শুক্রবার, ২ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

কী হয়েছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়

১৮ মামলা, ২০ হাজার আসামি, দেড় শ বছরের প্রাচীনতম পৌরসভার ব্যাপক ক্ষতি

মোশাররফ হোসেন বেলাল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হেফাজতে ইসলামের ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন সর্বত্র। নারকীয় তা-বে এখনো চারদিকে পোড়া গন্ধ। দর্শনার্থীদের চোখ গড়িয়ে পড়ছে জল। অনেকের প্রশ্ন- রবিবার কী হয়েছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়? হেফাজতের হামলায় কয়েক শ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে ধারণা। দেড় শ বছরের প্রাচীন ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভার সবকিছু আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। হরতালের সময় দা, হকিস্টিকসহ দেশি অস্ত্র দেখা গেছে। জিন্স প্যান্ট ও টি-শার্ট পরা যুবকরাও এতে অংশ নেন। হেফাজতে ইসলামের পাশাপাশি একটি ‘বিশেষ গোষ্ঠী’ও হরতালের সময় যোগ দেয়। লাঠিসোঁটা হাতে দেখা যায় শিশুদেরও।

সাধারণ মানুষকে যাদের নিরাপত্তা দেওয়ার কথা সেই পুলিশও ছিল আত্মরক্ষায় ব্যস্ত। তবে হেফাজতের হামলায় এক শর বেশি পুলিশ আহত হয়েছেন। গতকাল পর্যন্ত ১৮টি মামলা হয়েছে। এতে ২০ হাজার আসামি করা হয়েছে। আর ভীতি কাটিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার চেষ্টা করছে মানুষ।

আত্মরক্ষায় ব্যস্ত ছিল পুলিশ? হেফাজতের হামলার সময় পুলিশ আত্মরক্ষায় ব্যস্ত ছিল বলে তথ্য পাওয়া যায়। হরতালের দিন হামলা হয় পুলিশ লাইনস, সদর থানা, সরাইল খাঁটিহাতা হাইওয়ে থানা ও টোল প্লাজায় পুলিশ ক্যাম্পে। এসব প্রতিষ্ঠানে হামলার সময় পুলিশ প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ওই সময়ই হতাহতের ঘটনা ঘটে। এর বাইরে পুলিশ প্রতিরোধ গড়ে তোলেনি বলে অভিযোগ অনেকের। একাধিক সূত্র জানান, পুলিশ লাইনস ও সদর থানায় হামলা হলে পুলিশ আত্মরক্ষার কৌশল নেয়। শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল পালনের আহ্বান জানিয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘আপনারা আমাদের ওপর হামলা করবেন না। আমরাও আপনাদের হরতাল পালনে বাধা দেব না।’ সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন সংগীতাঙ্গনের সামনে দায়িত্বরত বিজিবির এক সদস্যও হরতালের দিন পুলিশের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ আনেন। বলেন, ‘আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করলেও আন্দোলনকারীদের দমনে পুলিশের ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ।’ তবে পুলিশের এক পরিদর্শক এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। সোমবার ঘটনাস্থল পরিদর্শনের সময় পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘পুলিশ সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করেছে।’ চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার এ বি এম আজাদ জানান, প্রশাসন কৌশল অনুযায়ী সঠিক দায়িত্ব পালন করেছে।

ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভা : ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীদের তিন দিনের তান্ডবে পৌরসভার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভা ১৫০ বছরের প্রাচীনতম একটি পৌরসভা। পৌরসভা ভবনে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগে দ্বিতীয় তলায় মেয়র, সচিব, হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা, প্রধান সহকারী কর্মকর্তা, ক্যাশিয়ারের কক্ষসহ বিভিন্ন কক্ষের আসবাবপত্র, নথিপত্র, পৌরসভার ইতিহাস-ঐতিহ্য, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির রেজিস্টারসহ সবকিছু ভস্মীভূত হয়েছে। পৌরসভার এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, শনিবার বঙ্গবন্ধু স্কয়ারস্থ বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল তিনটি, মুক্তমঞ্চের গ্রানাইট পাথর/বৈদ্যুতিক ৫০টি খুঁটি, বাল্ব ২০টি, বঙ্গবন্ধু স্কয়ারের ফোয়ারাতে বৈদ্যুতিক ২এইচপি সাবমার্সিবল পাম্প নয়টি, পৌরসভার মূল চার তলা ভবন, পৌরভবনের আসবাবপত্র, ২০টি স্টিলের আলমারি, ২৫টি কাঠের আলমারি, ১৮টি ডেস্কটপ কম্পিউটার, পাঁচটি ল্যাপটপ, চারটি ফটোকপি মেশিন, ৩৪টি টেবিল, সাতটি সেক্রেটারিয়েট টেবিল, ১১৫টি চেয়ার, পাঁচটি এসি, স্বাস্থ্য শাখার ১২টি ডিপ ফ্রিজ, চারটি সাধারণ ফ্রিজ, ভ্যাকসিন, ২০টি সিলিং ফ্যান, স্টোরে রক্ষিত ১০ হাজার এলইডি বাতি, ৫ শতাধিক এলইডি টিউবলাইট, ৩ হাজার বাতিশেড, ৫০ কয়েল বৈদ্যুতিক তার, মশক নিধনের পাঁচটি ফগার মেশিন, গ্যারেজে রক্ষিত সাতটি গাড়ি, আটটি মোটরসাইকেল, দুটি গার্বেজ ট্রাক, একটি ইকুইপমেন্ট চেইন ডোজার, তিনটি রোড রোলার, একটি মশক নিধন গাড়ি, একটি হাইড্রোলিক বিম লিফটার, একটি ভেকুটেক, একটি এক্সাভেটর, একটি হাইড্রোলিক ড্রিলিং মেশিন, দুটি ঘাস কাটার মেশিন, তিনটি মিক্সার মেশিন, দুটি ভাইব্রেটর, ৩ শতক পোর্টেবল মোবাইল ডাস্টবিন, ২০০ পোর্টেবল হ্যান্ড ট্রলি, ২০টি রিকশা ভ্যানসহ রক্ষিত যানবাহনের খুচরা যন্ত্রাংশ, সংরক্ষক শাখার রক্ষিত মালামাল, রক্ষিত স্টেশনারি মালামাল, প্ল্যান অনুমোদনসংক্রান্ত পে-অর্ডার নথিসহ বিভিন্ন মালামাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ পৌর মিলনায়তনের মূল ভবন একটি, ৫৫০টি হলরুমের চেয়ার, ২০ সেট সোফা, ৩০টি এসি, ১৫০টি সিলিং ফ্যানসহ অন্যান্য মালামাল লুটপাট, ভাঙচুর ও আগুনের শিকার হয়।

১৮ মামলায় আসামি ২০ হাজার : ২৬ থেকে ২৮ মার্চ হেফাজতে ইসলামের তান্ডবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এখন পর্যন্ত ১৮টি মামলা হয়েছে। আসামি করা হয়েছে অন্তত ২০ হাজার জনকে। এর মধ্যে এজাহারভুক্ত আসামি ১০৭ জন। তবে তাদের নাম জানা যায়নি। পুলিশ এখন পর্যন্ত গ্রেফতার করেছে ২১ জনকে। এর মধ্যে সদর মডেল থানায় ১৮ ও আশুগঞ্জ থানায় তিনজন গ্রেফতার হয়েছেন। তবে তাদের পরিচয় জানা যায়নি। তান্ডবের মামলায় নতুন করে আর কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। জেলা পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) ডিআইও-১ ইমতিয়াজ আহম্মেদ জানান, গ্রেফতার অভিযান অব্যাহত আছে। পুলিশসূত্রে জানা যায়, হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনায় সদর থানায় ১৫, আশুগঞ্জ থানায় দুই ও সরাইল থানায় একটি মামলা হয়েছে। এদিকে আজ জেলার সব কটি মসজিদ থেকে একযোগে মিছিল বের করার কর্মসূচি দেওয়ায় শহরের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। বাড়তি ১ হাজার পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাব, এপিবিএন মোতায়েন করা হচ্ছে। জেলার এসপি আনিছুর রহমান এ তথ্য জানিয়েছেন।

অক্ষত নেই কোনো ভূমি অফিসের কাগজ : সদর উপজেলা ভূমি অফিসের একটি কাগজও রক্ষা পায়নি হেফাজতিদের দেওয়া আগুনের লেলিহান শিখা থেকে। সেখানকার হামলা পরিকল্পিত বলেই ধারণা পাওয়া যায় প্রত্যক্ষদর্শী ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে। তারা জানান, ওই অফিসে ঢুকে প্রথমেই সিসি ক্যামেরা ভেঙে ফেলা হয়। পরে পানির লাইন কেটে ফেলা হয় যেন আগুন নেভানোর কাজে ব্যবহার না করা যায়। সহকারী কমিশনার (ভূমি) এ বি এম মশিউজ্জামান বলেন, অফিসের একটি কাগজও অক্ষত নেই। এখানে জমিসংক্রান্ত অনেক রেকর্ড থাকে। যে কারণে সাধারণ মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হবে। আপাতত ওই অফিসের সেবা বন্ধ রাখা হয়েছে বলে তিনি জানান।

হামলায় প্যান্ট-শার্ট পরা লোকজন : ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিভিন্ন সময় হওয়া হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনে আন্দোলনকারীদের হাতে সাধারণত লাঠিসোঁটা দেখা যায়। দাড়ি, টুপি পরা লোকজনই সাধারণত ওই আন্দোলনে অংশ নেয়। তবে রবিবারের হরতালের সময় দা, হকিস্টিকসহ দেশি অস্ত্র দেখা গেছে। জিন্স প্যান্ট ও টি-শার্ট পরা যুবকরাও এতে অংশ নেন। হেফাজতে ইসলামের পাশাপাশি একটি ‘বিশেষ গোষ্ঠী’ও হরতালের সময় যোগ দেয়। লাঠিসোঁটা হাতে দেখা যায় শিশুদেরও।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর