শিরোনাম
শনিবার, ৩ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

সবখানেই সমন্বয়হীনতা

মানা হচ্ছে না জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির নির্দেশনা । গাড়ি না বাড়িয়েই অর্ধেক যাত্রী পরিবহনের নির্দেশনায় ভোগান্তিতে মানুষ । বন্ধ হয়নি সভা-সমাবেশ, বইমেলাসহ সামাজিক অনুষ্ঠান । নেওয়া হলো মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা

মাহমুদ আজহার, রফিকুল ইসলাম রনি ও জয়শ্রী ভাদুড়ী

সবখানেই সমন্বয়হীনতা

মেডিকেল পরীক্ষার্থীরা ভিতরে আর বাইরে এভাবেই অভিভাবকদের ভিড়। ছবিটি রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে থেকে গতকাল তোলা -বাংলাদেশ প্রতিদিন

দেশে দ্রুত বাড়তে থাকা করোনাভাইরাসের প্রকোপ রোধে অবিলম্বে বইমেলা, সামাজিক অনুষ্ঠান, বিনোদন কেন্দ্রসহ যে কোনো ধরনের সমাবেশ বন্ধে সুপারিশ করেছে কভিড-১৯বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি। সব ক্ষেত্রেই কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শও দেয় তারা। কিন্তু বাস্তবতা হলো, চলছে বইমেলা। বন্ধ হয়নি সামাজিক আচার অনুষ্ঠানও। হাটবাজার, অফিস-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান চলছে আগের মতোই। কোথাও বালাই নেই স্বাস্থ্যবিধির। পর্যাপ্ত গাড়ির ব্যবস্থা না করেই অর্ধেক যাত্রী পরিবহনের নির্দেশনায় ভোগান্তিতে সাধারণ মানুষ। এ নিয়ে রাজধানীতে ভোগান্তিতে পড়া মানুষের চলছে বিক্ষোভ।

সরকারি চাকরির পরীক্ষাও চলছে। গতকাল মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষাও হয়েছে যথারীতি। পরীক্ষা কেন্দ্রে ছাত্রছাত্রী, অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্ট সবার ভিড়ে উপেক্ষিত স্বাস্থ্যবিধি। অধিকাংশ মানুষের মুখে ছিল না মাস্ক। গতকাল রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচিতেও মানা হয়নি স্বাস্থ্যবিধি। সবখানেই সমন্বয়হীনতা। মানা হচ্ছে না জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির নির্দেশনা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে নাজেহাল গোটা দেশ। প্রতিদিনই আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। হাসপাতালগুলোয় আইসিসিইউর তীব্র সংকট। দ্বিতীয় ঢেউ সামাল দিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ১৮ দফা নির্দেশনা জারি করেছে। সেগুলো বাস্তবায়নের সঙ্গে অনেক মন্ত্রণালয় জড়িত। কিছু মন্ত্রণালয় কাজ করছে। আর কিছু মন্ত্রণালয় এখনো চিন্তা করছে কী করা যায়। সরকারের বিভিন্ন দফতরে চাকরির পরীক্ষা নিয়েও চলছে যাচ্ছেতাই। কোনো কোনো মন্ত্রণালয় বা অধিদফতর পরীক্ষা বাতিল করেছে। আবার কোনো কোনোটি পরীক্ষা গ্রহণ করছে। গত বৃহস্পতিবার জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লা স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, রোগ প্রতিরোধের জন্য অবিলম্বে সামাজিক অনুষ্ঠান, বিনোদন কেন্দ্র, বইমেলা ও অন্যান্য মেলা বন্ধ করা দরকার। একই সঙ্গে পরিবহনে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, মাস্ক পরার বিষয়ে ইতিমধ্যে যেসব নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সেসব যাতে পালন করা হয় তার ব্যবস্থা নিতে হবে। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানগুলোয় স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে নির্দেশনা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকার সম্প্রতি যে ১৮ দফা নির্দেশনা জারি করেছে তা কার্যকরের জন্য বাস্তবায়ন কর্মসূচি বা প্রস্তুতির জন্যও সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা প্রয়োজন বলে এ কমিটি মনে করছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এবারের ভাইরাসের সংক্রমণের সামর্থ্য বেশি এবং দ্রুত রোগীর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটছে। শনাক্ত হয়নি এমন সংক্রমিত ব্যক্তি অনেক বেশি ঘুরে বেড়ানোর কারণে এবার একই পরিবারে ছয়-সাত জন করে আক্রান্তের খবর বেশি শোনা যাচ্ছে। সংক্রমণ দ্রুত বাড়ছে। এখন শুধু স্বাস্থ্যবিধি মেনে সংক্রমণের হার নিচে নামানো যাবে না। এখন শুধু স্বাস্থ্যবিধি মেনে এটি মোকাবিলা করা যাবে না। আরও দেড় মাস আগে যদি স্বাস্থ্যবিধি মানার ওপর জোর দেওয়া হতো তাহলে হয়তো আজকের পরিস্থিতি হতো না। এখন ঢাকা, চট্টগ্রাম, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, মৌলভীবাজার এ পাঁচটি শহরে ১৪ দিনের কারফিউ জারি করে সারা দেশ থেকে আইসোলেটেড করতে হবে।’ রাজধানীর কাঁচাবাজার, বিপণিবিতান, শপিং মল, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসহ সামাজিক আচার অনুষ্ঠান চলছে স্বাভাবিক নিয়মেই। বাড্ডা-শাহজাদপুরের দুটি কাঁচাবাজার ঘুরে দেখা গেছে শত শত মানুষ বাজারে আসছে কেনাকাটা করতে। সবারই গাছাড়া ভাব। অধিকাংশের মুখেই ছিল না মাস্ক। কারও মুখে মাস্ক থাকলেও তা ছিল থুতনিতে। বিক্রেতাদের মুখে মাস্কের বালাই ছিল না। স্বাস্থ্যবিধি পাত্তাই পায়নি এসব কাঁচাবাজারে। গতকাল রাজধানীর বায়তুল মোকাররমের সামনে হেফাজতে ইসলামের হাজার হাজার নেতা-কর্মীর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। তাদের অনেকের মুখেই ছিল না মাস্ক। এরই মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছে কয়েকটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষা। আজও সমাজসেবা অধিদফতরের একটি পদে পরীক্ষা হবে।

মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় উপেক্ষা স্বাস্থ্যবিধি : গতকাল রাজধানীসহ দেশের ১৯ পরীক্ষা কেন্দ্রের ৫৫ ভেন্যুতে অনুষ্ঠিত হয়েছে সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের এমবিবিএস প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষা। কিন্তু পরীক্ষা কেন্দ্রে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থী আর অভিভাবকদের উপস্থিতিতে উধাও স্বাস্থ্যবিধি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রের মূল ফটকের ছোট গেট খোলা থাকায় বের হওয়ার সময় পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকদের এমন ভিড় দেখা যায়। পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মুখে মাস্ক ছিল, তবে ছিল না সামাজিক দূরত্ব। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নয়, দেশের বিভিন্ন স্থানে আগে ও পরে পরীক্ষা কেন্দ্রের বাইরে পরীক্ষার্থী-অভিভাবকদের প্রচন্ড ভিড় দেখা গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মধুর ক্যানটিন-সংলগ্ন প্রধান গেটটি বন্ধ রেখে শুধু পকেট গেট খোলা রাখা হয়। পরীক্ষা শেষে পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সরু পকেট গেট দিয়ে ঠেলাঠেলি করে বের হতে দেখা গেছে। কয়েকজন অভিভাবক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, কর্তৃপক্ষ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কথা বললেও কোনো ব্যবস্থা নেননি। কোনো ধরনের স্বাস্থ্যসচেতনতামূলক পদক্ষেপ নেননি। প্রধান গেটটি খোলা থাকলেও বের হওয়ার সময় এতটা গাদাগাদি হতো না। রাজধানীর বকশীবাজারে বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ কেন্দ্রের বাইরেও প্রচন্ড ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় অভিভাবকদের। পরীক্ষা কেন্দ্রের ভিতরে প্রবেশের সময় পরীক্ষার্থীদের হাত ধোয়া বা স্যানিটাইজ করাতে দেখা যায়নি। শুধু তাপমাত্রা পরীক্ষা করা হয়েছে। তবে পরীক্ষা কেন্দ্রের ভিতরে শিক্ষকদের হাতে এক বোতল করে স্যানিটাইজার দেওয়া ছিল। লম্বা বেঞ্চের দুই প্রান্তে দুজন করে পরীক্ষার্থীকে বসানো হয়েছিল। পলাশীর উদয়ন উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের বাইরেও পরীক্ষা শুরুর আগে-পরে পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকদের প্রচন্ড ভিড় ছিল। চট্টগ্রাম কলেজ ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ভেন্যুতে গিয়ে দেখা যায় প্রচন্ড ভিড় করে কেন্দ্রের বাইরে অবস্থান করছেন অভিভাবকরা। রাজশাহীর সাতটি কেন্দ্রে মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। শিক্ষার্থীদের কেন্দ্রে প্রবেশ এবং বের হওয়ার সময় সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত হয়নি। পরীক্ষা শুরুর আগে-পরে কেন্দ্রে কেন্দ্রে দেখা গেছে শিক্ষার্থীদের ভিড়। বরিশা?লেও বিভিন্ন পরীক্ষা কেন্দ্রে ছিল একই চিত্র। স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই ছিল না।

রাজধানীতে কর্মজীবী মানুষের ভোগান্তি : করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবিলায় সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী গণপরিবহনে ধারণক্ষমতার অর্ধেক যাত্রী নেওয়া হচ্ছে। এতে গত তিন দিন ধরে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে রাজধানীবাসীকে। বিশেষ করে অফিসগামী যাত্রীরা চরম বিপদে পড়েছেন। রাইড শেয়ারিং সার্ভিস বা মোটরসাইকেলে দুজন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় কর্মজীবী মানুষের দুর্ভোগের অন্ত নেই। এখনো সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, শপিং মলসহ সবই খোলা। অফিসে অর্ধেক জনবলে কাজ করার সিদ্ধান্তও বাস্তবায়ন হয়নি। তাই চাকরিজীবীদের কর্মস্থলে যেতে হচ্ছে। কিন্তু বাসে বেশি যাত্রী না নেওয়ায় তাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হচ্ছে। বাসে উঠতে না পেরে রাজধানীর কয়েকটি স্থানেই অনেক যাত্রী সড়ক আটকে বিক্ষোভ করেন। আবার অনেককে বাসে ওঠার আপ্রাণ চেষ্টা করতে দেখা গেছে। অগত্যা উঠতে না পেরে কেউ কেউ হেঁটে কর্মস্থলে যাচ্ছেন। কেউ কেউ বাস না পেয়ে রিকশায় করে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে কর্মস্থলে গেছেন। ঢাকার কর্মজীবী মানুষের ভোগান্তি এখন চরমে। এদিকে চলমান করোনা পরিস্থিতিতে গতকাল দুই সপ্তাহের জন্য রাইড শেয়ারিং সার্ভিসের মাধ্যমে মোটরসাইকেলে যাত্রী পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। এর পরিপ্রেক্ষিতেই রাইড শেয়ারিং সার্ভিসের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করা মোটরসাইকেল চালকরা চরম বিপদে পড়েছেন। রাইড শেয়ারিং অনেকের জীবিকার প্রধান উৎস। রাইড শেয়ারিং সার্ভিসের মাধ্যমে মোটরসাইকেলে যাত্রী পরিবহনে নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে গত বুধ ও বৃহস্পতিবার রাজধানীর প্রেস ক্লাব, পল্টন, যাত্রাবাড়ী, ধানমন্ডিসহ বেশ কিছু এলাকায় বিক্ষোভ করেন কয়েক শ মোটরসাইকেল চালক।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর