মঙ্গলবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

ঘনিয়ে আসছে অক্সিজেন সংকট

রপ্তানি বন্ধ করেছে ভারত, শিল্প খাতে ব্যবহৃত অক্সিজেনকে মেডিকেল অক্সিজেনে রূপান্তরের পরিকল্পনা

জয়শ্রী ভাদুড়ী

ঘনিয়ে আসছে অক্সিজেন সংকট

নয়নের পরিবারের এক সদস্য করোনায় আক্রান্ত হয়ে বাড়িতেই আছেন। রাজধানীর মিরপুর-১ থেকে অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনে বাড়ি ফিরছেন। ছবিটি গতকাল দুপুরে নিউমার্কেট এলাকা থেকে তোলা -জয়ীতা রায়

করোনা সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী থাকায় দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে গত কয়েক সপ্তাহে অক্সিজেনের চাহিদা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। এর মধ্যে করোনা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি ও সংকটের কারণে অক্সিজেন রপ্তানি বন্ধ করেছে ভারত। আমদানি বন্ধ হওয়া ও ক্রমবর্ধমান করোনা রোগী বৃদ্ধিতে দেশে ঘনিয়ে আসছে অক্সিজেন সংকট। তাই জীবন রক্ষাকারী অক্সিজেনের সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়ে দাঁড়িয়েছে নতুন চ্যালেঞ্জ।

সরবরাহ নিশ্চিত করতে সরকারের পরিকল্পনা বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. ফরিদ হোসেন মিঞা বলেন, ‘আমাদের এখন পর্যন্ত যে অক্সিজেন আছে তাতে সাপ্লাই চেইনে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। দেশে অক্সিজেনের চাহিদা পূরণ করা যাচ্ছে। ভবিষ্যতে রোগী বেড়ে গেলে অক্সিজেনের চাহিদা যদি বাড়ে সেক্ষেত্রে বিকল্প চিন্তা করা হয়েছে। অক্সিজেন সাধারণ দুই ধরনের তরলীকৃত ও গ্যাসীয়। তরলীকৃত অক্সিজেন থেকে পরিবর্তন করে আমরা গ্যাসীয় অক্সিজেন ফরমে চলে আসব। গ্যাসীয় অক্সিজেনের কোনো ঘাটতি নেই আমাদের। গ্যাসীয় অক্সিজেনকে মেডিকেলে প্রয়োজনীয় অক্সিজেনে রূপান্তরিত করে সরবরাহ করা হবে।’

অক্সিজেনের ঊর্ধ্বমুখী চাহিদার কারণে বেশির ভাগ সরবরাহকারী ইতিমধ্যে শিল্প কারখানায় অক্সিজেন সরবরাহ করা বন্ধ করে দিয়েছে। উৎপাদিত অক্সিজেনের সবটুকুই করোনা রোগীদের চিকিৎসায় নিয়োজিত হাসপাতালগুলোতে দিয়ে দিচ্ছে তারা। হাসপাতাল সূত্র বলছে, গত বছরের তুলনায় এ বছর করোনা সংক্রমণ অনেক বেশি বেড়ে যাওয়ায় এবং নতুন স্ট্রেইনগুলো অতি মাত্রায় সংক্রামক হওয়ায় রোগীদের ফুসফুস মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হচ্ছে। অনেকেরই তীব্র শ্বাসকষ্টের সমস্যা দেখা দিচ্ছে। ফলে বেশি সংখ্যক রোগীকে অক্সিজেন দিতে হচ্ছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক বলেন, আমরা এখনো অক্সিজেন সংকটে পড়িনি। রোগী কমে যাওয়ায় অক্সিজেনের চাহিদা কমেছে। হাসপাতালে ১৫৭টি শয্যা আজকে পর্যন্ত ফাঁকা আছে। এই হাসপাতালে এখন প্রতিদিন প্রায় দুই-তিন হাজার লিটার অক্সিজেন প্রয়োজন হয়। এখন পর্যন্ত চাহিদা মাফিক অক্সিজেন পেয়েছি, রোগী বাড়লে হয়তো পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারে।’ স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় করোনা রোগীদের চিকিৎসায় দেশের হাসপাতালগুলোতে এখন দৈনিক অক্সিজেনের চাহিদা দাঁড়িয়েছে ১৮০ টন। এর মধ্যে বহুজাতিক অক্সিজেন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ‘লিন্ডে বাংলাদেশ’ উৎপাদন ও সরবরাহ করছে ৯০ টন। স্পেক্ট্রা নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠান দৈনিক গড়ে সরবরাহ করছে ২৪ দশমিক ৫ টন এবং ইসলাম অক্সিজেন সরবরাহ করে ৪০ টন। অতিরিক্ত চাহিদা মেটাতে তারা ভারত থেকে অক্সিজেন আমদানি করে। তবে ভারত ২২ এপ্রিল থেকে অক্সিজেন রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছে। বেনাপোল স্থলবন্দর সূত্রে জানা গেছে, গত ২১ এপ্রিলের আগে এক সপ্তাহে ৪৯৮ মেট্রিক টন অক্সিজেন ভারত থেকে বেনাপোল বন্দরে প্রবেশ করেছে। লিন্ডে বাংলাদেশ লিমিটেড-এর ব্যবস্থাপক (মানব সম্পদ) ও মুখপাত্র সাইকা মাজেদ বলেন, চাহিদা তো আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। গত ছয় সপ্তাহে চাহিদা প্রায় ৪০ শতাংশ বেড়েছে। আর গত এক বছরে যদি বলি সেটা তিন গুণের বেশি বেড়েছে। এই চাহিদা মেটাতে আমরা এখন শিল্পজাত অক্সিজেনের চেয়ে মেডিকেল অক্সিজেন উৎপাদনকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। তিনি আরও জানান, আমরা মূলত তরল অক্সিজেনকেই বেশি অগ্রাধিকার দিই। আইসিইউতে এ ধরনের অক্সিজেন সরবরাহ করা হচ্ছে। এখন সরকারি হাসপাতাল ও বড় বড় বেসরকারি হাসপাতালগুলো আমাদের কাছে যে চাহিদা দিচ্ছে, এখন পর্যন্ত সেটা দিতে পারছি। এই মুহূর্তে যেহেতু তাদের চাহিদা একটু বেশি, আমরা শিল্প কারখানার অক্সিজেন বন্ধ করে দিয়ে তাদেরকে দিচ্ছি।

সাইকা মাজেদ বলেন, এখন পর্যন্ত চলছে, কিন্তু ভারতের মতো যদি অবস্থা হয়, তাহলে আমাদের জন্য পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে যাবে। নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামে আমাদের দুটি অক্সিজেন প্লান্ট আছে। এগুলো থেকে প্রতিদিন ৯০ টন অক্সিজেন উৎপাদিত হয়। আগে মেডিকেল ও শিল্পজাত অক্সিজেনের অনুপাত ছিল প্রায় ৬০:৪০। শিল্পজাত অক্সিজেনের চাহিদা আগের মতো থাকলেও মেডিকেল অক্সিজেনের চাহিদা ৮০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে। ফলে অনুপাত হয়ে গেছে ৮০:২০। এ ছাড়া চট্টগ্রামভিত্তিক অক্সিজেন উৎপাদনকারী সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড অক্সিজেন লিমিটেড, যারা এতদিন কেবল শিল্পকারখানায় অক্সিজেন সরবরাহ করেছে, এখন তারা স্বাস্থ্যসেবা খাতে অক্সিজেন সরবরাহ করতে চায়। অ্যাসোসিয়েটেড অক্সিজেন লিমিটেডের উপদেষ্টা সোহরাব হোসেন বলেন, চট্টগ্রামভিত্তিক আমাদের এই প্রতিষ্ঠানটি মূলত শিল্পগুলোতে অক্সিজেন সরবরাহ করে থাকে। তবে এখন আমরা চাহিদা অনুযায়ী হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেন সরবরাহ করছি। করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেনের চাহিদা বেড়েছে। এ কারণে এখন আমরা হাসপাতালে তরল অক্সিজেন সরবরাহের চেষ্টা করছি। এ লক্ষ্যে আমরা কারখানা ও পরিবহন ব্যবস্থার কিছু সরঞ্জাম সংযোজনে কাজ করছি। ইসলাম অক্সিজেন লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মুস্তাইন বিল্লাহ বলেন, আগের তুলনায় অক্সিজেনের চাহিদা বেড়েছে অনেক গুণ। সব সময় সিরিয়াল লেগে আছে। কারণ ৯ দশমিক ৮ কিউবিক মিটার ধারণক্ষমতা সম্পন্ন একটা সিলিন্ডার স্কেলিং করতে ৫০ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা সময় লাগে। আমাদের একটা সীমাবদ্ধতা আছে। আমরা দিনে সর্বোচ্চ ২৮ হাজার ৮৮০ কিউবিক মিটার অক্সিজেন রিফিল করতে পারি।

তিনি আরও বলেন, মেডিকেল অক্সিজেনের চাহিদা অনেক বেড়ে যাওয়ায় ২০ দিন আগে থেকেই ইসলাম অক্সিজেন লিমিটেড শিল্পজাত অক্সিজেন উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। এখানে পুরোটাই এখন মেডিকেল অক্সিজেন উৎপাদন চলছে। অক্সিজেনের চাহিদা মেটাতে স্বাস্থ্য অধিদফতর তিনটি নতুন উৎসের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। এসব উৎস থেকে পাওয়া যাবে মোট ৭৫ টন অক্সিজেন। তবে বর্তমানে এই তিনটি প্রতিষ্ঠান মাত্র ৩৫ টন অক্সিজেন দিতে পারবে বলে জানিয়েছে। এর মধ্যে আবুল খায়ের স্টিল মেল্টিং লি. দৈনিক ৭ টন, ইসলাম অক্সিজেন ২০ টন এবং এ কে অক্সিজেন লি. ৮ টন সরবরাহ করতে পারছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘অক্সিজেনের কোনো সংকট দেশে নেই। তবুও প্রস্তুতি হিসেবে অক্সিজেন সরবরাহকারী তিনটি প্রতিষ্ঠানের বাইরে আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমাদের আলোচনা হয়েছে। সেখান থেকে অক্সিজেন সরবরাহ পাওয়া যাবে। এ ছাড়া শিল্প কারখানায় ব্যবহৃত অক্সিজেনকে মেডিকেল অক্সিজেনে রূপান্তরের পরিকল্পনা করা হয়েছে। আশাকরি আমাদের অক্সিজেন সংকট হবে না।’

সর্বশেষ খবর