বুধবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা
আহমদ শফীর মৃত্যু

পিবিআইর তদন্ত প্রতিবেদনে যা আছে

মুহাম্মদ সেলিম, চট্টগ্রাম

হেফাজতে ইসলামের মুমূর্ষু আমির আল্লামা আহমদ শফীকে হাসপাতালে নেওয়ার চেষ্টা দেখে এক নম্বর বিবাদী নাসির উদ্দিন বলেছিলেন ‘বুড়ো ভং ধরেছে...।’ পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)-এর তদন্ত প্রতিবেদনে এ তথ্য পাওয়া যায়। আদালতে দাখিল করা ওই প্রতিবেদনে হত্যার পরিকল্পনা থেকে শুরু করে আল্লামা শফীর মৃত্যু পর্যন্ত যাবতীয় ঘটনার বিশদ বিবরণ রয়েছে। তবে ঘটনার অন্যতম অভিযুক্ত ও হেফাজতের আমির জুনায়েদ বাবুনগরী প্রতিবেদনকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মন্তব্য করেছেন।  গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে বাবুনগরী বলেন, ‘আল্লামা শফীর মৃত্যু নিয়ে পিবিআই যে প্রতিবেদন দিয়েছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। বাস্তবতাবিবর্জিত। এ ঘটনার পুনরায় নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করছি।’

আদালতসূত্রে জানা যায়, আল্লামা শফী হত্যা মামলার তদন্তভার পাওয়ার পর দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসা, ফটিকছড়িসহ বিভিন্ন জায়গায় পরিদর্শনে যান তদন্তকারী সংস্থা পিবিআইর কর্মকর্তারা। এ সময় তারা ২২ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন। ২১ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। আদালতে দেওয়া পিবিআইর প্রতিবেদনে বলা হয়, বিবাদীদের কয়েকজন ২০২০ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ফটিকছড়ির বাবুনগরে গোপন বৈঠক করে হত্যা পরিকল্পনা করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৬ সেপ্টেম্বর কিছু উচ্ছৃঙ্খল লোক হাটহাজারী মাদরাসায় আল্লামা শফী ও তাঁর ছেলে মাওলানা আনাস মাদানির বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়। তারা বিভিন্ন উগ্র ধর্মীয় ভাষা ব্যবহার করে গালিগালাজ করে। ঘটনার প্রথম দিন বিবাদী মাওলানা নাসির উদ্দিন মুনির ও ৩ নম্বর বিবাদী মীর ইদ্রিসের নেতৃত্বে সাত থেকে আট জনের দল আহমদ শফীর কক্ষে প্রবেশ করে। তখন আল্লামা আহমদ শফী তাদের ভদ্র ও শান্তিপূর্ণভাবে কথা বলার অনুরোধ করলে নাসির ধমকের সুরে বলেন, ‘তুই হচ্ছিস বুড়ো শয়তান, তুই মরবি না? তুই সরকারের দালাল।’ তারা আল্লামা আহমদ শফীকে সরকারের দালাল ও আনাস মাদানিকে হেফাজতে ইসলামের শত্রু বলে হাটহাজারী মাদরাসার শিক্ষা পরিচালকের পদ থেকে পদত্যাগ করতে বলেন। এ পদে আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীকে নিয়োগ দিতে চাপ দেন। তখন ১২ নম্বর বিবাদী নজরুল ইসলাম আল্লামা শফীর নাতি আসাদের গলায় ভাঙা গ্লাসের টুকরা ধরে বলেন, প্যাডে স্বাক্ষর না করলে এক টান মেরে গলা কেটে ফেলব। ১ নম্বর বিবাদী নাসির আল্লামা শফীর দিকে তেড়ে যান। বসে থাকা চেয়ারে লাথি মারেন এবং নাকের অক্সিজেনের লাইন টান দিয়ে খুলে ফেলেন। এতে আল্লামা শাহ আহমদ শফী অজ্ঞান হয়ে পড়েন। ১৭ সেপ্টেম্বর কয়েকজন দেশি অস্ত্র ও লাঠিসোঁটা নিয়ে জড়ো হয়ে মাদরাসার পাগলা ঘণ্টা বাজিয়ে দেয়। আল্লামা শফীর কার্যালয়ে এবং মাদরাসায় অবস্থিত অন্যান্য কক্ষ ভাঙচুর ও লুট করে। দুই দিনের ঘটনায় আল্লামা আহমদ শফী হতভম্ব হয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে অক্সিজেন লাগানোর জন্য বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে বলা হলে আসামিরা আগে পদত্যাগ করার জন্য বলেন। সময়মতো অক্সিজেন সংযোগ না পাওয়ায় আল্লাম শফী কোমায় চলে যান। তাঁকে হাসপাতালে নেওয়ার চেষ্টা করা হলে নাসির বলেন, ‘বুড়ো ভং ধরেছে, শালার মৃত্যু নাই। বুড়োকে হাসপাতালে নিতে হলে আমিরের অনুমতি লাগবে। আমিরের অনুমতি ছাড়া এখান থেকে কেউ বের হতে পারবে না।’ তখন আল্লামা আহমদ শফীর নাতি ও খাদেমরা অনেক কান্নাকাটি করে তাঁকে হাসপাতালে নেওয়ার অনুরোধ করলে বিবাদী নাসির আমিরের আদেশ নিয়ে জানাবেন বলে বের হয়ে যান। কিছুক্ষণ পর আসামি নাসির এসে জানান, আল্লামা আহমদ শফীর সঙ্গে শুধু একজন যেতে পারবেন, তবে মোবাইল নেওয়া যাবে না। আহমদ শফীকে নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা হলে গেট থেকে বের হওয়ামাত্রই রাস্তায় আহমদ শফীকে বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সটি আটকে দেওয়া হয়। পরে তাঁকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে এলে কর্তব্যরত চিকিৎসক জানান, রোগী কোমায় চলে গেছেন, তাঁকে আনতে এত দেরি করলেন কেন?

প্রসঙ্গত, গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর মৃত্যু হয় আল্লামা শফীর। তাঁর মৃত্যুর পর থেকে শফী অনুসারীরা দাবি করে আসছেন পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে শীর্ষ এ আলেমকে। এ ঘটনায় ২৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেন আল্লামা শফীর শ্যালক মোহাম্মদ মঈনুদ্দীন।

সর্বশেষ খবর