শুক্রবার, ২ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

আবার ঘরবন্দী রাজনীতি

ঘরের বাইরে সভা সমাবেশ বন্ধ আওয়ামী লীগের । সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক কার্যক্রম স্থগিত বিএনপির । নির্ভরতা বাড়ছে জুম ভিডিও বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে

মাহমুদ আজহার ও রফিকুল ইসলাম রনি

আবার ঘরবন্দী রাজনীতি

করোনা পরিস্থিতি কমতে শুরু করায় নতুন বছরের শুরুর দিকে রাজনীতি আবার মাঠে গড়ায়। ঢাকাসহ সারা দেশেই উত্তাপ ছড়ায় রাজনীতি। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য দল ঘর গোছানোসহ সারা দেশেই সভা-সমাবেশ ও দিবসভিত্তিক কর্মসূচি পালন শুরু করে। এরই মধ্যে করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। আবারও ঘরবন্দী হয়ে যাচ্ছে রাজনীতি। এরই মধ্যে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক কর্মকান্ড স্থগিত করেছে।  অন্যান্য দলও অঘোষিতভাবে কর্মসূচি সংকুচিত করেছে।

২০২০ সালে মাঠের রাজনীতির চিরচেনা উত্তাপ ছিল না। নিরুত্তাপ রাজনীতির মধ্যে বছরের শেষে ভাস্কর্য নির্মাণ নিয়ে কওমি মাদরাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম রাজনীতিতে উত্তাপ সৃষ্টি করে। এই ইস্যুতে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলো রাজপথে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখালেও বিএনপি ছিল ‘কৌশলী অবস্থানে’। এরপর রাজনীতি আবার মাঠে গড়ায়। স্থানীয় সরকার নির্বাচন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনসহ কয়েকটি উপনির্বাচনে তৃণমূলে উত্তাপ ছড়ায়। জাতীয় প্রেস ক্লাবে বিএনপির একাধিক কর্মসূচিতে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে সংঘাতময় হয়ে ওঠে রাজনীতি।

সর্বশেষ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকে ঘিরে রাজনীতিতে উত্তাপ ছড়ায়। তার ঢাকা সফর ঠেকাতে মরিয়া হয়ে ওঠে হেফাজত। কয়েকটি এলাকায় হেফাজতে ইসলাম, পুলিশসহ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। ঠিক এই মুহূর্তে করোনা পরিস্থিতি ভিন্নমাত্রায় রূপ নেয়।

সুশাসনের জন্য নাগরিক সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘করোনা দিন দিন আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছেই। এখন সরকারের কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার পাশাপাশি ব্যক্তি সচেতনতাও বাড়াতে হবে। আমি মনে করি, দেশে তো এখন কোনো রাজনীতিও নেই। মানুষের ভোটের অধিকার বা কথা বলার অধিকার নেই। এ মুহূর্তে রাজনীতির সময়ও নয়। তাছাড়া এখন রাজনীতি হওয়া উচিত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর। কিন্তু করোনাকালে রাজনৈতিক দলগুলো যতটা মুখে বলে, ততটা মানুষের পাশে দাঁড়ায়নি। প্রচলিত রাজনীতিতে সাধারণ মানুষও ক্ষুব্ধ। তাই করোনা থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে বাংলাদেশের রাজনীতিতেও গুণগত পরিবর্তন আনা জরুরি।’ করোনাকালেও রাজনীতিতে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য বন্ধ থাকেনি। প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি একে অপরের সমালোচনায় ছিল মুখর। আওয়ামী লীগের বক্তব্যের বড় অংশই ছিল বিগত সময়ে বিএনপির কর্মকান্ডের সমালোচনা। অন্যদিকে বিএনপির বক্তব্যে সরকারের ‘দুর্নীতি, অনিয়ম, ভোটে কারচুপি, করোনাকালে স্বাস্থ্য খাতের অব্যবস্থাপনা, গণতন্ত্রহীনতা’র কথা এসেছে ঘুরেফিরে। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে জাতীয় পার্টি, গণফোরাম, নাগরিক ঐক্য, জাসদ, বাসদ, সিপিবি, ওয়ার্কার্স পার্টির প্রকাশ্য কর্মকান্ড ছিল। এরমধ্যে বাম দলগুলো প্রায় প্রতিনিয়তই জাতীয় প্রেস ক্লাবকেন্দ্রিক সভা-সমাবেশ কর্মসূচি পালন করে। এখন প্রায় সব দলই কর্মসূচি ঘুটিয়ে নিয়েছে।

ঘরের বাইরে সভা-সমাবেশ বন্ধ আওয়ামী লীগের : করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাওয়ায় সব ধরনের কর্মসূচি স্থগিত করেছে আওয়ামী লীগ। এরমধ্যে জেলা-উপজেলা সম্মেলন, কর্মিসভা, বর্ধিত সভাও বন্ধ করা হচ্ছে। ঘরোয়া রাজনীতি ও মানবিক কর্মসূচি নিয়ে দলীয় নেতা-কর্মীকে জনগণের পাশে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে সরকারের ১৮ দফা নির্দেশনা মেনে চলতেও নির্দেশনা রয়েছে। আপাতত আগামী দুই মাস পর্যন্ত জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন পর্যায়ের সব সম্মেলন কার্যক্রম স্থগিত রাখা হয়েছে। দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা যারা তৃণমূলের সম্মেলনসহ সাংগঠনিক কার্যক্রম দেখাশোনার দায়িত্বে রয়েছেন তাদের এই নির্দেশ দিয়েছেন। 

আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, দলের ৭৮টি সাংগঠনিক জেলার ৩২টিতে সম্মেলন     অনুযায়ী তারা তৃণমূল সম্মেলন আপাতত স্থগিত রাখতে বলেছেন। তবে এর মধ্যে মানবিক কার্যক্রম যেমন- স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী, শীতবস্ত্র বিতরণের মতো কার্যক্রম চালানো হবে। করোনার প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ায় গত মঙ্গলবার আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, রাজধানীসহ সারা দেশে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর কোনো কার্যক্রম বাইরে করা যাবে না। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত আকারে ঘরোয়াভাবে দলীয় কার্যক্রম চালাতে হবে। একই সঙ্গে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় সরকারের দেওয়া ১৮ দফা নির্দেশনা মেনে চলতে দেশের সর্বস্তরের জনগণের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আওয়ামী লীগ মানুষের সংগঠন। রাজনীতি ঘরবন্দী নয়, রাজনৈতিক কর্মসূচি থাকবে তবে সীমিত আকারে। দ্বিতীয় ঢেউ কীভাবে মোকাবিলা করা যায় এবং মানুষের পাশে থাকা যায় আমরা সেই পরিকল্পনা করছি। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, করোনার প্রকোপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা জনসমাগম এড়িয়ে চলতে দলীয় নেতা-কর্মীদের নির্দেশনা দিয়েছি। সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক কার্যক্রম স্থগিত বিএনপির  : সারা দেশে করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে নেতা-কর্মী-সমর্থক-জনগণের স্বাস্থ্য নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় রেখে দলের নেতা-কর্মীদের জনসমাগম ঘটে এরকম ‘রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক’ কার্যক্রম আপাতত স্থগিত করেছে বিএনপি। বুধবার দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত হয় বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এরপর বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনগুলোর দেশব্যাপী বিক্ষোভ কর্মসূচিগুলো স্থগিত হয়ে যায়। দলের কেন্দ্রীয় দফতরের দায়িত্বে থাকা সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সরকারের উদাসীনতার ফলশ্রুতিতে কভিড-১৯ করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি দ্রুত অবনতির প্রেক্ষিতে জনগণ এবং দলীয় নেতা-কর্মী, সমর্থকদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা বিবেচনায় জনগণ, নেতা-কর্মী-সমর্থকদের সমাগম ঘটে বিএনপির এ ধরনের রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কার্যক্রম আপাতত স্থগিত করা হলো। বিজ্ঞপ্তিতে মোবাইল, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, অ্যাপস ব্যবহারের মাধ্যমে নেতা-কর্মীদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ রক্ষা করবে বলে বলা হয়। নেতা-কর্মী-সমর্থকদের প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে না যাওয়া, সার্বক্ষণিক মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করা এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য আহ্বানও জানানো হয় সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে। গত ২৪ মার্চ বিএনপি করোনার ব্যাপক বিস্তারে দলের স্বাধীনতা সুবর্ণজয়ন্তীর সব অনুষ্ঠান ৩০ মার্চ পর্যন্ত স্থগিত করে। এর আগে গত বছরের মার্চে করোনা সংক্রমণের প্রাদুর্ভাব হলে বিএনপির সাংগঠনিক কার্যক্রম স্থগিত রাখা হয়েছিল কয়েক মাস। এ প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, করোনার প্রকোপ দিন দিন বেড়েই চলছে। এটা সরকারের উদাসীনতা ও ব্যর্থতা। দেশের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসেবে আমরা এখন দলীয় কর্মসূচিগুলো সাময়িকভাবে স্থগিত রেখেছি। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবারও রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কর্মকান্ড স্বাভাবিকভাবেই চলবে।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর