বুধবার, ৫ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

দেশে মাসে দেড় কোটি টিকা উৎপাদন সম্ভব

জয়শ্রী ভাদুড়ী

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সঙ্গে লড়াইয়ে টিকা জরুরি অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ অনেক দেশের তুলনায় টিকা কার্যক্রম আগে শুরু করতে পারলেও টিকার চালান না আসায় সংকটে পড়েছে কর্মসূচি। এ জন্য চীন-রাশিয়ার টিকার প্রযুক্তি দেশে নিয়ে এসে স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করতে শুরু হয়েছে প্রক্রিয়া। আলোচনায় থাকা তিনটি প্রতিষ্ঠানের মাসে দেড় কোটি ডোজ টিকার উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদন করে বাজারজাতের সক্ষমতা রয়েছে শুধু ইনসেপটার। পপুলার ফার্মাসিউটিক্যালস টিকা সরবরাহ করতে পারে। প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদনের ধাপ শুরু হয় ফিলিং থেকে। পরের ধাপে টেস্টিংয়ের সক্ষমতা রয়েছে তাদের। সর্বশেষ গত বছর টিকা সক্ষমতা গড়ে তোলার প্রক্রিয়া শেষ করেছে হেলথকেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস। এ তিন প্রতিষ্ঠান মাসে দেড় কোটি ডোজ করোনা টিকা উৎপাদনে সক্ষম। ইনসেপটা ফার্মাসিউটিক্যালস প্রতি মাসে ৮০ লাখ ডোজ উৎপাদন করতে পারবে। হেলথকেয়ার পারবে ৫০ লাখ ডোজ। আর মাসে ২০ লাখ ডোজ টিকা সরবরাহ করতে পারবে পপুলার ফার্মাসিউটিক্যালস।

ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘দেশে তিনটি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির টিকা উৎপাদনের সক্ষমতা আছে। একটি কোম্পানি প্রতি মাসে ৮০ লাখ ডোজ টিকা উৎপাদন করতে পারবে। কিন্তু প্রটোকল এখনো নির্ধারিত হয়নি।’ তিনি আরও বলেন, টিকা আমদানি করা হবে। আর সেটা হবে জিটুজি (সরকার থেকে সরকার) পদ্ধতিতে। সরকারি পর্যায়ে যোগাযোগ করে এর কার্যক্রম চলবে। কত সংখ্যক ডোজ, এর দাম কত হবে সবকিছু নির্ধারণ করবে সরকারের এ সংক্রান্ত কমিটি।’ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, সারা বিশ্বে সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত ১৩টি টিকা জনসাধারণের ওপর প্রয়োগ শুরু হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের মডার্না, যুক্তরাজ্য ও সুইডেনের অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা, যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির ফাইজার-বায়োএনটেক, রাশিয়ার স্পুটনিক-ভি, যুক্তরাষ্ট্র ও নেদারল্যান্ডসের জনসন অ্যান্ড জনসন, চীনের ক্যানসিনো বায়োলজিকস-এর অ্যাড ৫-এন-কোভ, সিনোভ্যাক কোম্পানির করোনাভ্যাক ও সিনোফার্ম কোম্পানির বিবিআইপি-করভি এবং ইন্ডিয়ান কোম্পানি ভারত বায়োটেকের কোভ্যাকসিন বা বিবিভি ১৫২। এর মধ্যে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা কভিশিল্ড দেশে প্রয়োগ চলছে। সম্প্রতি ভারতের টিকা রপ্তানি নিষেধাজ্ঞায় ভাটা পড়েছে কর্মসূচিতে। জুন-জুলাইয়ের আগে টিকা সরবরাহ অনিশ্চিত বলেও জানিয়েছে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট। যার কারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছ থেকেও টিকা পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। প্রথম ডোজ নেওয়া সবাই দ্বিতীয় ডোজ নিতে পারবে কিনা সেটা নিয়েও তৈরি হয়েছে সংশয়। তাই প্রথম ডোজ দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। বিকল্প উৎস খুঁজতে চীন ও রাশিয়ার প্রস্তাবকে প্রাধান্য দেয় বাংলাদেশ। চীনের টিকা সিনোফার্ম ও রাশিয়া টিকা স্পুটনিক-ভি’র টিকা দেশে জরুরি ব্যবহারের অনুমোদনও দেওয়া হয়েছে। এগিয়ে যাচ্ছে এই টিকা দেশে উৎপাদন প্রক্রিয়াও। নিউইয়র্ক টাইমস কভিড-১৯ ভ্যাকসিন ট্র্যাকারের তথ্য অনুসারে, চীনের সিনোফার্ম একটি ডাবল ডোজ টিকা, যা তিন সপ্তাহের ব্যবধানে নিতে হয় এবং এর কার্যকারিতা ৭৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ। বেইজিং ইনস্টিটিউট অব বায়োলজিক্যাল প্রোডাক্টের উৎপাদিত এই টিকাটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালানোর জন্যে চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংস্থা সিনোফার্মকে দেওয়া হয়েছিল। চীন ইতিমধ্যে টিকাটির ১০ লাখের বেশি ডোজ মজুদ করেছে এবং তারা নিজ দেশে এটি ব্যবহার করছে। এ ছাড়াও টিকাটি এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা ও আফ্রিকার অনেক দেশে রপ্তানি করা হচ্ছে। মেডিকেল জার্নাল ল্যানসেটে রাশিয়ার স্পুটনিক-ভি টিকার তৃতীয় ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। সেখা দেখা যায়, স্পুটনিক-ভি টিকার কার্যকারিতার ৯১ দশমিক ৬ শতাংশ। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফলাফল বলছে স্পুটনিক-ভি নিরাপদ। বাংলাদেশের চাহিদা মেটানোর মতো উৎপাদন সক্ষমতা এই মুহূর্তে রাশিয়ার না থাকার কারণে বাংলাদেশেই ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানির মাধ্যমে টিকা উৎপাদনে রাজি হয় রাশিয়া। এই ক্ষেত্রে শর্ত ছিল টিকার ফর্মুলা কোনোভাবেই প্রকাশ করা যাবে না। বাংলাদেশ সেই ‘নন ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট’ স্বাক্ষর করে রাশিয়ার কাছে পাঠিয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, ইতিমধ্যে রাশিয়ার টিকা পেতে সক্ষমতা আছে এমন কয়েকটি দেশীয় ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানির নাম রাশিয়ার কাছে পাঠানো হয়েছে। সক্ষমতা অনুযায়ী রাশিয়া যাদের পছন্দ করবে তারাই উৎপাদন করতে পারবে স্পুটনিক-ভি। তবে রাশিয়ার ফর্মুলাতে দেশে উৎপাদিত এই টিকার নামকরণ একই থাকবে নাকি বদলে যাবে সে বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানা গেছে। অন্যদিকে জনস্বাস্থ্য ক্ষেত্রের ওষুধ, পরীক্ষামূলক ওষুধ, টিকা ও মেডিকেল সরঞ্জামবিষয়ক কমিটি রাশিয়ার টিকা সলিউশন নাকি পাউডার দেশে এনে উৎপাদন করা হবে তা নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে কমিটি জানিয়েছে টিকা আনার ক্ষেত্রে এখনো অনেক প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে। দেশের শীর্ষ ওষুধ প্রস্তুতকারক ও বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম ইনসেপটা ফার্মাসিউটিক্যালস। আর গুটিকয়েক যে কয়টি প্রতিষ্ঠান দেশেই টিকা উৎপাদন ও সরবরাহ করতে সক্ষম, ইনসেপটা সেগুলোর মধ্যেও এগিয়ে। ইনসেপটা ফার্মাসিউটিক্যালসের কর্মকর্তারা জানান, তারা প্রতি মাসে ৮০ লাখ ডোজ উৎপাদন করতে পারবে। বর্তমানে উৎপাদন অব্যাহত রাখার পরও প্রতি মাসে ২০ লাখ ডোজ করোনার টিকা উৎপাদনের সক্ষমতা পপুলার ফার্মাসিউটিক্যালসের রয়েছে বলে জানা গেছে। হেলথকেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস মাসে ৫০ লাখ ডোজ টিকা সরবরাহ করতে পারবে বলে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরকে জানিয়েছে। ২০২০ সালের শেষ নাগাদ টিকার সক্ষমতা গড়ে তোলার প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়েছে। কভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাব শুরুর ন্যূনতম দুই বছর আগে টিকা উৎপাদন সক্ষমতা গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়। বর্তমানে হেলথকেয়ারের টিটি ও হেপাটাইটিস-বি টিকা বাজারে সরবরাহ হচ্ছে। ঔষধ প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, গত ৮ জানুয়ারি ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার অনুমোদন দেওয়া হয়। সেরামের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী টিকা সরবরাহ নিশ্চিত না হওয়ায় গত ২৭ এপ্রিল রাশিয়ার মস্কোর গামালিয়া ইনস্টিটিউটের তৈরি স্পুটনিক-ভি ও ২৯ এপ্রিল চীনের বেইজিং ইনস্টিটিউট অব বায়োলজিক্যাল প্রোডাক্টের উৎপাদিত সিনোফার্মের টিকাকে জরুরি প্রয়োগের অনুমোদন দেওয়া হয়। এসব টিকা আমদানির পাশাপাশি সরকার নিজস্ব তহবিল থেকে স্থানীয়ভাবে উৎপাদনের বিষয়ে পরিকল্পনা করছে।

সর্বশেষ খবর