সোমবার, ৩ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

নন্দীগ্রামে নাটকীয়তা হেরে গেলেন মমতা

কলকাতা প্রতিনিধি

২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে সবচেয়ে হাইভোল্টেজ কেন্দ্র ছিল পূর্ব মেদিনীপুর জেলার ‘নন্দীগ্রাম’। গতকাল ভোটগণনাকে কেন্দ্র করে গোটা দিনটিই দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমের নজর ছিল এখানে। কারণ নিজের নির্বাচনী কেন্দ্র কলকাতার  ‘ভবানীপুর’ ছেড়ে এবার ‘নন্দীগ্রাম’ কেন্দ্রে লড়াই করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলের প্রধান মমতা ব্যানার্জি।

২০১১ সাল থেকে ভবানীপুর কেন্দ্র থেকে জিতে প্রথমবারের জন্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হন মমতা। ২০১৬ সালেও সেই ধারা বজায় থাকে, যদিও সেবার জয়ের ব্যবধান অনেকটাই কমে যায়। কিন্তু একুশের নির্বাচনে হঠাৎ করেই নন্দীগ্রাম থেকে প্রতিদ্ধন্ধিতা করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। মমতার ওই সিদ্ধান্তে নিজের দল তো বটেই এমনকি বিরোধী দল বিজেপিসহ অন্য সবাই কিছুটা বিস্মিত হন। সে সময় মমতাকে বলতে শোনা গিয়েছিল- আমি মুখে যা বলি কাজেও তাই করি।

এই কেন্দ্রে মমতার প্রধান প্রতিপক্ষ ছিলেন বিজেপির প্রার্থী ও রাজ্যের সাবেক পরিবহন মন্ত্রী, নন্দীগ্রামের ভূমিপুত্র শুভেন্দু অধিকারী। সংযুক্ত মোর্চা সমর্থিত সিপিআইএম প্রার্থী ছিলেন মীনাক্ষী মুখার্জি। যে নন্দীগ্রাম আন্দোলনের হাত ধরে ২০১১ সালে রাজ্যে মমতার প্রথমবারের জন্য ক্ষমতায় আসা- সেই আন্দোলনের অন্যতম মুখ ছিলেন শুভেন্দু। কিন্তু গত ডিসেম্বরে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেন শুভেন্দু। এরপর তাকেই নন্দীগ্রামে প্রার্থী করে বিজেপি। মমতার নাম ঘোষণার পরই শুভেন্দু তাকে পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে জানিয়েছিলেন, নন্দীগ্রামে মমতাকে ৫০ হাজার ভোটে হারাবেন। কিন্তু শুভেন্দুর গড় বলে পরিচিত সেই নন্দীগ্রামে গতকাল সকাল থেকেই ছিল টানটান উত্তেজনা। ভোট গণনার প্রথম কয়েক রাউন্ডে এগিয়ে যান শুভেন্দু। কিন্তু বেলা গড়াতেই শুভেন্দু ও মমতার মধ্যে জোর টক্কর শুরু হয়। কখনো এগিয়ে শুভেন্দু, আবার পরের রাউন্ডেই মমতা। সবশেষে এদিন সন্ধ্যায় ১৭ রাউন্ডের শেষে মমতা তার প্রধান প্রতিপক্ষ শুভেন্দু অধিকারীকে ১২০০ ভোটে পরাজিত করেন বলে সংবাদ সংস্থা এএনআই সূত্রে খবর আসে। বিভিন্ন গণমাধ্যমেও সেই খবর সম্প্রচারিত হয়। কিন্তু এর কিছু পরেই নন্দীগ্রামের ফলাফল নিয়ে নাটকীয় মোড় নেয়। জানা যায় মমতা নয়, ওই কেন্দ্র থেকে ১৯৫৩ ভোটে জিতেছেন শুভেন্দু অধিকারী। আর তা নিয়েই এদিন সন্ধ্যায় কালীঘাটে সংবাদ সম্মেলন থেকে নির্বাচন কমিশনকে নিশানা করেন মমতা। তিনি বলেন, ‘নন্দীগ্রামের মানুষের রায় আমি মাথা পেতে নিচ্ছি।’ যদিও তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘নির্বাচন কমিশন কীভাবে বিজেপির মুখপাত্র হয়ে কাজ করেছে- তা আমরা দেখেছি। আমি খুবই দুঃখিত যে আমি যখন নন্দীগ্রাম ইস্যুতে প্রশ্ন তুলেছিলাম, কেউ বিশ্বাস করেনি যে কীভাবে সেখানে লুট করা হয়েছিল। গোটা রাজ্য একদিকে রায় দিয়েছে, সেখানে নন্দীগ্রামের রায় কীভাবে অন্য দিকে যাচ্ছে? এটা কি সম্ভব? কোনোমতেই নয়। তারা প্রায় তিন ঘণ্টা সার্ভার (ওয়েবসাইট) বন্ধ করে রাখল। তারা একবার আমার জয়লাভ ঘোষণা করে দিল, পরক্ষণেই তারা আবার অন্য কথা বলছে। ফলে আমার মনে হয় লুট চলছে, প্রতারণা চলছে।’ বিষয়টি নিয়ে তিনি আদালতের দ্বারস্থ হবেন বলেও জানান মমতা। পরক্ষণেই তিনি আবার বলেন, ‘মাত্র একটা আসনে এমনটা হয়েছে, আমরা এই বিষয় নিয়ে ভাবছি না। কারণ বাংলা খেলায় জিতে গেছে।’ এরপরই তৃণমূল কংগ্রেসের তরফ থেকে একটি টুইট করা হয়। সেখানে বলা হয়- গণনা এখনো শেষ হয়নি, সেক্ষেত্রে কেন তাড়াতাড়ি জল্পনা। এরপর নন্দীগ্রাম কেন্দ্রে মমতা ব্যানার্জির নির্বাচনী এজেন্ট শেখ সুফিয়ান পুনর্গণনার দাবি জানান। এরপরই প্রশ্ন ওঠে যে, ওই কেন্দ্রে কি আবারও গণনা হবে? যদিও এ ব্যাপারে রাজ্যের প্রধান নির্বাচনী কর্মকর্তা আরিজ আফতাব জানান, অভিযোগ খতিয়ে দেখে গোটা কেন্দ্রে পুনর্গননা হবে না। একটি নির্দিষ্ট বুথে পুনর্গননা হবে। সে ব্যাপারে রিটার্নিং অফিসারই সিদ্ধান্ত নেবেন। যদিও শুভেন্দুর কাছে হারের পরই বিজেপির আইটি সেলের প্রধান অমিত মালব্য টুইট করে জানান, ‘খুব বড় খবর। মমতা ব্যানার্জি নন্দীগ্রামে হেরেছেন। বিজেপির শুভেন্দু অধিকারী ১৬২২ ভোটে জিতেছেন। এই পরাজয়ের পর নৈতিক দায়িত্ব নিয়ে মমতার কি মুখ্যমন্ত্রীর পদে থাকা উচিত?’  তবে এবারের নির্বাচনে নন্দীগ্রামে মমতার দাঁড়ানোর সিদ্ধান্তের পরে একের পর এক ঘটনা ঘটতে থাকে। ভোট শুরু হওয়ার দুই সপ্তাহ আগেই গত ১০ মার্চ নন্দীগ্রাম কেন্দ্রের জন্য মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে ফিরে আসার পথে বিরুলিয়া বাজারে বাম পায়ে আঘাত পান মমতা। ওই ঘটনায় চক্রান্তের অভিযোগ তুলেছিলেন তিনি। যদিও বিজেপির দাবি ছিল, ভোটে সহানুভূতি পাওয়ার জন্যই তিনি ভাঙা পা নিয়ে নাটক করছেন। এরপর সেখান থেকে সোজা কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতাল। হাসপাতালে চিকিৎসার পর ছুটি পেয়ে হুইল চেয়ারে করেই পুরো নির্বাচনী প্রচারণা সারেন মমতা। এমনকি গত ২৬ এপ্রিল হুইল চেয়ারে করেই ভোটও দিতে যান মমতা। আর নির্বাচনী প্রচারে গিয়েই স্লোগান তুলেছিলেন ‘ভাঙা পায়েই খেলা হবে’। এনিয়ে তৃণমূল নেত্রী বলেন, ‘সত্যিই খেলা হয়েছে, খেলা শেষে জিতেছি।’ এদিকে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসা ও তৃণমূল কংগ্রেসের জয়কে বাংলার জয়, বাংলার মানুষের জয় বলে অভিহিত করেছেন দলের প্রধান মমতা ব্যানার্জি। রাজ্যটির ২৯৪ আসনের মধ্যে ২৯২টি আসনে ভোট গণনার পর সন্ধ্যায় কালীঘাটে এক সংবাদ সম্মেলন থেকে মমতা বলেন, ‘যেহেতু এটা একুশ সাল, তাই আমার লক্ষ্য ছিল ২২১টি আসনে জিতব। একটি টিভি চ্যানেলে আমাকে যখন ডাবল ইঞ্জিনের কথা বলা হয়েছিল, তখন আমি বলেছিলাম যে- ডাবল সেঞ্চুরি করবই।

যাইহোক বাংলার এই জয় ‘ল্যান্ডস্লাইড’ জয়। এতে বাংলার জয় হয়েছে, বাংলার মানুষের জয় হয়েছে, বাংলার মা-বোনদের জয় হয়েছে, সম্প্রীতি, সংহতির জয় হয়েছে। বাংলা আজকে সারা ভারতকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। বাংলার এই জয়ে গোটা ভারতের মানুষকে আমরা অভিনন্দন জানাচ্ছি।’ মমতার অভিমত, ‘বহু প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে আমাদের জয় এসেছে। গোটা কেন্দ্রীয় সরকার, কেন্দ্রীয় এজেন্সি, নির্বাচন কমিশন আমাদের সঙ্গে খুব রূঢ় ব্যবহার করেছে। তাই মানুষের এই জয় বাংলাকে শুধু বাঁচিয়েই দেয়নি, মনুষ্যত্ব, মানবিকতাকেও বাঁচিয়ে দিয়েছে।’

সর্বশেষ খবর