সোমবার, ১৭ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

ঝুঁকি নিয়ে ঢাকায় ফেরা

লকডাউন বাড়ল সাত দিন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ২৯ মে পর্যন্ত, খুলেছে ব্যাংক-অফিস

নিজস্ব প্রতিবেদক

ঝুঁকি নিয়ে ঢাকায় ফেরা

এবার ঢাকামুখী মানুষের ঢল। শিমুলিয়া থেকে গতকাল তোলা ছবি -রোহেত রাজীব

ঈদের ছুটি শেষে স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়েই ঢাকায় ফিরছেন মানুষ। স্বজনদের সঙ্গে ঈদ কাটিয়ে গাদাগাদি করে ফেরিতে পদ্মা পার হয়ে ঢাকায় ফিরতে শুরু করেছেন কর্মজীবী মানুষ। গতকাল সকাল থেকেই মাদারীপুরের বাংলাবাজার ঘাট হয়ে হাজার হাজার মানুষ মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া ঘাটে আসেন। এ ছাড়া দৌলতদিয়া ফেরিঘাটেও ছিল গতকাল মানুষের ঢল। এ ছাড়া দূরপাল্লার বাস বন্ধ থাকলেও মানুষ ট্রাক, পিকআপ, মাইক্রোবাস ও মোটরসাইকেলে ঝুঁকি নিয়ে কর্মস্থলে ফিরছেন। যানবাহনের চাপ ও মানুষের পদচারণায় চিরচেনা রূপে ফিরছে মহাসড়ক। সকাল থেকে বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম সংযোগ মহাসড়কে বেড়েছে যানবাহনের চাপ। একইভাবে ঢাকা-সিলেট ও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কেও যানবাহনের চাপ বেড়েছে। তবে কোথাও স্বাস্থ্যবিধির বালাই নেই। ঈদের আগেও করোনাভাইরাসের ঝুঁকি নিয়ে ঢাকা ছেড়েছিলেন তারা। ঈদের পর বেশ কিছু এলাকায় বাস চলাচল করলেও ভাড়া দ্বিগুণ নেওয়া হচ্ছে। ঈদের পরের দিন শনিবার রাত থেকে বগুড়া অঞ্চলের সড়ক-মহাসড়ক দিয়ে দূরপাল্লার বাস চলাচল করতে দেখা গেছে। এদিকে চলমান লকডাউনের (বিধিনিষেধ) মেয়াদ আরও সাত দিন বেড়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে ২৯ মে পর্যন্ত। এ ছাড়া ঈদের তিন দিনের ছুটি শেষে খুলেছে সরকারি-বেসরকারি সব অফিসের সঙ্গে ব্যাংক ও শেয়ারবাজার।

লকডাউনের মেয়াদ বাড়ল সাত দিন : করোনাভাইরাসের (কভিড-১৯) সংক্রমণ রোধে চলমান লকডাউনের (বিধিনিষেধ) মেয়াদ আরও সাত দিন অর্থাৎ ১৭ থেকে ২৩ মে পর্যন্ত আরেক দফা বাড়াল সরকার। ছুটির পর প্রথম কার্যদিবসে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, করোনাভাইরাসজনিত রোগ (কভিড-১৯) সংক্রমণের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় আগের সব বিধিনিষেধ ও কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা অনুযায়ী নতুন করে দুটি শর্ত সংযুক্ত করে বিধিনিষেধ আরোপের সময়সীমা ১৬ মে মধ্যরাত থেকে ২৩ মে মধ্যরাত পর্যন্ত বর্ধিত করা হলো। প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, সরকারের রাজস্ব আদায়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত সব দফতর/সংস্থা জরুরি পরিষেবার আওতাভুক্ত হবে। খাবারের দোকান ও হোটেল-রেস্তোরাঁ কেবল খাদ্য বিক্রি/সরবরাহ করতে পারবে। তবে কেউ হোটেল রেস্টুরেন্টে বসে খেতে পারবেন না। এর আগে কভিড-১৯ সংক্রমণ রোধে গত ১৪ এপ্রিল ভোর ৬টা থেকে আট দিনের কঠোর লকডাউন শুরু হয়। লকডাউনের মধ্যে পালনের জন্য ১৩টি নির্দেশনা দেওয়া হয় সরকারের পক্ষ থেকে। পরে তিন দফা লকডাউনের মেয়াদ বাড়ানো হয়, নির্দেশনাও আসে সংশোধনের। লকডাউনের সর্বশেষ মেয়াদ শেষ হয়েছে গতকাল রবিবার মধ্যরাতে। এর পরিপ্রেক্ষিতে করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিধিনিষেধ আরেক দফা বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে গতকালই। বিধিনিষেধের বর্ধিত মেয়াদেও জেলার মধ্যে বাস চলবে। আন্তজেলা গণপরিবহন বন্ধ থাকবে। এ ছাড়া আগের মতোই বন্ধ থাকবে ট্রেন ও লঞ্চ। এ ছাড়া লকডাউনে আগে মতোই স্বাস্থ্যবিধি মেনে দোকান ও শপিং মল সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। খোলা থাকবে শিল্প-কারখানা। এ ছাড়া জরুরি সেবা দেওয়া প্রতিষ্ঠান ছাড়া যথারীতি সরকারি-বেসরকারি অফিস বন্ধ থাকবে। সীমিত পরিসরে চলবে ব্যাংকিং লেনদেন।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি বাড়ল : করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে দেশের সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চলমান ছুটি ২৯ মে পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এর আগের ঘোষণা অনুযায়ী আগামী ২৩ মে থেকে স্কুল ও কলেজ এবং ২৪ মে থেকে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার কথা ছিল। তবে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে না আসায় আবারও ছুটি বাড়ানোর ঘোষণা দিল সরকার। করোনা মহামারীর কারণে গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে।

খুলেছে অফিস, ব্যাংক, শেয়ারবাজার : তিন দিনের ছুটি শেষে খুলেছে সরকারি-বেসরকারি সব অফিসের সঙ্গে ব্যাংক ও শেয়ারবাজার। গতকাল সপ্তাহের প্রথম দিনে অফিস কার্যক্রম শুরু হয়। ঈদের পর প্রথম দিনের অফিশিয়াল কার্যক্রম শুরুর দিনে পরিচিত দৃশ্যের তেমন উপস্থিতি দেখা যায়নি। গ্রাহক উপস্থিতি যেমন ছিল কম তেমনি কভিড প্রাদুর্ভাবের কারণে কর্মকর্তাদের কোলাকুলি করার প্রচলিত দৃশ্য ছিল অনুপস্থিত। রাজধানীর ব্যাংক শাখাগুলোতেও গ্রাহকদের উপস্থিতি তেমন দেখা যায়নি। শেয়ারবাজারে স্বাভাবিক লেনদেন হয়েছে। দিন শেষে শেয়ারের সূচক লেনদেন বেড়েছে। কভিড প্রাদুর্ভাবের কারণে সরকারি নির্দেশনা ছিল ঈদের ছুটিতে বাধ্যতামূলকভাবে কর্মস্থলে থাকতে হবে। একই সঙ্গে ঈদের ছুটি এক দিন কমিয়েও দেওয়া হয়। গত বুধবার ২৯ রমজানও অফিস খোলা ছিল। এবার ঈদের ছুটির দুই দিনই গেছে শুক্র ও শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির মধ্যে। গতকাল সচিবালয় ঘুরে দেখা গেছে, বেশির ভাগ মন্ত্রণালয় ও বিভাগেই শূন্যতা বিরাজ করছে। বেশির ভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারীই অফিস করছেন না। দুই-চারজন যারা অফিস করতে এসেছেন তারা ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন সহকর্মীদের সঙ্গে। তবে চিরচেনা কোলাকুলি বা হাত মেলাতে দেখা যায়নি কাউকে।

ছুটি শেষে কার্যক্রম শুরু হয়েছে দেশের সব ব্যাংকেও। তবে প্রথম দিনের লেনদেনে ব্যাংকগুলোতে গ্রাহকদের তেমন চাপ ছিল না। সকাল ১০টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত লেনদেনের সময় ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা মেনে এই ব্যাংকিং সময় থাকবে আরও সাত দিন।

চাঙাভাব শেয়ারবাজারে : ছুটির আগে ঊর্ধ্বমুখী শেয়ারবাজার ঈদের পরের প্রথম দিনও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) এবং চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) সবকটি মূল্য সূচকে বড় উত্থান হয়েছে। মূল্য সূচকের পাশাপাশি  লেনদেনের গতিও বেড়েছে। গতকাল ডিএসইতে লেনদেন ১ হাজার ৪০০  কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। অপর শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের সার্বিক মূল্য সূচক সিএএসপিআই বেড়েছে ১৯০ পয়েন্ট। বাজারটিতে  লেনদেন হয়েছে ৭১ কোটি ১৫ লাখ টাকা।

গাদাগাদি করে ঢাকায় ফেরা : মাদারীপুর প্রতিনিধি জানান, ঈদ শেষে মাদারীপুরের বাংলাবাজার ফেরিঘাট দিয়ে রাজধানী ঢাকায় ছুটছেন মানুষ। গতকাল সকাল থেকে বাংলাবাজার ঘাটে কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এ ছাড়াও শিমুলিয়া ঘাট থেকে গতকালও বাড়ি ফিরেছেন অনেকেই। তবে স্বাস্থ্যবিধির বালাই ছিল না কোনো ঘাটেই। এদিকে দূরপাল্লার বাস বন্ধ থাকায় বিভিন্ন যানবাহনে তিন থেকে চার গুণ বাড়তি ভাড়া গুনতে হচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার যাত্রীদের।

দৌলতদিয়ায় মানুষের ঢল : রাজবাড়ী প্রতিনিধি জানান, ঈদের ছুটি শেষে রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ফেরিঘাট দিয়ে ঢাকায় ফিরতে শুরু করেছে মানুষ। গতকাল দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড় ছিল। দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে দায়িত্বরত ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের স্টেশন অফিসার শঙ্কর কুমার বিশ্বাস বলেন, ঘাট এলাকায় দুর্ঘটনা এড়াতে ফায়ার সার্ভিস কাজ করে যাচ্ছে।

ঢাকামুখী যানবাহন ও যাত্রীদের চাপ : ঈদের ছুটি শেষে পাটুরিয়া ঘাটে বেড়েছে কর্মমুখী মানুষের চাপ। ফেরিতে নদী পার হয়ে গণপরিবহন না পেয়ে ভোগান্তিতে পড়েন এসব যাত্রী। প্রাইভেটকার, মোটরসাইকেল, সিএনজিসহ নানা পরিবহনে গন্তব্যে পৌঁছতে অতিরিক্ত ভাড়া গুনতে হচ্ছে তাদের। পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে ছোট-বড় মিলে ১৬টি ফেরি প্রস্তুত রয়েছে। চাহিদা অনুযায়ী বাড়ানো-কমানো হচ্ছে ফেরির সংখ্যা-জানিয়েছে বিআইডব্লিউটিসি।

বাসে ও ট্রাকে ফিরছে মানুষ : বগুড়া থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, বগুড়া থেকে ঢাকায় ছেড়ে গেছে দূরপাল্লার যানবাহন। ঈদের পরের দিন শনিবার রাত থেকে বগুড়া অঞ্চলের সড়ক মহাসড়ক দিয়ে দূরপাল্লার বাস চলাচল করতে দেখা গেছে। অভ্যন্তরীণ রুট ছাড়াও ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা ভাড়া দিয়ে নন ব্র্যান্ডের পরিবহন চলাচল করতে দেখা যায়। শনিবারের পর রবিবারও বগুড়া শহরের চারমাথা, ঠনঠনিয়া বাসস্ট্যান্ড, বনানী ও তিনমাথা থেকে বাস চলাচল করেছে। অনেকেই আবার বাসের পরিবর্তে দুর্ভোগ নিয়ে ট্রাকে করে ঢাকায় নিজ নিজ কর্মে ফিরতে দেখা গেছে।

রাজধানীমুখী মানুষের দুর্ভোগ চরমে : বরিশাল থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, ঈদ শেষে বরিশাল থেকে রাজধানীমুখী মানুষের দুর্ভোগ চরমে উঠেছে। লঞ্চ বন্ধ থাকায় বাসের ওপর চাপ পড়েছে। মানুষের কাছ থেকে বেশি ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। পুলিশ বলছে, তাদের কাছে অভিযোগ দেওয়া হলে নেওয়া হবে ব্যবস্থা। গতকাল সকাল ১০টা থেকে বরিশাল নগরীর নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনাল এবং রূপাতলী বাস টার্মিনাল এলাকা যাত্রীদের চাপে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। সিএনজি, অটোরিকশা এবং মাইক্রোবাসে দুটি বাস টার্মিনাল এলাকায় যানজটের সৃষ্টি হয়।

বঙ্গবন্ধু সেতুতে যানবাহনে চাপ : সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, সকাল থেকে বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম সংযোগ মহাসড়কে বেড়েছে যানবাহনে চাপ। সরকারি নির্দেশ অমান্য করে দূরপাল্লার যাত্রীবাহী বাসও যাত্রী নিয়ে চলাচল করছে। সিরাজগঞ্জ শহর থেকেও যাত্রী নিয়ে বাস ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে গেছে। বাসের পাশাপাশি ট্রাক, মাইক্রোবাস পিকআপ ভ্যান ও ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেযোগে ঢাকায় ফিরছেন কর্মজীবীরা। বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মোসাদ্দেক হোসেন জানান, বগুড়া, জয়পুরহাট ও রাজশাহীসহ বিভিন্ন জেলা থেকে যাত্রী বাস ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। বাসগুলো সেতুর পশ্চিমপাড়ে আসার পর আমরা ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছি।

যদি ওইসব জেলা থেকে বাসগুলো ছেড়ে দেওয়া না হতো তাহলে সেতুর কাছে এসে চাপ পড়ত না। এখন আমরা মহামুসিবতে পড়েছি। অন্তত একশর বেশি যাত্রীবাস ফেরত পাঠানো হয়েছে।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর