বৃহস্পতিবার, ২৫ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

দৃশ্যমান উন্নয়ন অবকাঠামো খাতে

ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-ময়মনসিংহ ফোর লেন মহাসড়ক, ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে সহজ করেছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। ঢাকা ও চট্টগ্রামে নির্মিত ফ্লাইওভারগুলোর সুফলও পাচ্ছেন দেশবাসী। কক্সবাজার থেকে টেকনাফে নির্মিত হয়েছে ৮০ কিলোমিটার দৃষ্টিনন্দন মেরিন ড্রাইভ। স্বপ্নের পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালসহ আরও অনেক উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলছে দ্রুতগতিতে

মানিক মুনতাসির

টানা প্রায় এক যুগের শাসনামলে বর্তমান সরকারের সময়ে যেসব উন্নয়ন হয়েছে, এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান উন্নয়ন ঘটেছে অবকাঠামো খাতে। দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের পর ২০০৮ মালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় নিয়ে সরকার গঠন করেছিল আওয়ামী লীগ। সে সময় দেশের অর্থনীতি ছিল অনেকটাই ভঙ্গুর। অবকাঠামো দুর্বলতার কারণে সড়কে-মহাসড়কে ছিল শুধুই যানজট। চট্টগ্রাম বন্দরে ও কমলাপুর আইসিডি টার্মিনালে লেগেই থাকত কনটেইনার জট। সে দৃশ্য এখন পাল্টে গেছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত হয়েছে। কমেছে সময়ের দূরত্ব। ঢাকা, চট্টগ্রাম, ফেনীতে নির্মিত ফ্লাইওভারগুলোর সুফলও পাচ্ছেন দেশবাসী। কক্সবাজার থেকে টেকনাফে নির্মিত হয়েছে ৮০ কিলোমিটার দৃষ্টিনন্দন মেরিন ড্রাইভ। স্বপ্নের পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা ও মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালসহ আরও অনেক উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলছে দ্রুতগতিতে। ব্যাপক হারে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে দেশজুড়ে গড়ে তোলা হচ্ছে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল। শুধু মিরসরাইয়ে ৩০ হাজার একর জায়গা জুড়ে গড়ে তোলা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শিল্পসিটি। ফলে তৈরি হয়েছে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের ব্যাপক সম্ভাবনা। যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সহজ করেছে ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-ময়মনসিংহ ফোর লেন মহাসড়ক। নবনির্মিত ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে সহজ করেছে দেশের দক্ষিণবঙ্গবাসীর চলাচল। ঢাকা ও চট্টগ্রামে নির্মিত ফ্লাইওভারগুলোর সুফলও পাচ্ছেন দেশবাসী। কক্সবাজার থেকে টেকনাফে নির্মিত হয়েছে ৮০ কিলোমিটার দৃষ্টিনন্দন মেরিন ড্রাইভ। চট্টগ্রামে নির্মিত হচ্ছে বে-টার্মিনাল। ব্যাপক হারে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে দেশজুড়ে গড়ে তোলা হচ্ছে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল। প্রযুক্তিতে পরিবর্তন এনেছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট। বিদ্যুৎ খাতেও এসেছে অভাবনীয় সাফল্য। বেড়েছে কৃষি ও খাদ্য উৎপাদন। ফলে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। বৈদেশিক রিজার্ভ বেড়েছে কয়েক গুণ। দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ৪৩ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। নানা চড়াই-উতরাই আর বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির বদনাম ঘুচিয়ে বাস্তবায়নের দ্বারপ্রান্তে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। এ সেতুর কাজ শেষ হয়েছে ৮০ শতাংশেরও বেশি। এই সেতুতে গাড়ির সঙ্গে একইভাবে চলছে রেললাইন স্থাপনের কাজ। সরকার বলছে, একই দিন গাড়ির পাশাপাশি রেল চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে এই সেতু। এদিকে ঢাকার জীবনকে সহজ আর গতিময় করতে মেট্রোরেলের কাজ চলছে দ্রুতগতিতে। উত্তরা দিয়াবাড়ী থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশ আগামী বছরের মধ্যে খুলে দেওয়া হবে। মেট্রোরেলের স্টেশন ও রেলট্র্যাক বসানোর কাজ চলছে। যোগাযোগের আরেক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে হচ্ছে বঙ্গবন্ধু টানেল। আবার যোগাযোগ ব্যবস্থায় নতুন সংযোজন ঘটবে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মাধ্যমে। বিদ্যুৎ খাতে ব্যাপক অগ্রগতির পর পারমাণবিক বিদ্যুৎ যুগে ঢুকতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এ জন্য পাবনার রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের কাজও এগোচ্ছে। পায়রা ও মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালসহ আরও অনেক উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলছে দ্রুতগতিতে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্মাণাধীন তৃতীয় টার্মিনাল হবে বিশ্বের অত্যাধুনিক, দৃষ্টিনন্দন বিমানবন্দরগুলোর সমতুল্য, যেখানে থাকবে ইংল্যান্ডের হিথ্রো, সিঙ্গাপুরের চেঙ্গি কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের জন এফ কেনেডির মতো আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা। উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি বাংলাদেশ যে আর্থ-সামাজিকভাবে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে, এর একটা ইতিবাচক বার্তা দেবে এই টার্মিনাল। বিমানবন্দরে নামলেই বিদেশি বিনিয়োগকারী, পর্যটকসহ বিদেশ থেকে আগতদের মধ্যে সৃষ্টি করবে এক ধরনের ইতিবাচক মনোভাব, যা উন্নত বাংলাদেশ গড়ার পেছনে এক ধরনের প্রেরণা হিসেবে কাজ করবে বলে মনে করে সরকার।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে থার্ড টার্মিনাল প্রকল্পের পরিচালক এ কে এম মাকসুদুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রকল্পের কাজ পুরোদমে এগিয়ে চলেছে। এটি হবে বিশ্বমানের বিমানবন্দর। থাকবে সব ধরনের অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা। এটি একটি স্বপ্নের প্রকল্প। এ টার্মিনালের সংযোগ সড়ক সরাসরি যুক্ত হবে মেট্রোরেল লাইন-১ ও প্রস্তাবিত সাবওয়ের সঙ্গে। এতে খুবই সহজ হবে যোগাযোগ ব্যবস্থা। বিদেশ থেকে আগতদের মধ্যে এক ধরনের ইতিবাচক বার্তা দেবে এই টার্মিনাল। জানা গেছে, নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় পেয়ে ২০০৯ সালের শুরুতে সরকার গঠনের পরপরই সারা দেশে শুরু হয় ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকান্ড। দ্বিতীয় মেয়াদেও সরকার অপরিবর্তিত থাকায় সেই উন্নয়ন কর্মকান্ড আরও গতি পায়। ঢাকাসহ সারা দেশের রাস্তাঘাট, অবকাঠামো, বিদ্যুৎ-জ্বালানিসহ গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে শুরু হয় ধাবমান ঘোড়ার মতো উন্নয়ন কর্মকান্ড। দীর্ঘদিনের বাধা কাটিয়ে বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে আসে অবিশ্বাস্য সাফল্য। এরই ধারাবাহিকতায় একাদশ জাতীয় নির্বাচনেও টানা তৃতীয়বার জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। এর আগে দ্বিতীয় মেয়াদের শুরুতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য নিয়ে যোগাযোগ, বিদ্যুৎ-জ্বালানি, রেলসহ সংশ্লিষ্ট খাতগুলোতে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে প্রায় এক ডজন বৃহৎ প্রকল্পের কাজ শুরু করে সরকার। এসব প্রকল্পের কাজ এগিয়েও যাচ্ছিল বেশ দ্রুতগতিতে। তরতর করে বাড়ছিল দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ও জিডিপি প্রবৃদ্ধি। কিন্তু গত বছরের শেষ ও চলতি বছরের শুরুতে সারা বিশ্বে শুরু হয় কভিড-১৯ মহামারী। এর ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও নেমে আসে বিপর্যয়। থেমে যায় সব ধরনের উন্নয়ন কর্মকান্ড। বছরের প্রায় শেষ প্রান্তে এসেও থামেনি প্রাণঘাতী কভিডের অচলাবস্থা। ফলে সব ধরনের উন্নয়ন কর্মকান্ড প্রায় থেমে গেছে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দু-একটি প্রকল্পের কাজ চললেও সেগুলোতে নেই কাক্সিক্ষত গতি। গত জুন থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সবকিছু আবারও সচল করে সরকার। ফলে বিশ্বের অনেক শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ বিপর্যয় এড়াতে ব্যর্থ হলেও বাংলাদেশ মোটামুটি সফলই হয়েছে। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারেও এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ, যা বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থাও স্বীকৃতি দিয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গত এক যুগে দেশের অবকাঠামোসহ প্রায় সব ক্ষেত্রেই উন্নয়ন হয়েছে। বিশেষ করে অর্থনৈতিক ক্ষেত্র, অবকাঠামো, বিদ্যুৎসহ কয়েকটি খাতে হয়েছে অভাবনীয় উন্নয়ন। তবে সরকারি অর্থের অপচয় ও দীর্ঘসূত্রতা রোধ করতে পারলে উন্নয়ন কর্মকান্ড আরও বেশি ত্বরান্বিত করা যেত বলে তিনি মনে করেন। কিন্তু একই মতাদর্শের সরকার টানা এক যুগ ধরে ক্ষমতায় থাকায় এ সময় সব ধরনের নীতি-কৌশল একই রকম থেকেছে। ফলে সব ধরনের উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালনা করাটাও বেশ সহজ হয়েছে বলে তিনি মনে করেন। এদিকে গত কয়েক বছরে ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ, নবীনগর ডিইপিজেড-চন্দ্রা-যাত্রাবাড়ী-কাঁচপুর মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ, মিরপুর ফ্লাইওভার, হাতিরঝিল, হানিফ ফ্লাইওভার, মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার, কুড়িল ফ্লাইওভার, বনানী ফ্লাইওভারসহ বিভিন্ন অবকাঠামোর উন্নয়ন হয়েছে।

চলমান এক্সপ্রেসওয়ের প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে সড়কপথে চাপ কমবে। এর মাধ্যমে যেমন যানজট কমবে, তেমনি এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ভ্রমণে জ্বালানি ও সময় উভয়ই সাশ্রয় হবে। কমে আসবে পণ্য পরিবহন ব্যয়। এদিকে বহুল প্রত্যাশিত ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে হাইস্পিড রেল স্থাপন প্রকল্পের কাজ খুব দ্রুতই শুরু হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

জানা গেছে, যোগাযোগের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণ করা হচ্ছে ৯ দশমিক ৩ কিলোমিটারের সুড়ঙ্গ পথ, যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু টানেল’। গত নভেম্বর পর্যন্ত এ প্রকল্পের কাজের সার্বিক অগ্রগতি ৬১ শতাংশ। ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে এ প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত হওয়ার কথা থাকলেও ২০২১ সালের মধ্যেই তা শেষ হয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। সেই লক্ষ্যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো অবিরাম কাজ করছে। ঢাকা শহরের চারদিকে সাবওয়ে নির্মাণকাজের সমীক্ষা প্রায় শেষের পথে। আশা করা হচ্ছে এ প্রকল্পের মূল কাজ শুরু হবে নতুন বছরের প্রথম প্রান্তিকেই। এ প্রকল্পের কাজের তেমন কোনো দৃশ্য এখনো চোখে পড়ে না। মূল কাজ শুরুর মাধ্যমে এটি দৃশ্যমান হবে বলে মনে করে সরকার।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর