বুধবার, ৫ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

ইতিকাফের প্রয়োজনীয় কিছু মাসায়েল

মুফতি আমজাদ হোসাইন হেলালী

ইতিকাফের প্রয়োজনীয় কিছু মাসায়েল

ইতিকাফ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক ইবাদত। প্রতি বছর রমজানের শেষ দশকে অসংখ্য মানুষ এ ইবাদত করে। কিন্তু ইতিকাফের প্রয়োজনীয় মাসলা-মাসায়েল জানা না থাকায় তাদের অনেক ধরনের ভুলত্রুটির শিকার হতে হয়। এখানে ইতিকাফের কিছু মাসলা-মাসায়েল উল্লেখ করা হলো। ইতিকাফ তিন প্রকার- ওয়াজিব, সুন্নতে মুয়াক্কাদা, মুস্তাহাব।

ওয়াজিব ইতিকাফ : মান্নতের ইতিকাফ। এর জন্য রোজা রাখা আবশ্যক।

সুন্নতে মুয়াক্কাদা : রমজানের শেষ দশক তথা ২০ রমজান সূর্যাস্তের আগ থেকে ঈদের চাঁদ তথা শাওয়ালে চাঁদ দেখা যাওয়া বা ৩০ রমজান পূর্ণ হয়ে ওই দিন সূর্যাস্ত পর্যন্ত ইতিকাফ করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা আলাল কিফায়া। অর্থাৎ কমপক্ষে সবার পক্ষ থেকে একজন হলেও আদায় করতে হবে। অন্যথায় সবাই গুনাহগার হবে।

মুস্তাহাব ইতিকাফ : ওয়াজিব ও সুন্নত ইতিকাফ ছাড়া অন্য যে কোনো সময়ের ইতিকাফকে মুস্তাহাব ইতিকাফ বলা হয়। (আলবাহরুর রায়েক ২/৪২১, বাদায়েউস সানায়ে ২/১০৯, ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২১১)। ইতিকাফের জন্য শর্ত হলো মুসলমান হওয়া। বিবেচনা বোধসম্পন্ন হওয়া। নিয়ত করা। পবিত্র থাকা। পুরুষের জন্য মসজিদে আর মহিলাদের বাড়ির নির্দিষ্ট কোনো কামরার নির্দিষ্ট কোণে ইতিকাফ করা। (আদ্দুররুল মুখতার ৩/৪২৯-৪৩৪, বাদায়েউস সানায়ে ২/২৭৫, হাশিয়াতুত তাহতাবি পৃ. ৬৯৯)। কয়েকজন ভাগ করে ১০ দিন ইতিকাফ করলে কারও সুন্নত ইতিকাফ আদায় হবে না বরং তা নফল বলে গণ্য হবে। (আলবাহরুর রায়েক ২/২৯৯, হাশিয়াতুত তাহতাবি পৃ. ৩৮২; রদ্দুল মুহতার ২/৪৪৫)। প্রাপ্তবয়সীদের মধ্য থেকেই ইতিকাফে বসা উচিত। কেননা রমজানের শেষ দশকের ইতিকাফ অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ ইবাদত। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা খুব গুরুত্বসহকারে আদায় করতেন। তাই এ ব্যাপারে উদাসীনতা করা ঠিক নয়। (বাদায়েউস সানায়ে ২/২৭৪, আলবাহরুর রায়েক ২/২৯৯, রদ্দুল মুহতার ১/৫৭৭)। সুন্নত ইতিকাফের জন্য রোজা রাখা শর্ত। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘রোজা ছাড়া (সুন্নত) ইতিকাফ হয় না।’ (বায়হাকি ৪/৩১৭, মুসতাদরাকে হাকেম ২/৮১)। ইতিকাফকারী মসজিদ থেকে ভুলে বের হলেও ইতিকাফ ভেঙে যাবে। (বাদায়েউস সানায়ে ২/২৮৫, ফাতাওয়া খানিয়া ১/২২২, আলবাহরুর রায়েক ২/৩২০)। ইতিকাফ শুধু মসজিদেই করা যায়। অস্থায়ী নামাজঘরে ইতিকাফ সহি নয়। (বাদায়েউস সানায়ে ২/২৮০, ফাতাওয়া খানিয়া ৩/২৯০)। পানজেগানা মসজিদে ইতিকাফ শুরুর পর জুমা আদায়ের প্রয়োজনে জামে মসজিদে গেলে এবং সেখানে বাকি দিনগুলোর ইতিকাফ পূর্ণ করলে ওই ইতিকাফ আদায় হয়ে যাবে। তবে কোনো শরয়ি প্রয়োজন ছাড়া এমন করা অনুত্তম। (বাদায়েউস সানায়ে, ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ৩/৪৪৫)।

রমজান ছাড়া অন্য কোনো নির্দিষ্ট মাসে ইতিকাফের মানত করলে রমজানে ইতিকাফ করার দ্বারা মানত আদায় হবে না। বরং রমজান ছাড়া অন্য কোনো মাসে নফল রোজাসহ তা আদায় করা আবশ্যক। সেরূপ মাস উল্লেখ না করে কিছুদিনের ইতিকাফের মানত করলেও রমজান ছাড়া অন্য মাসে নফল রোজাসহ ইতিকাফ করতে হবে। (ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২১১, আলমুহিতুল বুরহানি ৩/৩৮৩)।

মসজিদে খাবার পৌঁছে দেওয়ার মতো কেউ না থাকলে খাবার আনার জন্য বাসায় যাওয়া যাবে। এ কারণে ইতিকাফ ভাঙবে না। তবে অন্য কোনো কাজে বিলম্ব করা যাবে না। অন্য কাজে অল্প সময় ব্যয় করলেও ইতিকাফ ভেঙে যাবে। অবশ্য ঘটনাক্রমে খাবার প্রস্তুত না হলে সেজন্য অপেক্ষা করা যাবে। (আলবাহরুর রায়েক ২/৩০৩, আলমুহিতুল বুরহানি ৩/৩৮০)। ইসতিনজার প্রয়োজনে মসজিদের বাইরে যাওয়া জায়েজ। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইতিকাফরত অবস্থায় ইসতিনজার প্রয়োজন ছাড়া ঘরে প্রবেশ করতেন না।’ (বুখারি ১/২৭২, মুসলিম ১/১৪২)। ইতিকাফ অবস্থায় আজানের জন্য মসজিদের বাইরে যাওয়ার অনুমতি আছে। (কিতাবুল আছল ২/১৯১, ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২১২)। ইতিকাফরত অবস্থায় জানাজা নামাজের উদ্দেশ্যে মসজিদ থেকে বের হলে ইতিকাফ ভেঙে যাবে। উল্লেখ্য, যদি কোনো ব্যক্তি প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণের উদ্দেশ্যে বা জুমার নামাজ আদায়ের উদ্দেশ্যে মসজিদ থেকে বেরিয়ে পথিমধ্যে জানাজায় শরিক হয় এবং নামাজ শেষে সেখানে বিলম্ব না করে মসজিদে ফিরে আসে তাহলে তার ইতিকাফ ভাঙবে না। (বাদায়েউস সানায়ে ২/২৮৩, ২৮৪; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১২১, রদ্দুল মুহতার ২/৪৪৪)। রমজানের শেষ দশকের ইতিকাফের বিধানটি মূলত পুরুষের জন্য। তবে কোনো নারী ইতিকাফ করতে চাইলে তিনি তার নামাজের জন্য নির্ধারিত কক্ষ বা জায়গায় ইতিকাফ করবেন। তখন সুন্নত ইতিকাফের বিধিবিধান তার জন্যও প্রযোজ্য হবে। (ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২১১, আদ্দুররুল মুখতার ২/৪৪৪)। ইতিকাফকারী কোনো প্রয়োজনে মসজিদের বাইরে গেলে সালাম বা সালামের জবাবের জন্য না থেমে সালাম বা সালামের জবাব দিতে পারবে। এতে তার ইতিকাফের কোনো ক্ষতি হবে না। (রদ্দুল মুহতার ২/৪৪৫)। যেসব মহিলার স্বামী আছে তাদের সুন্নত ইতিকাফের জন্য স্বামীর অনুমতি নেওয়া জরুরি। অন্যথায় ইতিকাফ সহি হবে না।’ (ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২১১)। পুণ্যের কাজ ভেবে ইতিকাফে নীরবতা অবলম্বন করা মাকরুহে তাহরিমি। (রদ্দুল মুহতার ২/৪৪৮-৪৪৯, ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২১৩)। কোনো কারণে ইতিকাফ নষ্ট হয়ে গেলে পরে তা রোজাসহ কাজা করে নেবে। যেদিনের ইতিকাফ নষ্ট হয়েছে শুধু সেদিনের কাজা করা ওয়াজিব। আর বাকি দিনগুলোর কাজা করা উত্তম। (রদ্দুল মুহতার ২/৪৪৫, ইমদাদুল ফাতাওয়া ২/১৫৪)। আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে আমল করার তৌফিক দান করুন।

লেখক : মুহাদ্দিস, মুফাসসির, খতিব ও টিভির ইসলামী প্রোগ্রাম উপস্থাপক।

সর্বশেষ খবর