সোমবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

করোনাকালে আত্মোপলব্ধি

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

করোনাকালে আত্মোপলব্ধি

দেশে দেশে করোনা মোকাবিলায়, একে প্রতিরোধ প্রতিষেধকের উদ্দেশ্য অর্জনে প্রকৃত পালনীয় দায়িত্ব ও করণীয় কর্তব্য সম্পর্কে আজ আত্মশুদ্ধির প্রশ্ন উঠে আসছে। সিয়াম সাধনায় আত্মশুদ্ধির চেতনা জাগ্রত হয়। কর্মফলের দ্বারা আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামতের স্থায়িত্বের হ্রাস-বৃদ্ধি প্রসঙ্গে আল কোরআনের সুস্পষ্ট ঘোষণা অনুধাবন করলে আত্মশুদ্ধির চিন্তা-চেতনা পরিশীলিত হতে পারে। অষ্টম সুরা আনফালের ৫৩ নম্বর আয়াতে ঘোষিত হয়েছে ‘যদি কোনো সম্প্রদায় নিজের অবস্থার পরিবর্তন না করে তবে আল্লাহ এমন নন যে, তিনি তাদেরকে যে সম্পদ দান করেন তিনি তা পরিবর্তন করবেন; এবং আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’ ১৩তম সুরা আর রা’দ-এর ১১ নম্বর আয়াতে আরও স্পষ্টভাবে ইরশাদ হয়েছে ‘মানুষের জন্য তার সম্মুখে ও পশ্চাতে একের পর এক প্রহরী থাকে; তারা আল্লাহর আদেশে তার রক্ষণাবেক্ষণ করে। এবং আলাহ কোনো সম্প্রদায়ের অবস্থা পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না তারা নিজ অবস্থা নিজে পরিবর্তন করে। কোনো সম্প্রদায়ের সম্পর্কে যদি আল্লাহ অশুভ কিছু ইচ্ছা করেন তবে তা রদ করবার কেউ নেই এবং তিনি ব্যতীত তাদের কোনো অভিভাবক নেই।’ আল্লাহর নেয়ামত স্থায়িত্বের যে নিয়ম বা মূলনীতি তা হলো কোনো ব্যক্তি বা জাতিকে যে নেয়ামত দান করা হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত তা ফিরিয়ে নেওয়া হয় না, যে পর্যন্ত না নিজের বা নিজেদের অবস্থা ও কার্যকলাপকে পরিবর্তিত করে আল্লাহর আজাবকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। এখানে অবস্থা পরিবর্তনের অর্থ হলো ভালো ও সৎ অবস্থা বা কর্মের পরিবর্তে মন্দ অবস্থা ও কার্যকলাপ অবলম্বন করা কিংবা আল্লাহতায়ালার নেয়ামত আগমনের সময় যেসব মন্দ ও পাপ কাজে লিপ্ত ছিল নেয়ামত প্রাপ্তির পর তার অধিক মন্দ কাজে লিপ্ত হওয়া। নেয়ামত প্রাপ্তির পর তার জন্য শুকরিয়া আদায় করা, সচেতন দায়িত্ব পালনের দ্বারা এর মর্যাদা রক্ষা করা এবং নিজেদের মধ্যে সংশোধনীয় বিষয়গুলোর ব্যাপারে সচেতন হওয়া বাঞ্ছনীয়। কোনো কোনো সময় আল্লাহ তায়ালা তাঁর নেয়ামত এমন কোনো কোনো লোক বা সম্প্রদায়কে দান করেন, যে তার নিজের বা নিজেদের আমল বা কর্মের দ্বারা তার যোগ্য নয়, কিন্তু প্রদত্ত হওয়ার পর যদি সে নিজের আমল বা কর্মধারা সংশোধন করে কল্যাণের দিকে ফেরানোর পরিবর্তে মন্দ কাজের দিকে আরও বেশি উৎসাহী হয়ে পড়ে, তখন প্রদত্ত নেয়ামত তার বা তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়। আল্লাহ মানুষকে বিবেক বুদ্ধি ও ভালোমন্দ জ্ঞানসহ সেরা জীব হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। মানুষের হেফাজতের জন্য আলাহর পক্ষ থেকে ফেরেশতারা পাহারায় নিযুক্ত থাকে। তার প্রিয় বান্দা বিপৎগামী হয়ে তাঁর অনুগ্রহ হতে বঞ্চিত হোক এটা তিনি চান না, তদসত্ত্বেও কেউ সঠিক ও কল্যাণের পরিবর্তে মন্দ ও অভিশপ্ত পথ নির্বাচন এবং তথায় অনড় অবস্থান করলে; আল্লাহর নেয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও তার আনুগত্য ত্যাগ করে কুকর্ম, কুচরিত্র ও অবাধ্যতার পথ বেছে নিলে তার পরিণতি হয় দুঃখজনক। যে গজব নেমে আসে তা থেকে আত্মরক্ষার কোনো উপায় থাকে না। কোনো ব্যক্তি বা জাতির জীবনে কল্যাণকর পরিবর্তন ততক্ষণ পর্যন্ত সূচিত হয় না, যতক্ষণ এই কল্যাণকর পরিবর্তনের জন্য নিজেদের অবস্থা সংশোধন করে নিজেদেরকে তার যোগ্য করে না তোলা হয়। ধন সম্পদের প্রাচুর্যে ভরা আরাম আয়েশ উল্লাস ঐশ্বর্যময় জীবনযাপনে চিরন্তন শান্তি নেই। ভোগে নয় ত্যাগেই মুক্তি। এই উপলব্ধিরও বিকল্প নেই যে কৃচ্ছ্রতা সাধনের মধ্যে রয়েছে স্থায়ী পরিতৃপ্তি ও কল্যাণের নিশ্চয়তা। কোরআনুল করিমে আল্লাহ রব্বুল আলামিন ইরশাদ করেছেন ‘তোমাদের নিকট যা আছে তা নিঃশেষ হবে এবং আল্লাহর নিকট যা আছে তা স্থায়ী। যারা ধৈর্য ধারণ করে আমি নিশ্চয়ই তাদেরকে তারা যা করে তা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ পুরস্কার দান করব। মুমিন হয়ে পুরুষ ও নারীর মধ্যে যে কেউ সৎকর্ম সম্পাদন করবে তাকে আমি নিশ্চয়ই আনন্দময় জীবন দান করব এবং তাদেরকে তাদের কর্মের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার দান করব’ (১৬তম সুরা আন নাহল। আয়াত ৯৬-৯৭)

‘তোমাদের নিকট যা আছে’ তাফসিরকারকগণের মতে, এর মধ্যে পার্থিব ধন সম্পদ অন্তর্ভুক্ত তো আছেই, এ ছাড়া দুনিয়াতে মানুষ আনন্দ-বিষাদ, সুখ-দুঃখ, সুস্থতা-অসুস্থতা, লাভ লোকসান, বন্ধু-শত্র“তা ইত্যাদি যেসব অবস্থার সম্মুখীন হয়, সবই এর মধ্যে পড়ে। বাস্তবিক বিচারে এগুলো সবই ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু এসব অবস্থা ও ব্যাপারের প্রতিক্রিয়া, যার কারণে শেষ বিচারের দিনে সওয়াব কিংবা শাস্তি সাব্যস্ত হবে তার হিসাবে সংরক্ষিত থাকবে। সুতরাং পার্থিব ধন সম্পদ এবং এসব ধ্বংসশীল ও অস্থায়ী অবস্থা ও কাজ কারবারে মগ্ন থাকা এবং জীবন ও জীবনের কর্মক্ষমতা এ ব্যাপারে নিয়োজিত করা বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে না। যে সম্পদ ও বিষয়াবলি ক্ষণস্থায়ী এবং যার স্থায়িত্বের ও ভূমিকার ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ নেই বা থাকবে না তা অর্জনে অবৈধ পন্থা অবলম্বনের দ্বারা পাপাচারে লিপ্ত হওয়া এবং ফলশ্রুতিতে ইহ ও পরকালে শাস্তি ভোগের সম্মুখীন হওয়ার মধ্যে যুক্তি নেই। যে মুমিন ব্যক্তি কোনো সময় আর্থিক অভাব অনটন কিংবা কষ্টের সম্মুখীন হলেও দুটি বিষয় তাকে উদ্বিগ্ন হতে দেয় না (১) অল্পতুষ্টি এবং অনাড়ম্বর জীবন যাপনের অভ্যাস, যা দারিদ্র্যের মাঝেও কেটে যায় (২) এটি এই বিশ্বাসে যে এই অভাব অনটন ও অসুস্থতা, দুর্বিপাক ও দুর্ঘটনার বিষয়গুলো ক্ষণস্থায়ী এবং এর বিনিময়ে পরকালে সুমহান ও চিরস্থায়ী নেয়ামত পাওয়া যাবে। দুনিয়ার মোহে আচ্ছন্ন কাফের ও পাপাচারীর অবস্থা এর বিপরীত।

[লেখক : সাবেক সচিব ও এনবিআরের প্রাক্তন চেয়ারম্যান]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর