্শক ও এএসআই মিলে সিজিএ অফিস থেকে ৫৯টি বিল চেক পাস করিয়েছেন। আর এসব চেক দিয়ে ১০ কোটি ৮২ লাখ ৩০ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি। চেকগুলোর মধ্যে ৪৯টি সোনালী ব্যাংক কাকরাইল শাখার এবং ১০টি আল-আরাফা ইসলামী ব্যাংক ভিআইপি রোড শাখার। ভয়ংকর এই জালিয়াতিতে দুই পুলিশ সদস্যকে অবৈধভাবে সহায়তা করেছেন সিজিএ অফিসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী। আর ইস্যু করা চেকগুলো যাচাই-বাছাই ছাড়াই টাকা উত্তোলনে সাহায্য করেছেন ব্যাংকের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা। প্রতিবেদনে ভবিষ্যতে এ ধরনের জালিয়াতি বন্ধে দুই পুলিশ সদস্যসহ সিজিএ অফিস ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা করে পুলিশের সিআইডিকে দিয়ে অধিকতর তদন্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে। এ বিষয়ে ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হাবিবুর রহমান এ প্রতিবেদককে বলেন, এটার তদন্ত অব্যাহত আছে। জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তদন্তকাজ শেষ হলে চূড়ান্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত পুলিশ পরিদর্শককে বরখাস্ত ও এএসআইকে চাকরিচ্যুত করা হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন বাকিরা। আর বেতন-ভাতার বিলের বিপরীতে পুলিশ পরিদর্শকের নামে ইস্যু করা ৩৫ লাখ টাকার বিলের কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেননি সিজিএ অফিসের কর্মকর্তারা।

যেভাবে সামনে আসে জালিয়াতি : ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ঢাকা রেঞ্জ ডিআইজি অফিসের তিনটি কোডের অনুকূলে (অর্থাৎ মূল বেতন, বাড়িভাড়া ও অন্যান্য ভাতা) বাজেট বরাদ্দ ও ওই অর্থবছরের বরাদ্দকৃত বাজেটের সঙ্গে প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার কার্যালয়ের প্রদর্শিত ব্যয় এবং অবশিষ্ট অর্থের অসামঞ্জস্যতা দেখা দেয়। এ ছাড়া চক্রের সদস্য পুলিশ পরিদর্শক আবুল কালাম আজাদ ২০১৯ সালের ২৮ জুলাই কাকরাইলের সোনালী ব্যাংকে বেতন-ভাতার বিল হিসেবে ৩৫ লাখ টাকার একটি চেক জমা দেন। টাকা ট্রানজেকশনের আগে বাংলাদেশ ব্যাংকে চেকটি যাচাই-বাছাইয়ের জন্য পাঠালে তাদের সন্দেহ হয়। পরে ব্যাংক লক্ষ্য করে, চেকের ওপর নিরীক্ষা ও হিসাবরক্ষণ অফিসার শফিকুল ইসলামের যে স্বাক্ষর রয়েছে, সেটি জাল। পরে ব্যাংক অর্থ ছাড় না করে সিজিএ অফিসকে জানায়। এরপর সিজিএ অফিস থেকে ৭ আগস্ট পুলিশের ঢাকা রেঞ্জ অফিসকে অবহিত করা হয়।

এ ঘটনা অনুসন্ধানে বর্তমান চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ (সিএমপি) কমিশনার ও তৎকালীন ঢাকা রেঞ্জ অফিসের অতিরিক্ত ডিআইজি সালেহ মোহাম্মদ তানভীরকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়।

 

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর