রবিবার, ৯ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

শঙ্কা বাড়াচ্ছে করোনার ভারতীয় ধরন

শনাক্ত হলো দেশে, জিনোম সিকোয়েন্স বাড়ানোর পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের

জয়শ্রী ভাদুড়ী, ঢাকা ও সাইফুল ইসলাম, যশোর

দেশে শনাক্ত হয়েছে করোনাভাইরাসের ভারতীয় ভেরিয়েন্ট বা ধরন। ভারত থেকে যশোরের বেনাপোল দিয়ে বাংলাদেশে আসা আটজনের নমুনা পরীক্ষায় ছয়জনের শরীরে এ ভেরিয়েন্ট শনাক্তের তথ্য জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। অতিদ্রুত সংক্রামক এ ভাইরাস শনাক্তে জিনোম সিকোয়েন্সিং ও সংক্রমণ ঠেকাতে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায় জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

গতকাল স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আইইডিসিআর ও যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আটজনের নমুনা পরীক্ষা করে দুটি নিশ্চিত ভারতীয় ভেরিয়েন্ট ও চারটি ভারতীয় ভেরিয়েন্টের কাছাকাছি ভেরিয়েন্ট শনাক্ত করেছে। সম্পূর্ণ জিনোম সিকোয়েন্সিং এখনো শেষ হয়নি। তা না হলে এখনো বলা যাবে না ডাবল নাকি ট্রিপল ভেরিয়েন্ট। তিনি আরও বলেন, ভারতীয় ভেরিয়েন্ট শনাক্ত হওয়া সবাই চিকিৎসাধীন আছেন, কারও অবস্থাই খারাপ নয়। এ ভেরিয়েন্ট দেশে ছড়িয়েছে কি না পরীক্ষার পর জানা যাবে। যে কজনের ওপর পরীক্ষা করা হয়েছে তাদের মধ্যে এ ফলাফল পাওয়া গেছে। এ ভেরিয়েন্টে অনেক বেশি সংক্রামক। নতুন ভেরিয়েন্ট নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতর উদ্বিগ্ন এবং সারা দেশের মানুষেরও উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত। স্বাস্থ্যবিধি মানার এখন উচিত সময়।

করোনাভাইরাসের ভারতীয় ভেরিয়েন্টের আনুষ্ঠানিক নাম দেওয়া হয়েছে বি.১.৬১৭। মিউটেশনের কারণে এর তিনটি সাব টাইপ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশে পাওয়া গেছে বি.১.৬১৭.২ ভেরিয়েন্টটি। ভারতে প্রথম এ মিউট্যান্ট শনাক্ত হয়েছিল বলে একে ভারতীয় ভেরিয়েন্ট বলা হচ্ছে। ইতিমধ্যে প্রায় ১৭টি দেশে করোনাভাইরাসের এ ভেরিয়েন্টটি পৌঁছে গেছে, তাতে বিশ্বজুড়ে তৈরি হয়েছে উদ্বেগ। যুক্তরাজ্যের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এ ভাইরাসের ভারতীয় তিনটি ভেরিয়েন্টের মধ্যে বি.১.৬১৭.২টি অত্যন্ত দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা বলেন, ‘সম্প্রতি বেনাপোল বন্দর হয়ে ভারতফেরত কয়েকজনের নমুনা সংগ্রহ করে আইইডিসিআর এবং যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে জিনবিন্যাস বিশ্লেষণ করা হয়। তার মধ্যে দুটি নমুনায় ভারতীয় ভেরিয়েন্ট পাওয়া যায়। যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ও তাদের পরীক্ষায় একই ফল পেয়েছে। এ ভেরিয়েন্টের সংক্রমণক্ষমতা অনেক। তাই মানুষকে খুব বেশি সতর্ক থাকতে হবে।’

যশোরে ভারত থেকে দেশে ফেরা দুজনের শরীরে করোনার ভারতীয় ভেরিয়েন্টের অস্তিত্ব ধরা পড়েছে। যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) জেনোম সেন্টারের পিসিআর ল্যাবে পরীক্ষার পর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন যবিপ্রবির উপাচার্য অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন। ওই দুই আক্রান্ত ব্যক্তি বর্তমানে যশোর জেনারেল হাসপাতালের করোনা ইউনিটে চিকিৎসাধীন। ৪ মে পর্যন্ত বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে দেশে ফিরেছেন ৫৭৭ জন। তার ১৬ জন করোনা পজিটিভ হওয়ায় তাদের যশোর জেনারেল হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে ভর্তি ও নমুনা সংগ্রহ করে যবিপ্রবির জেনোম সেন্টারের পিসিআর ল্যাবে পাঠানো হয়। বাকিদের যশোর ও পাশের চার জেলা শহরের হোটেলগুলোয় কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। যে ১৬ জনের নমুনা যবিপ্রবিতে পাঠানো হয়েছিল তার দুজনের শরীরে করোনার ভারতীয় ভেরিয়েন্টের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে বলে নিশ্চিত করেছেন জেনোম সেন্টারের সহযোগী পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. ইকবাল কবীর জাহিদ। তিনি বলেন, এটি ভারতীয় বি.১.৬১৭.২ নম্বরের ভেরিয়েন্ট হলেও ডাবল মিউট্যান্ট নয়। ভারতের প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ এ ভেরিয়েন্ট দ্বারা আক্রান্ত। যুক্তরাজ্যে ৫৯ শতাংশ করোনা রোগী এ ভেরিয়েন্টে আক্রান্ত। যবিপ্রবি উপাচার্য ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, দুই রোগীকে আলাদা করে চিকিৎসা দেওয়ার পাশাপাশি তাদের সংস্পর্শে আসা সব ব্যক্তিকে কোয়ারেন্টাইনে নিয়ে তাদের নমুনা পরীক্ষার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। যশোর জেনারেল হাসপাতালে তত্ত্বাবধায়ক ডা. দিলিপ কুমার রায় বলেন, ‘যবিপ্রবি থেকে আমরা এখনো তথ্য পাইনি। পেলে আমাদের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক টিম প্রটোকল মেনে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবেন।’ দেশে করোনাভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্সিং নিয়ে শুরু থেকেই কাজ করছেন অণুজীববিজ্ঞানী সেঁজুতি সাহা। তিনি বলেন, ‘যে ভেরিয়েন্ট (বি.১.৬১৭.২) বাংলাদেশে পাওয়া গেছে, সেখানে ই৪৮৪কিউ মিউটেশনটি নেই। এটা থাকলে খুব ক্ষতিকর হতো। এখানে আমাদের টিকা কাজ করবে বলে মনে হয়।’ এর আগে চলতি বছরে বাংলাদেশে করোনার নাইজেরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, যুক্তরাজ্যের ভেরিয়েন্টের অস্তিত্বের খবর প্রকাশ করেছে করোনাভাইরাস জিনোমের উন্মুক্ত তথ্যভান্ডার জার্মানির গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অন শেয়ারিং অল ইনফ্লুয়েঞ্জা ডেটা (জিআইএসএআইডি)। বিশ্বের অন্তত ১৭টি দেশে করোনাভাইরাসের ভারতীয় ভেরিয়েন্ট পাওয়া গেছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (ডবিøউএইচও) গত মঙ্গলবার জানিয়েছে, করোনার ভারতীয় ভেরিয়েন্টটি ‘বি.১.৬১৭.২’ নামে পরিচিত। করোনার এ ভেরিয়েন্টকে অতিসংক্রামক বলে মনে করা হচ্ছে। ভারতে করোনার সংক্রমণ মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে এ ভেরিয়েন্ট ভূমিকা রাখছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, করোনাভাইরাসের চরিত্র হচ্ছে এটি দ্রুত নিয়মিতভাবে রূপান্তর হয়। বিশ্বে করোনাভাইরাসের হাজারো মিউট্যান্ট আছে। ২৫ এপ্রিল বাংলাদেশে করোনার নাইজেরিয়ান ভেরিয়েন্টের অস্তিত্বের কথা জানা যায়। দেশে এ পর্যন্ত অন্তত ১০ জনের শরীরে করোনার নাইজেরিয়ান ভেরিয়েন্টের অস্তিত্ব শনাক্ত হয়েছে। এর আগে যুক্তরাজ্য থেকে করোনাভাইরাসের আরেক ভেরিয়েন্টের অস্তিত্ব দেশে পাওয়া যায়। রূপান্তরিত নতুন এ ভেরিয়েন্ট বাংলাদেশে শনাক্তের কথা ৫ জানুয়ারি আইইডিসিআর থেকে জানানো হয়। এরপর ফেব্রুয়ারিতে দেশে পাওয়া যায় করোনার দক্ষিণ আফ্রিকান ভেরিয়েন্ট। ভারতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ফেব্রুয়ারিতে শুরু হয়। দেশটি কিছুদিন ধরে করোনা আক্রান্ত শনাক্ত ও মৃত্যুতে বিশ্বে রেকর্ড গড়ছে। বিশেষজ্ঞরা ভারতীয় ভেরিয়েন্টটিকে মারাত্মক বলে ধারণা করছেন। ভারতীয় ভেরিয়েন্ট যাতে বাংলাদেশে ছড়াতে না পারে সেজন্য ২৬ এপ্রিল থেকে সীমান্ত বন্ধ রেখেছে বাংলাদেশ। সার্বিক বিষয়ে কভিড-১৯-বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘করোনাভাইরাসের যে কোনো ভেরিয়েন্টই মাস্ক ভেদ করতে পারে না। তাই সংক্রমণ রুখতে প্রথমে সবাইকে বাইরে বের হলে মাস্ক পরতে হবে, নাক-মুখে হাত দেওয়ার আগে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। সংক্রমণ ঠেকাতে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। আর ভাইরাস শনাক্তে আক্রান্তের নমুনা থেকে জিনোম সিকোয়েন্সিং করতে হবে। কারণ ভাইরাস প্রতিনিয়ত রূপ বদলাচ্ছে।’

সর্বশেষ খবর