সোমবার, ৫ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

খেটে খাওয়া মানুষের কী হবে

জীবন-জীবিকা দুটোই রক্ষার পক্ষে বিশেষজ্ঞরা

মাহমুদ আজহার ও জয়শ্রী ভাদুড়ী

রাজধানীর মহাখালীর সাততলা বস্তিতে থাকেন রং মিস্ত্রি জসিম মিয়া। গত বছরের লকডাউনে কাজ হারিয়ে বেকার ছিলেন বেশ কিছু দিন। ওই সময় তিন সন্তান ও স্ত্রীকে গ্রামের বাড়ি কুড়িগ্রামে পাঠিয়ে দেন তিনি। অনাহারে-অর্ধাহারে দিন পার হয়েছে তার। সেপ্টেম্বরে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে পরিবারকে নিয়ে আসেন ঢাকায়। কর্মহীন সময়ের বিভিন্ন জায়গার ধারদেনা শোধ করে আর্থিক ক্ষতি কিছুটা কাটিয়ে উঠছিলেন তিনি। এর মধ্যেই ফের এলো লকডাউনের ঘোষণা। সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায় তার। বাসা ভাড়া বাকি রেখেই বউ-বাচ্চাদের নিয়ে গতকাল গ্রামের বাড়ি রওনা হন তিনি।

গাবতলী বাস টার্মিনালে কুড়িগ্রামগামী গাড়িতে কম ভাড়ায় যাওয়ার জন্য দরকষাকষি করছিলেন বাসের সুপারভাইজারের সঙ্গে। এসময় আলাপচারিতায় বাংলাদেশ প্রতিদিনকে তিনি বলেন, ঢাকায় কবে ফিরতে পারব জানি না। গ্রামে অন্তত বাসা ভাড়া তো দিতে হয় না। কীভাবে উপার্জন করব, বউ-সন্তানদের খাবার জোগাড় করব কিছুই বুঝতে পারছি না।

বাংলাদেশে প্রথম দফা লকডাউনে গুলশান এলাকায় একটি অভিজাত হোটেলের চাকরি হারিয়েছেন দিনাজপুরের সবুজ-শাহরিয়ার দুই ভাই। কাজের আশায় ঢাকায় বেশ কিছু দিন চেষ্টা করেছেন। একপর্যায়ে সবকিছু স্বাভাবিক হলে তারা নিজেরাই শাহজাদপুর সুবাস্তু টাওয়ার সংলগ্ন মহাসড়কে ভ্যানে করে কাপড় বিক্রি শুরু করেন। মোটামুটি ভালোই চলছিল। গ্রামে থাকা তাদের পরিবারকে কিছু টাকাও পাঠাতেন। হঠাৎ নতুন করে আজ থেকে লকডাউনের ঘোষণায় তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ। গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানালেন, দোকান বন্ধ থাকলে একদিনও তাদের চলা সম্ভব নয়। দৈনন্দিন খাওয়া-দাওয়াসহ সব খরচের ভরসা ভ্যানের ওই দোকান। ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গতকালই তারা দিনাজপুরের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন।

শুধু জসিম মিয়া,  সবুজ বা শাহরিয়ারই নন, তাদের মতো নিম্ন আয়ের লাখ লাখ মানুষ লকডাউনে বিপাকে পড়েছেন। যাত্রীবাহী পরিবহন বন্ধ হওয়ায় রিকশা, বাস, ট্রাক, সিএনজি, লঞ্চের চালক, রং মিস্ত্রি, ফুটপাথের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বিশেষ করে চা, পান বিক্রেতা, হকার, কাঠমিস্ত্রিসহ নিম্নবিত্ত মানুষের দুর্দশার শেষ নেই। এদের প্রায় সবাই দিন আনে দিন খায়। অনেকেই কোনো পথ খুঁজে না পেয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে গ্রামের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়ছেন। শ্যামলী বাস কাউন্টারে কাজ করেন পঞ্চগড়ের বিপ্লব হোসেন। বছিলা এলাকায় সাবলেটে স্ত্রী-কন্যা নিয়ে থাকেন তিনি। কাউন্টারে টিকিট বিক্রি করেই চলে তার জীবন-জীবিকা। লকডাউনে বাস বন্ধের ঘোষণায় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তিনি। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, গতকাল রাতেই তিনি সপরিবারে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হয়েছেন। বাস চলাচল শুরু হলে ঢাকায় ফিরবেন। বাড়িতে বেকার সময় কীভাবে কাটাবেন তা নিয়েও চিন্তার শেষ নেই বিপ্লবের। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, করোনা সংক্রমণ বাড়তে থাকায় দেশের অর্থনীতির ওপর এমনিতেই ছিল বাড়তি চাপ। লকডাউনের ঘোষণায় সেই চাপ আরও বহুগুণ বেড়ে যাবে। চায়ের দোকানদার থেকে শুরু করে মাঝারি আয়ের ব্যবসায়ীরা চরম বিপাকে পড়বেন। নতুন করে লকডাউনের কারণে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি হারানোর আশঙ্কা রয়েছে। গেল বছর করোনার আঘাত সামাল দিতে না দিতেই আবার এ ধরনের ধাক্কা দেশের অর্থনীতির জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। জীবন-জীবিকা দুটোই রক্ষা করতে হবে। এ ব্যাপারে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে ভাবতে হবে।  

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. জামাল উদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সাত দিন পরে সংক্রমণ বিবেচনা করে যদি লকডাউন খুলে দেওয়া হয় তাহলে ঠিক আছে। নয়তো তাদের জীবন-জীবিকা অচল হয়ে পড়বে। গত বছর লকডাউনের কারণে অনেকে পেশা পরিবর্তন করেছেন। বড় প্রতিষ্ঠান কর্মী ছাঁটাই করেছে, বেতন কমিয়েছে। বন্ধ হয়েছে ইনক্রিমেন্ট, প্রমোশন। অসংখ্য মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। তাই অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সরকার স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নিতে পারে। অসহায়, ছিন্নমূল, নিম্নবিত্ত, হতদরিদ্র মানুষদের জন্য সহায়তামূলক কর্মসূচি নিতে পারে। খেটে খাওয়া এই মানুষকে জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে সহায়তা করতে পারে সরকার। আর্থিক সহায়তা করতে ব্যবহার করা যেতে পারে তাদের মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট। এই করোনা মহামারী থেকে জীবন রক্ষার পাশাপাশি মানুষের জীবিকা রক্ষার কথা ভেবে যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

এক জরিপের তথ্য অনুযায়ী, করোনাভাইরাস সংক্রমণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে সার্বিক দারিদ্র্যের হার বেড়ে হয়েছে ৪২ শতাংশ। ২০১৮ সালে এটি ছিল ২১.৬ শতাংশ। শহরাঞ্চলে সার্বিক দারিদ্র্যের হার ২০১৮ সালে ছিল ১৬.৩ শতাংশ, যা করোনাকালে ২০২০ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫.৪ শতাংশে। ২০১৮ সালে গ্রামাঞ্চলে চরম দারিদ্র্যের হার ছিল ১১.২ শতাংশ। মহামারীর সময়ে ২০২০ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৩৩.২ শতাংশ। ২০১৮ সালে শহরাঞ্চলে চরম দারিদ্র্যের হার ছিল ৬.১ শতাংশ, যা ২০২০ সালে বেড়ে হয়েছে ১৯ শতাংশ। অন্যদিকে জাতীয় পর্যায়ে গড় মাথাপিছু স্বাস্থ্য ব্যয় বেড়েছে মধ্যম দরিদ্রদের ৯৭ শতাংশ এবং অতিদরিদ্রদের ক্ষেত্রে ১০৪ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপে দেখা গেছে, পরিবারভিত্তিক মাসিক আয় প্রায় ৪ হাজার টাকা কমে সাড়ে ১৫ হাজার টাকা হয়েছে। বেকারত্ব ১০ গুণ বেড়েছে। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, লকডাউন ঘোষণা করে আমাদের সব দোকান বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আমরা সরকারের কাছে অনুরোধ করেছিলাম অন্তত চার ঘণ্টা পাইকারি দোকান খোলার অনুমোদন দেওয়ার জন্য। কিন্তু তা না দিয়ে শুধু অনলাইনে ব্যবসা চালাতে বলা হয়েছে। দোকান না খুললে পণ্য ডেলিভারি দেব কীভাবে আমরা? তিনি বলেন, আমরা ভীষণ হতাশ। গতবারের দীর্ঘ লকডাউনে আমরা নিঃস্ব হয়েছি কিন্তু একটা টাকা প্রণোদনা পাইনি। এবার মনে হয় আর বাঁচতে পারব না।

সর্বশেষ খবর