সোমবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

ভয়াবহ বিপদের বার্তা ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট

জয়শ্রী ভাদুড়ী

ভয়াবহ বিপদের বার্তা ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট

ভারতে করোনা সংক্রমণ ভয়াবহ আকার ধারণ করায় এর নতুন ভ্যারিয়েন্টকে দায়ী করা হচ্ছে। একে ভারতীয় কিংবা বেঙ্গল ভ্যারিয়েন্ট নামে ডাকা হচ্ছে। কয়েক গুণ বেশি সংক্রামক ক্ষমতার এই ভ্যারিয়েন্ট দেশে ছড়ালে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরির আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। বিপদের বার্তা দিচ্ছে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট। এ জন্য আজ থেকে ভারতে স্থলপথে চলাচল বন্ধ করেছে সরকার। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন গতকাল গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘ভারতের সঙ্গে স্থলপথ বন্ধের ঘোষণা ১৪ দিনের জন্য বলবৎ থাকবে। এর আগে থেকেই দেশটির সঙ্গে আকাশপথে চলাচল বন্ধ রয়েছে। ভারতে করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় এ সিদ্ধান্ত হয়েছে।’ এই ১৪ দিন মানুষের যাতায়াত বন্ধ থাকলেও পণ্যবাহী যানবাহন চলবে বলে তিনি জানান। এদিকে গত রাতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ২৬ এপ্রিল সকাল ৬টা থেকে ৯ মে বিকাল ৬টা পর্যন্ত স্থলসীমান্ত দিয়ে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে মানুষ চলাচল বন্ধ থাকবে। বাংলাদেশের যেসব নাগরিক চিকিৎসাসহ নানা কাজে ভারতে অবস্থান করছেন এবং যাদের ভিসার মেয়াদ ১৫ দিনের কম আছে, তারা কভিড-১৯ নেগেটিভ সনদ দেখিয়ে নয়াদিল্লি, কলকাতা ও আগরতলার বাংলাদেশ মিশনের অনুমতি নিয়ে বেনাপোল, আখাউড়া এবং বুড়িমারী সীমান্ত দিয়ে দেশে প্রবেশ করতে পারবেন। ভারতীয় পণ্যবাহী গাড়ি বাংলাদেশে প্রবেশের পূর্বে ভালোভাবে জীবাণুমুক্ত করতে হবে। এ সময় পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে রেলপথ ব্যবহারে উৎসাহিত করা হয়েছে। এদিকে বাংলাদেশে অবস্থানরত যেসব ভারতীয় নাগরিকের এই সময়ে নিজ দেশে যাওয়া প্রয়োজন তাদের সব তথ্য ও ভ্রমণ পরিকল্পনা ইমেইলে পাঠানোর জন্য অনুরোধ করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশন। এর মধ্যে এই ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়েছে কি না তা নিয়ে রয়েছে উৎকণ্ঠা। গতকাল বেনাপোল সীমান্তে ভারত থেকে আসা ১২ জনের শরীরে করোনা সংক্রমণ পাওয়া গেছে। তবে কী ধরনের ভ্যারিয়েন্টে তারা আক্রান্ত সে তথ্য পাওয়া যায়নি। ফলে করোনার গতি-প্রকৃতি নির্ণয়ে জিনোম সিকোয়েন্সিং বাড়ানোয় জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। ভারতে করোনাভাইরাসের ‘ডাবল মিউট্যান্ট’ আতঙ্ক কাটতে না কাটতেই সম্প্রতি শোনা যাচ্ছে ‘ট্রিপল মিউট্যান্ট ভ্যারিয়েন্ট’-এর কথা। ইতিমধ্যে পশ্চিমবঙ্গসহ দেশটির অন্তত চারটি রাজ্যে এ ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে। বাকি রাজ্যগুলো হচ্ছে দিল্লি, মহারাষ্ট্র ও ছত্তিশগড়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কভিড-১৯ ভাইরাসের তিনটি আলাদা স্ট্রেইন মিলে তৈরি নতুন এই ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণের ক্ষমতা কয়েক গুণ বেশি। নতুন এই স্ট্রেইনে আক্রান্তদের শারীরিক অবস্থারও দ্রুত অবনতি ঘটছে। ভারতে করোনাভাইরাসের ‘ডাবল মিউট্যান্ট-বি.১.৬১৭’ ধরন শনাক্তের পর থেকেই এ নিয়ে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে। এরই মধ্যে ধরনটি ভারতের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে বলে জানা গেছে। ভাইরাস যত ছড়ায়, তার মিউটেশনের হারও তত বৃদ্ধি পায়। এই নয়া স্ট্রেইনটি শিশুদেরও সংক্রমিত করছে। তবে এখনো পর্যন্ত এই নয়া ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে বিশেষ কোনো তথ্য নেই বিজ্ঞানীদের কাছে। যে কারণে আপাতত ‘ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন’-এর বদলে ‘ভ্যারিয়েন্ট অব ইন্টারেস্ট’-এর তালিকাতেই রাখা হয়েছে এটিকে। যুক্তরাষ্ট্রের লুইসিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটির হেলথ সায়েন্স সেন্টারের ভাইরোলজিস্ট ড. জেরেমি কামিল জানিয়েছেন, ভারতের একটি মিউটেশন, ই৪৮৪কিউ অনেকটা দক্ষিণ আফ্রিকার বা ব্রাজিল ভ্যারিয়েন্টের কাছাকাছি। ড. কামিলের মতে, ভারতে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ের তীব্রতার পেছনে সম্ভবত এই ভ্যারিয়েন্টই ভূমিকা রেখেছে। আগের ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রতি একজনের মৃত্যুর তুলনায় এটিতে মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৬। তবে ড. কামিলের মতে, দ্বিতীয় ঢেউয়ের জন্য মানুষের উদাসীনতাই বেশি দায়ী।

বাংলাদেশে এখনো এই ভ্যারিয়েন্ট রিপোর্টেড হয়েছে বলে জানা যায়নি। কিন্তু যদি চলে আসে তবে সেটা বাংলাদেশের জন্য কী পরিমাণ ঝুঁকির কারণ হবে জানতে চাইলে কভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ভারত থেকে যদি চলেই আসে তবে তা আমাদের জন্য অনেক ঝুঁকির হবে। আর এটা যে আসবেই তা সহজে ধরে নেওয়া যায়। ভারত থেকে আসা যাত্রীদের সর্বোচ্চ কোয়ারেন্টাইনের জন্য টেকনিক্যাল কমিটি সুপারিশ করেছে। কিন্তু আমরা সেটাও করতে ব্যর্থ হয়েছি। এখনই তো সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। সেখানে ওটা কী করে সামাল দেব। আমাদের দেশে যা হবার তা-ই হবে। আমরা কিছু পারিনি, পারবও না।’ রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)-এর উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ভারতের এই ভাইরাস আমাদের দেশে ছড়ানোর সমূহ আশঙ্কা আছে। ভাইরাস মিউটেশন নিয়ে কাজ করছে আইইডিসিআর। আমাদের জিনোম সিকোয়েন্স করা আরও বেশি প্রয়োজন। সরকারিভাবে আইইডিসিআর থেকে জিনোম সিকোয়েন্স করা হচ্ছে। তবে এটা আরও বাড়ানো দরকার। একই সঙ্গে ভারতের ভ্যারিয়েন্টটি সত্যিই বেশি বিপজ্জনক কি না তা এখনো প্রমাণ হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, ভ্যারিয়েন্ট অব ইন্টারেস্ট, অর্থাৎ একে খতিয়ে দেখা হবে। মিউটেশন সার্ভেইলেন্সের দায়িত্ব আইইডিসিআরের- এমনটা জানিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র ও অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, তারা আমাদের এখন পর্যন্ত ডাবল বা ট্রিপল মিউট্যান্ট, ইন্ডিয়ান ভ্যারিয়েন্ট সম্পর্কে জানায়নি। কিন্তু ভারত থেকে এই ভ্যারিয়েন্ট দেশে আসার আশঙ্কা রয়েছে। যেহেতু প্রতিবেশী দেশ। এয়ার ট্রাভেল বন্ধ করার আগেও চলে আসতে পারে। আমাদের এখন কন্টাক্ট ট্রেসিংও হচ্ছে না। তাই দেশে এসেছে কি না সেটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। গত ১৫ এপ্রিল থেকে ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত ১২ জন নভেল করোনাভাইরাস (কভিড ১৯) সংক্রমিত হয়ে ভারত থেকে বেনাপোল ইমিগ্রেশন দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন। তারা ভারতে চিকিৎসা নিতে গিয়েছিলেন। বাংলাদেশ থেকে যাওয়ার সময় তাদের করোনা নেগেটিভ সনদও ছিল। তবে তাদের জিনোম সিকোয়েন্সিং তথ্য পাওয়া যায়নি। সে তথ্য পেলে ভাইরাসের ভ্যারিয়েন্ট জানা যাবে। এখন পর্যন্ত দেশের দুই বিভাগের ৮টি নমুনা পরীক্ষায় এই ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি পাওয়ার তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। ঢাকার উত্তরা, আজিমপুর ক্যান্টনমেন্ট এলাকার পাশাপাশি সিলেটের সুনামগঞ্জ থেকে সংগ্রহ করা নমুনায় এ ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে। তবে এই ভ্যারিয়েন্ট কতটা সংক্রামক, এটি রোগীর জন্য কতটা ক্ষতিকর, সে বিষয়ে প্রাথমিকভাবে তথ্য পাওয়া যায়নি। এদিকে দেশেই প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের নাইজেরিয়ার ভ্যারিয়েন্টের (বি.১.৫২৫) অস্তিত্ব মিলেছে। দেশের দুটি বিভাগ থেকে মার্চ ও এপ্রিল মাসের সংগ্রহ করা নমুনার সিকোয়েন্সিং করে এই ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। গত শনিবার গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অন শেয়ারিং অল ইনফ্লুয়েঞ্জা ডাটার (জিআইএসএইড) ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক গবেষণায় বিষয়টি উঠে এসেছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক গতকাল বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস উপলক্ষে স্বাস্থ্য অধিদফতর কর্তৃক আয়োজিত আলোচনা সভায় ভার্চুয়ালি যোগ দিয়ে বলেছেন, স্বাস্থ্যবিধি মানতে মানুষ অনীহা দেখাচ্ছিল।

পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে ২৫-৩০ লাখ মানুষ স্বাস্থ্যবিধি না মেনেই ভ্রমণ করেছে। অধিক হারে বিয়ে অনুষ্ঠান, পিকনিকসহ নানা রকম সামাজিক অনুষ্ঠান করা হয়েছে। এসব কারণেই করোনার আমাদের দ্বিতীয় ঢেউ চলছে। তিনি আরও বলেন, দিনে প্রায় শত মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। সময়মতো সরকার লকডাউন ঘোষণা করায় এটা কমে যাবে। তবে সচেতন না হলে সামনে আবার করোনার তৃতীয় ঢেউ চলে আসবে। তৃতীয় ঢেউ আরও ভয়াবহ হয়ে দেখা দিতে পারে।

সর্বশেষ খবর