শিরোনাম
সোমবার, ২৯ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

সংঘাত সহিংসতা অব্যাহত

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আবার সংঘর্ষে দুজন নিহত, হরতাল ডেকে বিক্ষোভ করেছে হেফাজত

নিজস্ব প্রতিবেদক

সংঘাত সহিংসতা অব্যাহত

হেফাজতের ডাকা হরতালে গতকাল রাজধানীর চিটাগাং রোডে টিভি চ্যানেল নিউজ টোয়েন্টিফোরের গাড়ি ভাঙচুর করা হয় -বাংলাদেশ প্রতিদিন

হেফাজতে ইসলামের ডাকা হরতাল চলাকালীন দেশের বিভিন্ন স্থানে গতকাল ভাঙচুর, সংঘর্ষ, যানবাহনে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ধারাবাহিক সংঘর্ষে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দুজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর চালানো হয়েছে চট্টগ্রামগামী সোনার বাংলা এক্সপ্রেস ট্রেন ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি অফিসে। নারায়ণগঞ্জে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে হরতাল সমর্থনকারীদের অব্যাহত সংঘর্ষে ছয়জন গুলিবিদ্ধসহ অর্ধশতাধিক আহত হয়েছেন। দিনভর বিক্ষোভে নারায়ণগঞ্জে হরতাল সমর্থকরা ১০টি গাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও অর্ধশতাধিক যানবাহনে ভাঙচুর চালায়। এ ছাড়া ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, কিশোরগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষ, অগ্নিসংযোগ, গুলি ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। হরতালে পুলিশ, গণমাধ্যমকর্মীসহ আহত হয়েছেন দুই শতাধিক।

বসুন্ধরার দুই গাড়িতে হামলা, আগুন : গতকাল কাচপুর ব্রিজের কাছে বসুন্ধরা এডিবল অয়েলের একটি ট্রাকের কাচ ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেয় হরতাল সমর্থকরা। এ সময় কোনোমতে প্রাণে বেঁচে যান ট্রাকটির চালক। এ ছাড়া বসুন্ধরা গ্রুপের আরও একটি পিকআপ হামলার শিকার হয়েছে। মেঘনাঘাটের সামনে ওই পিকআপটি ভাঙচুর করা হয়।

কর্মসূচি : এদিকে গতকালের হরতালের পর দোয়া ও বিক্ষোভ কর্মসূচি দিয়েছে হেফাজতে ইসলাম। আজ সোমবার হবে দোয়া ও শুক্রবার সারা দেশে তারা বিক্ষোভ দেখাবে। গতকাল রাজধানীর পল্টনে খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে নতুন এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন হেফাজতের মহাসচিব নুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, হেফাজতের শীর্ষ নেতারা হাটহাজারী মাদরাসায় বৈঠক করে এর পরের কর্মসূচি ঠিক করবেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের প্রতিবাদকারীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে গতকাল সারা দেশে হরতাল ডেকেছিল হেফাজতে ইসলাম। নুরুল ইসলাম বলেন, হেফাজতে ইসলাম নরেন্দ্র মোদির আগমন প্রত্যাহার করার জন্য কর্মসূচি দিয়েছিল। মোদির আসার দিন হেফাজতের কোনো কর্মসূচি ছিল না। কিন্তু, ওইদিন সাধারণ মানুষের আন্দোলনে প্রশাসন গুলি চালিয়েছে। যার প্রতিবাদে এ হরতাল আহ্বান করা হয়েছিল। বাংলাদেশ প্রতিদিনের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা পাঠিয়েছেন হরতালের খবর-

ঢাকায় ঢিলেঢালা হরতাল : বিচ্ছিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে ঢিলেঢালাভাবে রাজধানীতে পালিত হয় হেফাজতে ইসলামের ডাকা সকাল-সন্ধ্যা হরতাল। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ, যুবলীগসহ পুলিশের সঙ্গে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা প্রতিহত করতে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও মোড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অবস্থান নেয়। ঢাকার রাজপথে গণপরিবহনের সংখ্যা স্বাভাবিকের তুলনায় ছিল কম। যাত্রাবাড়ী এলাকায় হরতালের সমর্থনে বিক্ষোভ করেছেন হেফাজত কর্মীরা। সকাল থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করে রাখেন হরতালকারীরা। সেখানে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় হরতালকারীদের। বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনের এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে হেফাজত কর্মীরা। এ সময় ছাত্র ও যুবলীগের কর্মীদের সঙ্গে তাদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। সমাবেশ থেকে বক্তারা গত শুক্রবার চট্টগ্রামের হাটহাজারী ও শনিবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গুলিবর্ষণের ঘটনায় সরকারকে দায়ী করেন। একই সঙ্গে তারা এ ঘটনায় ছাত্রলীগ, যুবলীগ জড়িত থাকার অভিযোগ করে তাদের বিচার দাবি করেন। হেফাজতের হরতালের সমর্থনে রাজধানীতে বিক্ষোভ মিছিল করেছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। গতকাল বাদ জোহর বায়তুল মোকাররম মসজিদ থেকে মিছিল নিয়ে বের হয়ে পুরানা পল্টন মোড়ে বিক্ষোভ সমাবেশ করে দলটি। এ সময় পুরানা পল্টন-মুক্তাঙ্গন এলাকায় হরতালকারী হেফাজতের কর্মীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।

চট্টগ্রামে হরতালের প্রভাব পড়েনি : চট্টগ্রামে ঢিলেঢালাভাবে পালিত হয়েছে হেফাজতে ইসলামের ডাকা হরতাল। জেলার কয়েকটি এলাকায় বিচ্ছিন্ন দু-একটি ঘটনা ছাড়া কোথাও হরতালের প্রভাব পড়েনি। নগরীর যান চলাচল ছিল স্বাভাবিক। তবে হাটহাজারী মাদরাসার সামনে রাস্তার ওপর দেওয়াল তুলে দেওয়ার কারণে চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি সড়কে টানা তৃতীয় দিনের মতো যান চলাচল বন্ধ ছিল। একইভাবে চট্টগ্রাম-রাঙামাটি রুটের ইছাপুর এলাকায় ব্যারিকেড দেওয়ায় ব্যাহত হয় যান চলাচল। পটিয়া উপজেলা, ফটিকছড়ি উপজেলায় কয়েকটি এলাকায় হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীরা রাস্তার ওপর ব্যারিকেড দেওয়ায় ব্যাহত হয় যান চলাচল। নগরী ও জেলার বিভিন্ন এলাকায় মাঠ ছিল আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীদের দখলে। সিএমপি কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর বলেন, হরতালে নগরীর অবস্থা স্বাভাবিক ছিল। কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। হরতালে পুলিশের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অন্যান্য সংস্থাগুলো মাঠে ছিল। চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার এস এম রশিদুল হক বলেন, হরতালে দু-একটা জায়গায় সামান্য সমস্যা ছাড়া হরতাল শান্তিপূর্ণ হয়েছে। হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী বলেন, হরতালে আলেম-ওলামারা সাড়া দিয়েছেন। এ কারণে আমি দেশের আলেম-ওলামা ও জনগণকে মোবারকবাদ ও অভিনন্দন জানাচ্ছি। এভাবে ইসলাম বিরোধী কাজ হলে, জুলুম নির্যাতন হলে তৌহিদি জনতা ও ছাত্র জনতা ঝাঁপিয়ে পড়বে।

হেফাজত আমিরের সংবাদ সম্মেলন : পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হেফাজতে ইসলামের কর্মীদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ এবং আহতদের চিকিৎসা ব্যয় বহন করার দাবি করেছেন হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী। একই সঙ্গে হাটহাজারী থানার ওসি রফিকুল ইসলামের প্রত্যাহার চেয়েছেন তিনি। গতকাল হাটহাজারীতে সংবাদ সম্মেলন করে এ দাবি করেন তিনি। তিনি আহতদের সুচিকিৎসা ও যারা গ্রেফতার হয়েছেন তাদের নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করেন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ভাঙচুর ও মৃত্যু : বিক্ষুব্ধ হরতালকারীরা গতকাল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন স্থানে সরকারি-বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ অফিস, আওয়ামী লীগ কার্যালয় ও বাড়িঘরে ব্যাপক হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটায়। এ সময় আলামিন (২০) ও আশিক (৩৫) নামে দুজন নিহত হয়েছেন। হরতালের সমর্থনে হেফাজতের কর্মীরা বেলা ১১টার পর লাঠিসোঁটা নিয়ে রাস্তায় নেমে আসে। তারা শহরের হালদারপাড়ার জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়, জেলা পরিষদ কার্যালয়, জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহীর গাড়িসহ তিনটি মোটরসাইকেল, সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ পৌর মিলনায়তন, জেলা ক্রীড়া সংস্থা, পৌরসভা ভবন, পৌরসভা গ্যারেজের তিনটি গাড়ি, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা চত্বর, জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের কার্যালয়, জেলা শিল্পকলা একাডেমি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা গণগ্রন্থাগার, সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন সংগীতাঙ্গন, সদর উপজেলা ভূমি অফিস, আশুগঞ্জ টোলপ্লাজার বুথ, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকারের বাসভবন ও তার শ্বশুরবাড়ি, জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রবিউল হোসেন রুবেল ও জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহাদত হোসেন শোভনের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। শহরের শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা চত্বরে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আয়োজিত উন্নয়ন মেলার ৩২টি স্টলে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এ ছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাব, ব্যাংক অব এশিয়া, জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমপ্লেক্স, শহরের আনন্দময়ী কালীবাড়ির মন্দিরের মূর্তি, বিজয়নগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জহিরুল ইসলাম ভূইয়ার নিজস্ব অফিস, বিজয়নগর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নাসিমা মুকাই আলীর শহরের হালদারপাড়ার বাসভবন, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর, মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র, দলিল লেখক সমিতি ও ঠিকাদার খাইরুল আলমের বাসভবনে ব্যাপক ভাঙচুর চালানো হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাবে হামলার সময় প্রেস ক্লাবের সভাপতি রিয়াজ উদ্দিন জামি গুরুতর আহত হন। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত শহরের পৈরতলা, জেলা পুলিশ লাইন, কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়ক বিশ্বরোড এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। বেলা ১১টার দিকে শহরের পীরবাড়িতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পুলিশ লাইনে বিক্ষোভকারীরা হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ রাবার বুলেট ও টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করে। হামলা চলাকালীন সময়ে শহরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো সদস্যকে দেখা যায়নি। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে থানা মসজিদ থেকে পুলিশের পক্ষ থেকে মাইকিং করে থানায় হামলা না চালানোর জন্য মাদরাসার ছাত্রদের অনুরোধ করা হয়। সকাল নয়টার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় চট্টগ্রামগামী সোনার বাংলা এক্সপ্রেসে ভাঙচুর চালানো হয়। এতে বেশ কয়েকজন যাত্রী আহত হন। খুলে ফেলা হয় রেললাইনের নাট-বল্টু। লাইনের ওপর কংক্রিটের স্ল্যাবও ফেলে রাখে হরতালকারীরা। আশুগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাঝখানে ১৮ নম্বর রেলসেতুতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। নিরাপত্তার কারণে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেট, নোয়াখালীর পথে ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর আগে শনিবার সন্ধ্যায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সংঘর্ষের পর নিরাপত্তা ঝুঁকিতে প্রায় তিন ঘণ্টা ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে। গত শনিবার থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্টেশনে সব ধরনের আন্তনগর ট্রেনের যাত্রাবিরতি বাতিল করা হয়েছে।

নারায়ণগঞ্জ : ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড ও সানারপাড় এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে হরতাল সমর্থকদের দফায় দফায় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। হরতাল সমর্থকরা রাস্তা অবরোধ করলে পুলিশ তাদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। একপর্যায়ে হরতাল সমর্থকরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর ইট পাটকেল নিক্ষেপ শুরু করলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও পাল্টা টিয়ার শেল ও শটগানের গুলি ছোড়ে। থেমে থেমে বিকাল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত চলা সংঘর্ষে শফিকুল ইসলাম (৬৭), শাহাদাত (৩৫) ও শাকিল (৩২)সহ কমপক্ষে ছয়জন গুলিবিদ্ধ হয়। মোট আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক। নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম গতকাল সন্ধ্যায় জানান, পরিস্থিতি প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড ও ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ যান চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। শুধু সাইনবোর্ড থেকে কাঁচপুর পর্যন্ত পরিস্থিতি পুলিশের পর্যবেক্ষণে রয়েছে। আমরা কঠোর অবস্থানে রয়েছি। পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, গতকাল সকালে সংঘর্ষে সানারপাড় এলাকায় শাকিল নামে একজন গুলিবিদ্ধসহ পাঁচজন আহত হন। গুলিবিদ্ধ শাকিলসহ গুরুতর আহত অবস্থায় শফিকুল নামে এক ব্যক্তিকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। বিক্ষুব্ধ হেফাজতের কর্মীরা দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে মহাসড়কের পাইনাদি এলাকায় ১০তলা কুয়েতপ্লাজা ভবনের সামনে একটি বাস, একটি কাভার্ড ভ্যান ও একটি ট্রাকে আগুন দেয়।

হরতালের সমর্থনে হেফাজতের নেতা-কর্মীরা ফজরের নামাজের পর থেকেই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা, সিদ্ধিরগঞ্জের সাইনবোর্ড, সানারপাড়, মৌচাক, মাদানী নগর মাদরাসার সামনে, পাইনাদি এলাকায় ১০তলা কুয়েতপ্লাজা ভবন, শিমরাইল মোড়, শিমরাইল ইউটার্ন, সোনারগাঁয়ের কাঁচপুর- মোগরাপাড়া, বন্দরের মদনপুর এলাকায় লাঠিসোঁটা হাতে মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করে। বিক্ষুব্ধ হেফাজত কর্মীরা সড়কের কয়েকটি স্থানে আগুন জ্বালিয়ে যানবাহন চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। যান চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দুর্ভোগে পড়েন হাজারো যাত্রী।  বেলা ১১টার দিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সড়ক থেকে হরতালকারীদের হটিয়ে দিতে গেলে সংঘর্ষ শুরু হয়। এদিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সিদ্ধিরগঞ্জের কাঁচপুর থেকে সাইনবোর্ড পর্যন্ত আটটি স্পটে টায়ার জ্বালিয়ে অবস্থান নেয় হেফাজতের নেতা-কর্মীরা। এ সময় তারা তিনটি ট্রাক, একটি মাইক্রোবাস ও তিনটি মিনিবাসে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। এ ছাড়া অ্যাম্বুলেন্স, সংবাদ মাধ্যমের গাড়িসহ অর্ধ শতাধিক যানবাহন ভাঙচুর করা হয়। বিকালে সিদ্ধিরগঞ্জের আকাশে র‌্যাবের হেলিকপ্টারকে কয়েকবার চক্কর দিতে দেখা গেছে। মহাসড়কে নামে বিজিবি ও পুলিশের সাঁজোয়া যান এবং জলকামান। সন্ধ্যা ৬টার দিকে বিজিবি, র‌্যাব ও পুলিশ যৌথ অ্যাকশনে গিয়ে মহাসড়কে যানবাহন চলাচল শুরু করলে হরতাল সমর্থকরা তিনটি যানবাহনে আগুন দিলে পুনরায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

ময়মনসিংহে গুলি, অগ্নিসংযোগ : হরতাল চলাকালীন ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের চুরখাই এলাকায় বেরিকেড দিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর চালিয়েছে হরতাল সমর্থকরা। এ সময় এনা ও শৌখিন সার্ভিসের প্রায় ২৫টি বাসসহ অন্যান্য যানবাহন ভাঙচুর করা হয়। খবর পেয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থল পৌঁছে টিয়ার শেল ও শটগানের গুলি ছুড়ে অবরোধকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এ সময় আফরান (৫৫), ইয়াসিন (২৫), আহাদ (২৩), শাকিল (১৯), আলাল মিয়া (২১) নামে পাঁচজন গুলিবিদ্ধ হন। তাদের ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি ফিরোজ তালুকদার জানান, যানমালের নিরাপত্তার স্বার্থে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ৩৮ রাউন্ড টিয়ার শেল ও শটগানের গুলি ছোড়া হয়েছে। বেরিকেডের কারণে প্রায় দুই ঘণ্টা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ ছিল। দুপুরে নগরীর চরপাড়া এলাকায় হরতালকারীদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। জেলার অন্য কোথাও অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। নগরীর বেশিরভাগ দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংক-বীমাসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠান খোলা ছিল। এদিকে ময়মনসিংহের ফুলপুওে বেলা ১১টায় হরতাল সমর্থনকারীরা মিছিল নিয়ে বের হলে বাসস্ট্যান্ড এলাকায় পুলিশ বাধা দেয়। পরে বিক্ষোভকারীরা সংক্ষিপ্ত বক্তব্য ও দোয়া করে কর্মসূচি শেষ করেন।

মুন্সীগঞ্জ : মুন্সীগঞ্জের সিরাজদীখান উপজেলার কয়েকটি স্থানে হেফাজতের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়েছে। এতে সিরাজদীখান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এসএম জালাল উদ্দিন গুরুতর আহত হয়েছেন। তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তার মাথায় ৩১টি সেলাই দেওয়া হয়েছে বলে চিকিৎসকদের বরাত দিয়ে পুলিশ জানিয়েছে। এ ছাড়াও সংঘর্ষের সময় আহত পরিদর্শক (তদন্ত) মো. কামরুজ্জামান ও পুলিশ কনস্টেবল শাহিন একই হাসপাতালে ভর্তি আছেন। সংঘর্ষে হেফাজত কর্মীসহ অন্তত ৫০ জন আহত হয়েছেন। এ সময় তিনটি মোটরসাইকেলে আগুন, বেশ কয়েকটি দোকান ও অটোরিকশা ভাঙচুর করে হরতালকারীরা। পরিদর্শক (তদন্ত) মো. কামরুজ্জামান চিকিৎসাধীন অবস্থায় মোবাইলে বলেন, গতকাল দুপুরে হরতালে পিকেটিং করতে হেফাজত নেতা আবদুল হামিদ মধুপুরীর নেতৃত্বে পাঁচ শতাধিক নেতা-কর্মী লাঠিসোঁটা নিয়ে নিমতলা এক্সপ্রেসওয়েতে এসে অবরোধ করে। তাদের রাস্তা ছেড়ে দিতে বললে ইটপাটকেল ও লাঠিসোঁটা নিয়ে পুলিশের ওপর হামলা চালায়। টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। সংঘর্ষে থানার ওসি ও আমিসহ বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। হেফাজতে ইসলামের সিরাজদীখান উপজেলা সভাপতি মাওলানা মোহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ কাশেমী জানান, হেফাজতের অনেক নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন। তারা বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। জেলা পুলিশ সুপার আবদুল মোমেন পিপিএম জানান, ওসিসহ চার-পাঁচজন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। ওসি গুরুতর আহত। মধুপুর পীর আল্লামা আবদুল হামিদের আহতের খবরটি নিয়ে গুজব না ছড়ানোর আহ্বান জানান এসপি।

কিশোরগঞ্জ : কিশোরগঞ্জে জেলা আওয়ামী লীগ অফিসে ভাঙচুর চালিয়েছে হরতাল সমর্থকরা। তাদের ছোড়া ইটপাটকেলের আঘাতে ১০ পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাসহ অন্তত ২৫ জন আহত হয়েছেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বেলা সোয়া ১২টার দিকে পুরানথানার মোড় থেকে হরতালকারীরা মিছিল সহকারে জেলা আওয়ামী লীগ অফিসে হামলা চালায়। তারা অফিসের চেয়ার, টেবিল ভাঙচুর করে। বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার ছবিসহ অন্য নেতাদের ছবিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ সময় লাঠি হাতে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা।

পুলিশ সুপার মাশরুকুর রহমান খালেদ বিপিএম (বার) এর নেতৃত্বে বিপুল সংখ্যক পুলিশ শটগানের গুলি ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করলে হামলাকারীরা পিছু হটে। পরে পুলিশের পাশাপাশি বিজিবি ও র‌্যাব মোতায়েন করা হয়। প্রায় তিন ঘণ্টাব্যাপী ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা চলে।

রাজশাহী : মহানগরীর ট্রাক টার্মিনালে রাখা দুটি বিআরটিসি বাসে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। গতকাল সকাল সাড়ে ৬টার দিকে মহানগরীর আমচত্বর এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। পরে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন। এর আগেই একটি বাস পুরোপুরি ও অপর বাসটি আংশিক পুড়ে যায়। নগরীর শাহ মখদুম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাইফুল ইসলাম খান বলেন, হরতালের নামে নাশকতা সৃষ্টি করতেই এই আগুন দেওয়া হয়েছে কি না তা নিশ্চিত নই। আগুনের খবর পেয়েই আমরা ঘটনাস্থলে যাই। আমরা বাসের আশপাশে কাউকে দেখিনি। কীভাবে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটল সেটি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।

হবিগঞ্জ : হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জে পুলিশের দুটি মোটরসাইকেল আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে পিকেটাররা। এ সময় হরতাল সমর্থকদের হামলায় আজমিরীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি নুরুল ইসলামসহ ছয়জন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। ওসি নুরুল ইসলাম জানান, বানিয়াচং-আজমিরীগঞ্জ সড়কে হঠাৎ করে একদল লোক আমাকে বহনকারী পুলিশের একটি পিকআপে হামলা চালায় এবং দুটি মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। এদিকে গত শনিবার হবিগঞ্জ শহরের শায়েস্তানগরে পুলিশ ও বিএনপির অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষে পুলিশের আট সদস্য আহত হওয়ার ঘটনায় জেলা যুবদল সভাপতি মো. ইলিয়াছকে প্রধান আসামি করে ২৩ জনের নাম উল্লেখসহ ৪০০ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। ছয়জনকে গ্রেফতার দেখিয়ে গতকাল আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়।

ফেনী : হরতালকারীরা গতকাল সকালে শহরের শহীদ শহিদুল্যাহ কায়সার সড়কে অবস্থিত পুলিশ ফাঁড়ির সামনে থেকে মিছিল বের করে শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে জহিরিয়া মসজিদের সামনে এসে শেষ হয়। সেখানে সড়কে যান চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে পিকেটিং করে তারা। পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

নরসিংদী : হেফাজতে ইসলামের ডাকা হরতাল চলাকালীন গতকাল বেলা ১১টার দিকে কয়েকশ হেফাজতে ইসলাম কর্মী ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ভেলানগর জেলখানার মোড়ে অবস্থান নেয়। এতে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় একটি গাড়ি ভাঙচুর করে হেফাজত কর্মীরা। এ ছাড়া বেলা ১২টার দিকে শহরের বিভিন্ন সড়কে বিক্ষোভ করে হেফাজত কর্মীরা।

হরতালের পক্ষে-বিপক্ষে বিক্ষোভ

বগুড়া : হরতালের পক্ষে-বিপক্ষে বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে বগুড়ার নন্দীগ্রামে যুবদল-ছাত্রলীগের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় পুলিশ ছাত্রদলের দুই কর্মীকে আটক করেছে। গতকাল বিকালে পৌর শহরের মাজগ্রাম এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। আটকরা হলেন- উপজেলা ছাত্রদলের কর্মী জুয়েল হোসেন (৩০) ও রবিউল ইসলাম (২৮)। নরসিংদীতে পুলিশকে কলা খাওয়ালেন হেফাজত কর্মীরা :  নরসিংদীতে হেফাজতে ইসলামের ডাকা সকাল-সন্ধ্যা হরতাল চলাকালে পুলিশ সদস্যদের কলা খাইয়েছেন হেফাজত কর্মীরা। ছবিটি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরছে। সকালে নরসিংদীর সড়কগুলোতে গণপরিবহন চলাচল কিছুটা স্বাভাবিক থাকলেও বেলা ১১টার দিকে কয়েকশ হেফাজত কর্মী ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ভেলানগর জেলখানার মোড়ে অবস্থান নিয়ে সড়ক অবরোধ করে। এতে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে যানচলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় একটি অ্যাম্বুলেন্স ভাঙচুর করে হেফাজত কর্মীরা। একপর্যায়ে হেফাজতে ইসলামের কর্মীরা নিরাপত্তা দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যদের কলা এগিয়ে দেন। পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে হেফাজত কর্মীদের সঙ্গে কথা বলার পর বেলা ১২টার দিকে সড়ক থেকে অবরোধ উঠিয়ে নেয় তারা। সিলেট : দিনভর হরতালে সিলেটে হেফাজত নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের সংঘর্ষ হয়েছে। গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে কোর্ট পয়েন্ট এলাকায় হরতাল সমর্থকরা পিকেটিংকালে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা মিছিল নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলে উত্তেজনা দেখা দেয়। একপর্যায়ে উভয় পক্ষের মধ্যে শুরু হয় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ। এতে অন্তত পাঁচজন আহত হন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ লাঠিচার্জ করে ঘটনাস্থল থেকে হরতাল সমর্থক পাঁচজনকে আটক করে। এদিকে, গতকাল ফজরের নামাজের পর সিলেটে রাস্তায় নামেন হেফাজতের নেতা-কর্মীরা। ভোর থেকে তারা মহানগরীর বিভিন্ন রাস্তায় পিকেটিং শুরু করেন এবং পথে পথে চলা যানবাহন আটকে দেন। হরতালের কারণে গতকাল সকালে সিলেট থেকে ছেড়ে যায়নি দূরপাল্লার কোনো বাস।

কুমিল্লা : হরতালে মহাসড়কের কুমিল্লা অংশে যান চলাচল কম ছিল। দুপুর পর্যন্ত কুমিল্লা থেকে দূরপাল্লার বাস ছেড়ে যায়নি। জেলার চান্দিনা ও দাউদকান্দিতে হরতালের পক্ষে মিছিল করে হেফাজত। নগরীতে হরতালের বিপক্ষে বিক্ষোভ করে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠন। কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। হরতালের প্রভাব পড়েনি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর