সোমবার, ২৯ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

ধরন বদলে জটিল হচ্ছে করোনা

স্বাস্থ্যবিধি না মানায় আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে সংক্রমণ ও মৃত্যু

জয়শ্রী ভাদুড়ী

ধরন বদলে জটিল হচ্ছে করোনা

দুই দিন ধরে হালকা জ্বর বোধ করছিলেন মোহাম্মদপুরের সুমাইয়া বেগম (৩৮)। সন্দেহ হওয়ায় তার স্বামী-ছেলেসহ তিনজনের করোনার নমুনা টেস্ট করাতে দেন। সন্দেহ সত্যি প্রমাণ করে মোবাইলের এসএমএসে আসা রিপোর্ট অনুযায়ী তিনজনেরই করোনা পজিটিভ। বাড়িতে চিকিৎসকের পরামর্শে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন তারা। কিন্তু দুই দিন পার হতেই হঠাৎ তীব্র শ্বাসকষ্ট শুরু হয় সুমাইয়া বেগমের।

জরুরি ভিত্তিতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা যায়, উপসর্গ দেখা দেওয়া ও শনাক্ত হওয়ার চার দিনের মধ্যেই তার ফুসফুস মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পরের দিনই এমন পরিস্থিতি দাঁড়ায় যে, সুমাইয়া বেগমকে আইসিইউতে নিতে বলেন চিকিৎসকরা। কিন্তু ঢাকার ৯টি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ঘুরেও আইসিইউর ব্যবস্থা করতে পারেননি তার স্বজনরা। অবশেষে তাকে বাঁচাতে হাসপাতালেই হাইফ্লো অক্সিজেন দিয়ে রাখা হয়। শুধু সুমাইয়া বেগম নন, এ বছর করোনা পরিস্থিতিতে এরকম ঘটনা ঘটছে অহরহ। হঠাৎ করেই রোগীর পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ধরন বদলে জটিল হয়ে উঠছে করোনাভাইরাস।

চিকিৎসকরা বলছেন, গত বছর চূড়ান্ত সংক্রমণের সময়ও এত অল্প সময়ে রোগীর পরিস্থিতি খারাপ হতে দেখেননি তারা। বাড়িতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে অধিকাংশ রোগীকে। কিন্তু এ বছর শুধু হাসপাতালের চিকিৎসায় চলছে না, প্রয়োজন পড়ছে আইসিইউর। আর সেখানেই বাধছে বিপদ। সোনার হরিণ আইসিইউ জোগাড় করতে রোগীর স্বজনরা পড়ছেন বিপাকে। শয্যা ফাঁকা না থাকায় হাসপাতাল বাধ্য হচ্ছে রোগী ফিরিয়ে দিতে। বাড়ছে মৃত্যু। সংক্রমণ হার বাড়ছে হু হু করে। কিন্তু এ পরিস্থিতিতেও উৎসব-আন্দোলন, কেনাকাটা কিংবা ভ্রমণ সব জায়গায় উপেক্ষিত স্বাস্থ্যবিধি। মাস্ক দেখা যায় না কারও মুখে।

গত ২৮ ফেব্রুয়ারি করোনা সংক্রমণের হার ছিল ২ দশমিক ৮৭ শতাংশ। ঠিক এক মাসের মাথায় গতকাল সংক্রমণ হার এসে পৌঁছেছে ১৭ দশমিক ৬৫ শতাংশে। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে আক্রান্তের হার। গতকাল ২২ হাজার ১৩৪ জনের নমুনা টেস্ট করে ৩ হাজার ৯০৮ জনের দেহে করোনা শনাক্ত হয়েছে। মারা গেছেন ৩৫ জন। এর মধ্যে ২১ জনের বয়স ৬০ বছরের বেশি। ৩১-৪০ বছর বয়সী তিনজন, ৪১-৫০ বছর বয়সী ছয়জন এবং ৫১-৬০ বছর বয়সী পাঁচজন মারা গেছেন। গত বছরের ৮ মার্চ দেশে করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দিয়ে আসছেন ডা. তুষার মাহমুদ। বর্তমান করোনা পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এই চিকিৎসক ও করোনা গবেষক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘গত বছরের জুন-জুলাইয়ে করোনা আক্রান্ত সর্বোচ্চ রোগী ছিল। তখন আমার চিকিৎসা দেওয়া ১০০ জন রোগীর মধ্যে তিনজনকে হাসপাতালে পাঠাতে হতো। অথচ এই কয়েক দিনে ১০০ জন রোগীর ২০ জনকে হাসপাতালে পাঠাতে হয়েছে। এসব রোগীর অবস্থার অবনতি হওয়ায় আইসিইউ সাপোর্টও লাগছে। যে পদ্ধতিতে চিকিৎসা দিয়ে এতদিন রোগী সুস্থ করে তুলেছি এখন আর তা কাজ করছে না। করোনার নতুন ভেরিয়েন্ট আসায় এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তিনি আরও বলেন, রোগীদের জন্য আইসিইউর ব্যবস্থা করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। আক্রান্তদের মধ্যে তরুণদের হার বেশি। তাই সুস্থ থাকতে হলে অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে।’ চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতির অন্যতম কারণ কয়েক প্রকারের করোনাভাইরাসের ভেরিয়েন্ট। প্রথম করোনাভাইরাসের যে ভেরিয়েন্ট সারা বিশ্বে সংক্রমণ ঘটিয়ে ছিল সেটি কভিড-১৯। এরপর দ্বিতীয় ভেরিয়েন্টের নাম ইউকে ই-১১৭, তৃতীয় ভেরিয়েন্টের নাম ইউকে ই-১৫২৫, চতুর্থ সাউথ আফ্রিকান ভেরিয়েন্ট ই-১৩৫, পঞ্চম ভেরিয়েন্ট ব্রাজিলিয়ান পি-১। করোনাভাইরাসের জিন বিশ্লেষণে নতুন দুটি ভেরিয়েন্ট পাওয়া গেছে। যার সঙ্গে যুক্তরাজ্যের অত্যধিক সংক্রমণকারী ভেরিয়েন্টের মিল রয়েছে। এবার অপেক্ষাকৃত কম বয়সীরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে।

ভাইরাসের এই গতি পরিবর্তন বিষয়ে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘এখনো আমাদের কাছে এমন কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ নেই যাতে করে বলা যায়, করোনাভাইরাসের নতুন কোনো ধরনের কারণে সংক্রমণ বেড়েছে। তবে সংক্রমণ অব্যাহত থাকলে ভাইরাস মিউটেটেড হয়ে শক্তিশালী হতে পারে। তৈরি হতে পারে নতুন ধরন। এমন একটি পরিস্থিতিতে আমাদের দেশে জিনোম সিকোয়েন্সিং বাড়াতে হবে। সেটা করা না গেলে আমরা বুঝতেই পারব না যে আমাদের দেশে নতুন ধরন তৈরি হচ্ছে কি না বা সেটার শক্তি-সামর্থ্য কেমন।’

 

তিনি আরও বলেন, ‘টিকা নেওয়ার পর অনেকেই নিজেকে নিরাপদ ভাবতে শুরু করেছেন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা বাদ দিয়েছেন। বাংলাদেশে সংক্রমণ পাঁচ ভাগের নিচে নেমে এসেছিল। মৃত্যুও কমে এসেছিল। বাংলাদেশে টিকা কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর আমরা দেখছি, পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে আমাদের অংশগ্রহণ বেড়ে গেছে। একই সঙ্গে গরম চলে এসেছে। ঘরে বা বদ্ধ রুমে যখন আমরা মিলিত হচ্ছি, তখন ফ্যান বা এসি ছাড়তে হচ্ছে। ঘরের বাতাস যেহেতু ঘরের মধ্যেই চলাচল করছে, তাই সংক্রমণের মাত্রাও বেড়ে যাচ্ছে।’

স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা শনাক্ত হয়েছে ৩ হাজার ৯০৮ জনের দেহে, যা গত ৯ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। গত পাঁচ দিনই শনাক্ত রোগীর সংখ্যা সাড়ে ৩ হাজারের বেশি ছিল। এর আগে গত বছরের ২ জুলাই মাসে এর চেয়ে বেশি রোগী শনাক্তের খবর দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদফতর। সেদিন মোট ৪ হাজার ১৯ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছিল। মহামারী শুরুর পর থেকে সেটাই এক দিনের সর্বোচ্চ শনাক্ত। গত ২৪ ঘণ্টায় পরীক্ষার তুলনায় শনাক্তের হার বেড়ে ১৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ হয়েছে, যা ৩১ আগস্টের পর সবচেয়ে বেশি।

নতুন শনাক্ত ৩ হাজার ৯০৮ জনকে নিয়ে দেশে এ পর্যন্ত শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়াল ৫ লাখ ৯৫ হাজার ৭১৪ জনে। আর গত এক দিনে মারা যাওয়া ৩৫ জনকে নিয়ে দেশে করোনাভাইরাসে মোট ৮ হাজার ৯০৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। মৃতদের মধ্যে ৫ হাজার ৫৩ জন ঢাকা বিভাগের, ১ হাজার ৬২২ জন চট্টগ্রাম বিভাগের, ৪৯৪ জন রাজশাহী বিভাগের, ৫৭৪ জন খুলনা বিভাগের, ২৭২ জন বরিশাল বিভাগের, ৩১৭ জন সিলেট বিভাগের, ৩৭২ জন রংপুর বিভাগের এবং ২০০ জন ময়মনসিংহ বিভাগের বাসিন্দা ছিলেন। গত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে মোট ২২৪টি ল্যাবে ২২ হাজার ১৩৬টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এ পর্যন্ত পরীক্ষা হয়েছে ৪৫ লাখ ৮৮ হাজার ৮৩০টি নমুনা। ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষার বিবেচনায় শনাক্তের হার ১৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ। শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৮৯ দশমিক ৯৭ শতাংশ এবং মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৪৯ শতাংশ। করোনা সংক্রমণ আশঙ্কাজনক হারে বাড়লেও স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো বালাই নেই। মাস্ক ছাড়াই উৎসব, আন্দোলন, কেনাকাটা, ভ্রমণ সব চলছে সমানতালে। হিড়িক পড়েছে বিয়ে, পিকনিকসহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানের। এ ব্যাপারে কভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, নাগরিকদের ব্যক্তিগত সুরক্ষার দিকে নজর দিতে হবে। মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। প্রশাসন ও নাগরিকদের সমন্বিত সচেতনতা ছাড়া করোনা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। স্বাস্থ্যবিধি মানার পাশাপাশি টিকা নিতে হবে। শুধু এক দিন দেশের এক জায়গায় অভিযান চালালে হবে না। করোনা ছড়িয়ে পড়েছে দেশের কোনায় কোনায়। এ জন্য দেশব্যাপী সচেতনতা বাড়াতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, চিকিৎসকসহ সব পেশার মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। দেশে এক দিনে ৩৫ জন মানুষ মারা গেছেন। এটা গুরুতর বিষয়। বাস, ট্রেন, গণপরিবহনে স্ক্রিনিং চালাতে হবে। চারদিক থেকে একযোগে কর্মসূচি নিলে করোনা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর