রবিবার, ৯ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

দলে দলে ঢাকা ছাড়ছে মানুষ

ফেরিঘাটে ভয়াবহ অবস্থা, বিজিবি মোতায়েন, কেউ মানছে না ♦ স্বাস্থ্যবিধি লুকোচুরি করে চলছে দূরপাল্লার বাসও

নিজস্ব প্রতিবেদক

দলে দলে ঢাকা ছাড়ছে মানুষ

স্বাস্থ্যবিধির কোনো তোয়াক্কা নেই। বাড়ি ফিরতে প্রাণপণ চেষ্টায় মানুষ। মাওয়া ঘাট থেকে গতকাল ছবিটি তুলেছেন রোহেত রাজীব

ঈদে দলে দলে ঢাকা ছাড়ছে মানুষ। গতকাল সকাল ৬টা থেকে ফেরি পুরোপুরি বন্ধ রাখার কথা থাকলেও ঘরমুখী হাজার হাজার যাত্রী সকাল থেকেই ঘাট এলাকায় ভিড় করে। এ ছাড়া প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাসসহ ছোট গাড়িরও চাপ পড়ে ফেরিঘাটে। পরে যাত্রীদের ভোগান্তি বিবেচনা করে ফেরি ছাড়া হয়। তবে কেউ স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। এমনকি করোনা মহামারীর শঙ্কাও নেই মানুষের মধ্যে। পরিস্থিতি সামলাতে ফেরিঘাটে মোতায়েন করা হয়েছে বিজিবি।

এদিকে মানুষের গ্রামে ফেরার তীব্র আকাক্সক্ষা পুঁজি করে নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও কৌশলে বিভিন্ন রুটে চলছে দূরপাল্লার বাস। করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে লকডাউনের মধ্যে দূরপাল্লার বাস চলাচলে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তবে এর মধ্যেও লুকিয়ে টিকিট বিক্রি করে উত্তর কিংবা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের দিকে ছেড়ে যাচ্ছে বিভিন্ন কোম্পানির বাস। ঢাকা থেকে বেশির ভাগ এলাকার দূরপাল্লার বাস চলে গাবতলী থেকে। গতকাল দুপুরে গাবতলী বাস টার্মিনালে গিয়ে দেখা যায় বেশির ভাগ কাউন্টার বন্ধ। তবে আশপাশে ঘুরছেন টিকিট বিক্রেতারা। কাউন্টারে ঘুরতে দেখে অন্তত পাঁচজন জানতে চাইলেন ‘কোথায় যাবেন’। উত্তরের জেলা বা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল সব রুটের গাড়ির টিকিটই আছে তাদের কাছে। তবে অগ্রিম টাকা দিয়ে টিকিট নিশ্চিত করতে হবে। দাম দ্বিগুণের বেশি। কুষ্টিয়ায় যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে একজন কাউন্টার কর্মী বলেন, ‘বিশ্বাস কইরা আগে বিকাশে ট্যাকা দিবেন, আপনার যাওনের সব দিক আমরা দেখুম।’ দুই সিটের জন্য বিকাশে ১ হাজার টাকা দিতে হবে বলে জানান তিনি। এর আগে লকডাউনের শুরুর দিকে আমিনবাজার, হেমায়েতপুর থেকে সামনে ‘পোশাককর্মী পরিবহন’ লিখে দূরের জেলাগুলোয় বাস চলেছে বলে জানালেন বাসশ্রমিকরাই। তবে বৃহস্পতিবার থেকে কোনো বাস সাভারে ঢুকতে দিচ্ছে না পুলিশ। তখন স্থান বদলে ‘লুকোচুরি’ করে বাস ছাড়া হচ্ছে বাইপাইল ও চন্দ্রা থেকে। সরকারি কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে জেলায় বাস চলাচল শুরু হলেও দূরপাল্লার বাস বন্ধ রাখা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ঈদে ঘরমুখো মানুষের জন্য অর্ধেক যাত্রী নিয়ে দূরপাল্লার গণপরিবহন চালুর দাবিতে গতকাল সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা।

এভাবে ঝুলে ঝুলে ফেরিতে উঠতেও দেখা যায় ঘরমুখো মানুষকে

পাটুরিয়ায় যাত্রীর চাপ : মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌপথে গতকাল দুপুর থেকে সীমিত পরিসরে ফেরি চলা শুরু হয়েছে। যাত্রীর প্রচন্ড চাপে দুপুর ১টার পর ছয়টি ফেরিতে যাত্রী ও যানবাহন পারাপার শুরু হয়। ফেরি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, গতকাল সকাল থেকে ফেরি বন্ধ রাখা হলেও পাটুরিয়া ঘাট এলাকায় যাত্রীর প্রচন্ড চাপ দেখা যায়। যাত্রীদের ভোগান্তি ও বাস্তবতা বিবেচনায় দুপুরে সীমিত পরিসরে ফেরি ছাড়া হয়। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সংস্থা-বিআইডব্লিউটিসির আরিচা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী চলমান লকডাউনের শুরু থেকে রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্সসহ জরুরি পণ্যবাহী গাড়ি পারাপার করা হচ্ছিল। এরপর বিআইডব্লিউটিএর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সকাল ৬টা থেকে ফেরি পুরোপুরি বন্ধ রাখা হয়। তবে ঈদে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের হাজারো যাত্রী সকাল থেকে ঘাট এলাকায় ভিড় করেন। এ ছাড়া প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাসসহ ছোট গাড়িরও চাপ পড়ে পাটুরিয়ায়। পরে যাত্রীদের ভোগান্তি বিবেচনা করে এবং তাদের রোষানলে বাধ্য হয়ে ফেরি ছাড়া হয়।

সকাল ৯টার দিকে পাটুরিয়া ২ নম্বর ঘাটে একটি লাশবাহী, তিনটি রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্স, ব্যক্তিগত গাড়িসহ অসংখ্য যাত্রীকে নদী পারাপারের অপেক্ষায় থাকতে দেখা যায়। এ সময় ওইসব অ্যাম্বুলেন্স পারাপারের জন্য ‘মাধবীলতা’ নামে একটি ছোট ফেরি পন্টুনের কাছে গেলে অসংখ্য যাত্রী পন্টুনে ভিড় করে। বাধ্য হয়ে ফেরিটি আর পন্টুনে ভেড়েনি। এ সময় ৩ নম্বর ঘাটে ‘শাহ আলী’ নামে একটি বড় ফেরি পন্টুনে আনা হয়। ওইসব যাত্রী এ ফেরিতে উঠে পড়ে। এরপর মাধবীলতা দিয়ে অ্যাম্বুলেন্স ও কয়েকটি ব্যক্তিগত গাড়ি পারাপার করা হয়।

দীর্ঘ প্রায় দুই ঘণ্টা শাহ আলী ফেরিতে উঠে যাত্রীরা নদী পারাপারের অপেক্ষায় থাকে। পুলিশ সদস্যরা যাত্রীদের ফেরি থেকে নামার অনুরোধ করলেও তারা শোনেনি। একপর্যায়ে ফেরি চালু না করায় যাত্রীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। দুপুর ১২টার দিকে ফেরিটি দিয়ে যাত্রী ও যানবাহন পারাপার করা হয়। এরপর ছয়টি ফেরি দিয়ে সীমিতভাবে যাত্রী ও যানবাহন পারাপার শুরু হয়। সরেজমিনে দেখা যায়, এ নৌপথে ফেরি বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ঘরমুখো মানুষ। নারী ও শিশু যাত্রীরা চরম ভোগান্তির শিকার হয়। ব্যবহার-উপযোগী শৌচাগার না থাকা এবং খাবার হোটেল বন্ধ থাকায় যাত্রীদের ভোগান্তি আরও বাড়িয়ে তোলে।

ফেরি ঘাটে মুমূর্ষু রোগীর অ্যাম্বুলেন্স : বাংলাবাজার-শিমুলিয়া নৌপথে করোনা প্রতিরোধে ফেরি দিনের বেলা সম্পূর্ণ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয় বিআইডব্লিউটিসি। এতে গতকাল সকাল থেকেই ঢাকামুখী জরুরি সেবার যানবাহনসহ অসংখ্য মুমূর্ষু রোগীর অ্যাম্বুলেন্স পারের অপেক্ষায় দুপুর পর্যন্ত আটকা ছিল। পরে ফেরি ছাড়া হয়।

শিমুলিয়া ঘাটে নজিরবিহীন ভিড় : ভোর থেকেই ঘরমুখো যাত্রীতে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে ওঠে মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া ঘাট। কিন্তু প্রমত্তা পদ্মা পাড়ির কোনো ব্যবস্থা নেই। নেই কোনো লঞ্চ, সি-বোট, ট্রলার কিংবা ফেরি। শিমুলিয়া ঘাটের কোথাও তিল ধারণের ঠাঁই নেই, শুধু যাত্রী আর যাত্রী। যাত্রীর চাপ দেখলে বোঝার উপায় নেই তাদের মধ্যে কোনো মহামারীর শঙ্কা রয়েছে। এ সময় চরম দুর্ভোগে পড়ে হাজার হাজার যাত্রী। সব ফেরি ছিল মাঝপদ্মায় নোঙর করা; তবে ফেরি ‘কুঞ্জলতা’ তীরে ভেড়া থাকায় যাত্রীরা স্লোগান দিয়ে উঠতে থাকে তাতে। একপর্যায়ে ফেরিটি কানায় কানায় পূর্ণ হলে যাত্রীদের মাঝে ফেরিতে ওঠার প্রতিযোগিতা শুরু হয়, ফেরির ছাদে ডালায় সর্বত্র যাত্রী আর যাত্রী। ফেরি কর্তৃপক্ষ শেষ পর্যন্ত যাত্রীদের চাপের মুখে চরম দুর্ভোগ বিবেচনায় এনে মানবিক কারণে তা ছাড়তে বাধ্য হন। এদিকে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে, মাওয়া চৌরাস্তা ও শিমুলিয়া ঘাটের প্রবেশমুখে পুলিশ চৌকি বসিয়ে দক্ষিণবঙ্গের ২১ জেলার ঘরমুখো মানুষকে স্ব স্ব স্থানে ফেরত পাঠানো হয়। বিআইডব্লিউটিসির শিমুলিয়া ঘাটের ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) শাফায়াত আহমেদ জানান, শেষ রাতে ফেরি বন্ধ করে দিয়েছিলেন তারা। তবে যাত্রীর উপচে পড়া চাপ, মানবিক কারণ ও দুর্ভোগ বিবেচনায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতিক্রমে প্রায় ৪ হাজার যাত্রী নিয়ে সকাল ৯টা ৫ মিনিটে ফেরি কুঞ্জলতা, এরপর দুপুর ১২টা ২৩ মিনিটে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার যাত্রী নিয়ে ফেরি ‘এনায়েতপুরী’ এবং সর্বশেষ দুপুর ১২টা ৪৩ মিনিটে সাতটি অ্যাম্বুলেন্সসহ ৩ হাজারের বেশি যাত্রী নিয়ে বাংলাবাজারের উদ্দেশে শিমুলিয়া ঘাট থেকে আরও একটি ফেরি ছেড়ে যায়।

দৌলতদিয়ায় যাত্রীর চাপ : যাত্রীর চাপে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে ফেরি চলাচল শুরু হয়েছে। গতকাল ভোর থেকে ফেরি বন্ধ থাকায় হাজার হাজার যাত্রী নদী পারাপারের অপেক্ষায় থাকে। এতে ঘাট এলাকায় আটকে পড়ে সহস্রাধিক যানবাহন। যানবাহনের মধ্যে আটকে পড়ে অ্যাম্বুলেন্স, ব্যক্তিগত গাড়ি, মোটরসাইকেল। ঘাট এলাকায় তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। ক্ষোভ বৃদ্ধি পেতে থাকে যাত্রীদের মধ্যে। বেলা ১১টায় মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া থেকে ৪ শতাধিক যাত্রী ও ১০টি অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে ছেড়ে আসে মাধবীলতা নামে একটি ইউটিলিটি ফেরি। এরপর দুপুর ১২টার কিছুক্ষণ পর রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ফেরিঘাট থেকে সর্বপ্রথম ‘রজনীগন্ধা’ নামে একটি ফেরি যাত্রী ও যানবাহন নিয়ে পাটুরিয়ার উদ্দেশে ছেড়ে যায়। এরপর ছেড়ে যায় ‘বনলতা’ নামে আরও একটি ইউটিলিটি ফেরি। তবে যাত্রীর চাপে এসব ফেরিতে রোগীবাহী কোনো অ্যাম্বুলেন্স উঠতে পারেনি। প্রতিটি ফেরিতে সামাজিক দূরত্ব না মেনে গাদাগাদি করে যাত্রীরা দাঁড়িয়ে থাকে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর