বৃহস্পতিবার, ১ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ, সংকট বাড়ছে হাসপাতালে

আইসিইউ নিয়ে হাহাকার - সাধারণ শয্যায়ও চাপ বাড়ছে

জয়শ্রী ভাদুড়ী

‘গতকাল ২৪ মার্চের নাইট ডিউটি ছিল মুগদা হাসপাতালের আমার কভিড ডিউটির ভয়ংকরতম রাত ওয়ার্ডে পা দিয়েই একটা ডেড বডি। অবিরাম রোগী আসছে শ্বাসকষ্ট নিয়ে। বেশিরভাগ রোগীর ফুসফুস ৩০-৬০ শতাংশ আক্রান্ত। অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৭০ থেকে ৮০ শতাংশে ওঠানামা করছে। আইসিইউতে অবিরাম কল যাচ্ছে কিন্তু ১৪ বেডের আইসিইউ খালি হচ্ছে না। পঁচিশটা আইসিইউ কল পেন্ডিং। রোগীর অ্যাটেনডেন্টের অসহায় আর্তনাদে রাতের বাতাস ভারী। তাদের কাকুতি মিনতি যত টাকা লাগে ডক্টর একটা আইসিইউ দেন। তাদের কাছে উল্টো ক্ষমা চাই। আমাদের অক্ষমতা আমাদের অশ্রু কেউ দেখে না। ভোরের দিকে আবার মৃত্যু।’ রাজধানীর মুগদা জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. সাইয়েদা নাজিয়া করোনা সংক্রমণের শুরু থেকে কভিড ওয়ার্ডে দায়িত্বে পালন করেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিনিময় করা এই চিকিৎসকের অভিজ্ঞতার মতো অন্য হাসপাতালগুলোর পরিস্থিতিও একই। করোনার সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতিতে সংকট বাড়ছে হাসপাতালে। আইসিইউ নেই, মিলছে না সাধারণ শয্যাও। প্রতিদিনই সংক্রমণ ছাড়িয়ে যাচ্ছে পুরনো পরিসংখ্যানকে। বাড়ছে প্রাণহানি। হাসপাতাল বাধ্য হচ্ছে রোগী ফিরিয়ে দিতে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি সূত্রে জানা যায়, গতকাল করোনা শনাক্ত হয়েছেন ৫ হাজার ৩৫৮ জন, মারা গেছেন ৫২ জন। সংক্রমণ হার ছিল ১৯ দশমিক ৯০ শতাংশ। গত মঙ্গলবার শনাক্ত হয়েছিল ৫ হাজার ৪২ জন, মারা গেছেন ৪৫ জন। সংক্রমণ হার ছিল ১৮ দশমিক ৯৪ শতাংশ। গত সোমবার ছিল ৫ হাজার ১৮১ জন, মারা গেছেন ৪৫ জন। সংক্রমণ হার ছিল ১৮ দশমিক ৩৮ শতাংশ। ইতিমধ্যে রাজধানীর কভিড হাসপাতালগুলোর আইসিইউ (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট) শয্যা প্রায় শেষ। সাধারণ শয্যার সংখ্যাও পূর্ণ হতে চলেছে। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ধারণ ক্ষমতার চেয়ে ১৪৬ জন রোগী বেশি ভর্তি আছেন। এ হারে রোগী বাড়লে আগামী দু-এক দিনের মধ্যে কভিড ডেডিকেটেড সব হাসপাতালের শয্যা পূর্ণ হয়ে যাবে। এই তিন দিনেই ১৫ হাজারের বেশি মানুষ করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। এর বিপরীতে দেশের হাসপাতালগুলোতে সাধারণ শয্যা রয়েছে মোট ৯ হাজার ৯১১টি এবং আইসিইউ রয়েছে ৫৭৮টি।

গতকাল কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে ১৬৯ শয্যার বিপরীতে রোগী ভর্তি ছিল ১২৯ জন। এক সপ্তাহ ধরে আইসিউ শয্যা ফাঁকা নেই হাসপাতালটিতে। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ২৭৫ শয্যাটি। রোগী ভর্তি রয়েছেন ৪২১ জন, আইসিইউ শয্যা ফাঁকা নেই। শেখ রাসেল গ্যাসট্রোলিভার হাসপাতালে ১৪০ শয্যার মধ্যে রোগী ভর্তি রয়েছে ৯৩টিতে, হাসপাতালে দুটি আইসিউ ফাঁকা ছিল। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৮৮৩ শয্যার বিপরীতে রোগী ভর্তি রয়েছে ৬৭৫ জন, আইসিইউ ফাঁকা নেই হাসপাতালে। মুগদা জেনারেল হাসপাতালে ৩১০ শয্যার বিপরীতে রোগী ভর্তি রয়েছেন ২৯৮ জন, আইসিইউ ফাঁকা আছে একটি। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৫০ শয্যার মধ্যে রোগী ভর্তি রয়েছে ১১০টিতে। এই হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য আইসিইউয়ের ব্যবস্থা নেই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৩৪ শয্যার মধ্যে রোগী ভর্তি রয়েছেন ১৮৫ জন, আইসিইউ ফাঁকা নেই হাসপাতালে। রাজধানীর সরকারি হাসপাতালে গতকাল পর্যন্ত সাধারণ শয্যা ফাঁকা ছিল ২৬৫টি এবং আইসিইউ ফাঁকা ছিল পাঁচটি। বেসরকারি হাসপাতালের মধ্যে আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে শয্যা ফাঁকা ছিল ১১৭টি, আইসিইউ ফাঁকা ছিল আটটি, আসগর আলী হাসপাতালে শয্যা ফাঁকা ছিল ১২৮টি, আইসিইউ ফাঁকা ছিল আটটি, স্কয়ার হাসপাতালে ৬৫ শয্যার মধ্যে গতকাল পর্যন্ত ফাঁকা ছিল সাতটি, আইসিইউ ফাঁকা ছিল সাতটি। ইবনে সিনা হাসপাতালে শয্যা ফাঁকা ছিল একটি, আইসিইউ ফাঁকা একটি। ইউনাইটেড হাসপাতালে ৮০টি শয্যার মধ্যে ফাঁকা ছিল ১৩টি, আইসিইউ ফাঁকা ছিল সাতটি। এভারকেয়ার হাসপাতালে ২৮টি শয্যার মধ্যে ২৭টিতেই রোগী ভর্তি ছিল, আইসিইউ ফাঁকা নেই। ইম্পালস হাসপাতালে শয্যা ফাঁকা ছিল ১১২টি, আইসিইউ ফাঁকা ছিল নয়টি, বাংলাদেশ স্পেশালাইড হাসপাতালে সাধারণ শয্যা ফাঁকা নেই, আইসিইউ ফাঁকা ছিল পাঁচটি। রাজধানীর বেসরকারি হাসপাতালে মোট শয্যা ফাঁকা ছিল ৩৮১টি এবং আইসিইউ ফাঁকা ছিল ৪৫টি। সারা দেশে সাধারণ শয্যা ফাঁকা ছিল ৫ হাজার ৯৩৯টি, আইসিইউ ফাঁকা ছিল ২০২টি। এ ব্যাপারে কভিড-১৯ বিয়ষক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, নাগরিকদের ব্যক্তিগত সুরক্ষার দিকে নজর দিতে হবে। মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। প্রশাসন ও নাগরিকদের সমন্বিত সচেতনতা ছাড়া করোনা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না। স্বাস্থ্যবিধি মানার পাশাপাশি টিকা নিতে হবে। শুধু এক দিন দেশের এক জায়গায় অভিযান চালালে হবে না। করোনা ছড়িয়ে পড়েছে দেশের কোনায় কোনায়। এ জন্য সারা দেশব্যাপী সচেতনতা বাড়াতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, চিকিৎসকসহ সব পেশার মানুষদের এগিয়ে আসতে হবে। দেশে এক দিনে ৫২ জন মানুষ মারা গেছে। এটা গুরুতর বিষয়। বাস, ট্রেন, গণপরিবহনে স্ক্রিনিং চালাতে হবে। চারদিক থেকে একযোগে কর্মসূচি নিলে করোনা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর