শনিবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

পুরান ঢাকার কেমিক্যাল গুদামে আগুন

নিহত ৪, দগ্ধ ২২ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক, তদন্তে চার সদস্যের কমিটি

নিজস্ব প্রতিবেদক

পুরান ঢাকার কেমিক্যাল গুদামে আগুন

আগুন নেভাতে ব্যস্ত দুই ফায়ার সার্ভিস কর্মী -বাংলাদেশ প্রতিদিন

দুই বছরের মাথায় আবারও ভয়াবহ অগ্নিকান্ড ঘটেছে পুরান ঢাকায়। গতকাল ভোরে আরমানিটোলায় কেমিক্যাল গুদামে লাগা আগুনে চারজন নিহত হয়েছেন। দগ্ধ হয়েছেন অন্তত ২২ জন। আরমানিটোলার ভয়াবহ ওই আগুনে শুধু আরমানিয়ান স্ট্রিটে মুসা ম্যানশন নামে ভবনটিই পোড়েনি, পুড়ে গেছে সাজানো একটি পরিবার। ইডেন মহিলা কলেজের ইংরেজি তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সুমাইয়া পরিবারের সঙ্গে ভবনটির চতুর্থ তলায় থাকতেন। কেমিক্যালের আগুনে দম বন্ধ হয়ে মারা যান তিনি। তার বাবা ইব্রাহিম, মা সুফিয়া, নবদম্পতি বোন মুনা ও দুলাভাই আশিক এবং ছোট ভাই জুনায়েদের অবস্থাও সংকটাপন্ন। তারা শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভুগছেন মৃত্যু যন্ত্রণায়।

সুমাইয়া ছাড়াও ওই আগুনের ঘটনায় আরও তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। তারা হলেন- ভবনের কেয়ারটেকার রাসেল মিয়া, সিকিউরিটি গার্ড ওলিউল্লাহ ব্যাপারী ও তার আত্মীয় কবির। দগ্ধ প্রত্যেকের শ্বাসনালি পুড়ে গেছে বলে জানিয়েছেন বার্ন ইনস্টিটিউটের চিকিৎসকরা। দগ্ধদের মধ্যে চারজন আইসিইউতে চিকিৎসাধীন।

আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার পর গতকাল বিকালে জেলা প্রশাসনের নির্দেশে বংশাল থানা পুলিশের সহযোগিতায় মুসা ম্যানশনের নিচতলায় মজুদ কেমিক্যাল সাতটি পিকআপে করে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। কেমিক্যালগুলো ধ্বংসের জন্য মাতুয়াইলে সিটি করপোরেশনের ল্যান্ড ফিল্ডে নেওয়া হয়। পরে ছয়তলা ভবনটি সিলগালা করে দেয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। রাসায়নিক অপসারণ কার্যক্রম তদারকিতে নেতৃত্ব দেন ডিএসসিসির অঞ্চল-৪ এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মো. হায়দার আলী। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ছয়তলা বাড়ির নিচ তলায় ১২টি রাসায়নিক দোকান এবং গুদাম ছিল। এসব পরিচালনায় সিটি করপোরেশনের ট্রেড লাইসেন্স, ফায়ার সার্ভিস ও বিস্ফোরক পরিদফতরের ছাড়পত্র ছিল না। এখনো গুদাম এবং দোকানগুলোতে কীভাবে অগ্নিকান্ড ঘটেছে, তা জানা যায়নি। ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়েছে। তবে ঝুঁকি এড়াতে ওই ভবনের দোকান এবং গুদাম থেকে রাসায়নিকগুলো অপসারণ করা হয়েছে। এসব রাসায়নিক মাতুয়াইলে ডিএসসিসির ল্যান্ড ফিল্ডে পুঁতে ফেলা হবে। আগুনের ঘটনায় গত রাত ৯টায় বংশাল থানায় পুলিশ বাদী হয়ে হাজী মুসা ম্যানশন ভবনের মালিক ও কেমিক্যাল গোডাউনের মালিকের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। মামলার বিষয়টি জানিয়ে বংশাল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহিন ফকির বলেন, অবহেলাজনিত কারণে মৃত্যু, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ক্ষুণ্ন ও দাহ্য পদার্থ রাখার কারণে মামলাটি করা হয়। এদিকে হাজী মুসা ম্যানশন পরিদর্শন করেছেন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) কর্মকর্তারা। পরিদর্শন শেষে সংস্থাটি জানায়, আগুনের সূত্রপাত কেমিক্যাল গোডাউন থেকে হতে পারে। এর আগে ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের চুড়িহাট্টার কাজী ওয়াহেদ ম্যানশনে কেমিক্যাল গুদামে আগুন লাগে। তারও নয় বছর আগে ২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলীতে কেমিক্যাল গুদামে আগুন লেগেছিল। গতকাল পুলিশ জানায়, কেমিক্যালের গুদাম থেকে মুসা ম্যানশনে আগুন লাগতে পারে। ওই ভবনের নিচতলার মার্কেটে ১৬ থেকে ২০টি দোকান রয়েছে। এসব দোকানে কেমিক্যাল পণ্য কেনাবেচা হতো। আর ভবনের নিচতলার পেছনের দিকের একটি গুদাম থেকে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে। তবে ফায়ার সার্ভিস কিংবা ঢাকা জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা আগুনের উৎস নিয়ে সুস্পষ্ট কিছু বলেননি। সরেজমিন দেখা গেছে, ভবনটির নিচতলার ছয়টি দোকান আগুনে প্রায় পুরোটাই পুড়ে গেছে। ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক লে. কর্নেল জিল্লুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ভবনের বাসিন্দাদের জানালার গ্রিল কেটে বের করে আনা হয়েছে। কোথা থেকে আগুনের সূত্রপাত তা তদন্ত করে দেখা হবে। ঘটনা তদন্তে চার সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি ১০-১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেবে। এ ঘটনায় আমাদের চারজন কর্মী আহত হয়েছেন। ওই চারজনকে রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে বলে জানা গেছে। ঢাকার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ভাস্কর দেবনাথ জানান, শিল্প মন্ত্রণালয়ের একটি দল পরীক্ষা করে দেখবে রাসায়নিক থেকে আগুন লেগেছে কি না এবং ভবনের দোকানগুলোয় এ ধরনের পদার্থ আছে কি না। আগুন লাগার আর কোনো ঝুঁকি আছে কি না। ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা যায়, ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায় ভবনের নিচতলা। ধীরে ধীরে ধোঁয়া উঠতে থাকে ওপরের দিকে। ওপরতলার বাসিন্দারা আগুনের বিষয়টি টের পেয়ে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করলেও ধোঁয়া ও আগুনের কারণে বের হতে পারেননি। তারা ওপরের দিকে উঠতে থাকেন। তবে ভবনের ছাদ তালাবদ্ধ থাকায় কেউ ওপরে উঠতে পারেননি। বিভিন্ন ফ্লোরে আটকে থাকা লোকজন চিৎকার করতে থাকেন। বারান্দা ও জানালা দিয়ে মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। ভোর পৌনে ৫টার দিকে বিভিন্ন ফ্লোর থেকে অন্তত ১৪ জনকে ক্রেন দ্বারা বের করে আনেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। তারা বারান্দার গ্রিল কেটে বাসিন্দাদের উদ্ধার করেন। ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিট তিন ঘণ্টার চেষ্টায় সকাল সাড়ে ৬টার দিকে আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন জানান, সেখানে চিকিৎসাধীন চারজনের শরীরের ২৫ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। তাদের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখা হয়েছে। মুসা ম্যানশনের সামনে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নিহতদের মধ্যে সুমাইয়া আক্তারকে প্রথমে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে মিটফোর্ড হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। ভবনের নিচতলা থেকে উদ্ধার করা হয় কেয়ারটেকার রাসেল মিয়ার লাশ। তার গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার পর ফায়ার সার্ভিস দুজনের মৃত্যুর খবর জানালেও পরে স্বজনরা খোঁজাখুঁজি করে চিলেকোঠা থেকে আরও দুজনের লাশ উদ্ধার করেন। এর একজন ভবনটির সিকিউরিটি গার্ড ওলিউল্লাহ ব্যাপারী ও তার আত্মীয় কবির। আহতদের মধ্যে আছেন- ইব্রাহিম সরকার (৬০), তার স্ত্রী সুফিয়া সরকার (৫০), তাদের ছেলে জুনায়েদ সরকার (২০), বড় মেয়ে ইসরাত জাহান মুনা (৩০), তার স্বামী আশিকুর রহমান (৩৩), মোস্তফা (৪০), ইউনুস মোল্লা (৬০), সাকিব হোসেন (৩০), সাখাওয়াত হোসেন (২৭), সাফায়েত হোসেন (৩৫), চাষমেরা বেগম (৩৩), দেলোয়ার হোসেন (৫৮), আয়সাপা (২), খোরশেদ আলম (৫০), লায়লা বেগম (৫৫), মোহাম্মদ ফারুক (৫৫), মেহেরুন্নেসা (৫০), মিলি (২২), পাবিহা (২৬), আকাশ (২২) ও আসমা সিদ্দিকা (৪৫)। ভবনটির বাসিন্দারা জানান, দ্বিতীয় থেকে ষষ্ঠ তলা পর্যন্ত প্রতিটি ফ্লোরে তিনটি করে ইউনিট। সব মিলিয়ে ভবনটিতে বাসিন্দার সংখ্যা শতাধিক। নিচতলায় কেমিক্যালের মার্কেট ও গুদাম। ছয়তলার বাসিন্দা শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘আগুন লাগার পর আমরা শুরুতে নিচে নামতে পারিনি। ফায়ার সার্ভিস এসে গ্রিল কেটে আমাদের নামিয়েছে।’ এদিকে ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক দেবাশীষ বর্ধন বলেন, ‘এখানে প্রচুর কেমিক্যাল রয়েছে। এগুলো সব অবৈধ কেমিক্যালের দোকান। আমার জানা মতে ফায়ার সার্ভিস এদের কোনো ধরনের লাইসেন্স কিংবা ছাড়পত্র দেয়নি। তবে আমি জানি না সিটি করপোরেশন তাদের ট্রেড লাইসেন্স দিয়েছে কি না।’

বাঁচার জন্য জানালার কাচ ভেঙে চিৎকার করছিলেন বাসিন্দারা : হাজী মুসা ম্যানশনে অগ্নিকান্ডের প্রত্যক্ষদর্শীদের একজন বজলুর রহমান। তিনি হাজী মুসা ম্যানশনের পাশে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এটিএম বুথের সিকিউরিটি গার্ড। তিনি বলেন, ‘এটিএম বুথের দরজা খুলে ভিতরে রেস্ট নিচ্ছিলাম। হঠাৎ আগুন দেখে ভবনটির সামনে গিয়ে দেখি সারা ভবনে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। ভবনে থাকা লোকজন তখন বাঁচার জন্য জানালার কাচ ভেঙে চিৎকার করছিলেন। ভবনের নিচের গেট ভেঙে ভিতরে প্রবেশ করে একজনকে উদ্ধার করি।’

আগুনের তীব্রতায় বাইরে বের হতে পারেননি রাসেল : চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জের ছেলে রাসেল মিয়া আট বছর ধরে হাজী মুসা ম্যানশনের কেয়ারটেকার। থাকতেন ভবনের দ্বিতীয় তলায়। প্রতিদিনের মতো বৃহস্পতিবার রাতে ঘুমাতে যান। ভোরে আগুন লাগে ওই ভবনে। আগুনের তীব্রতায় তিনি বাইরে বেরোতে পারেননি। আগুনে দগ্ধ হয়ে তার মৃত্যু হয়।

উদ্ধার হয় টিয়া পাখি : ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা জানান, মুসা ম্যানশনে সার্চ অ্যান্ড রেসকিউ অভিযানের শেষ দিকে গতকাল সকাল সাড়ে ৭টায় ভবনের দ্বিতীয় তলায় একটি টিয়া পাখির খাঁচা দেখতে পান তারা। এ সময় পাখিটি খাঁচায় ছটফট করছিল। পরে ল্যাডারের মাধ্যমে পাখিটি উদ্ধার করে নিচে নিয়ে আসেন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর