সোমবার, ১৭ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

প্রচারণার নামে অনিয়মের অভিযোগ স্বাস্থ্য অধিদফতরে

নিজস্ব প্রতিবেদক

করোনায় যখন স্বাস্থ্য খাতে নানামুখী সংকটের কথা আলোচিত হচ্ছে ঠিক তখন প্রচারণার নামে প্রায় ৫০ কোটি টাকা লোপাটের আয়োজন চলছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ৯টি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আগামী ১০ জুনের মধ্যে এই টাকা উত্তোলন করার সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। আর এই দুর্নীতির সঙ্গে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিদের জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রচারণার দায়িত্ব পালন করে লাইফ স্টাইল, হেলথ এডুকেশন অ্যান্ড প্রমোশন বিভাগ। একজন লাইন ডিরেক্টরের নেতৃত্বে এই বিভাগটি পরিচালিত হয়। চলতি অর্থবছরে প্রচারণার জন্য মোট ১০টি ক্ষেত্র চিহ্নিত করা হয়। একনেক অনুমোদিত অপারেশন প্লান অনুযায়ী তিন থেকে পাঁচ মাসব্যাপী এসব বিষয়ে সচেতনতামূলক প্রচারণা করার কথা। সর্বোচ্চ ৪ কোটি থেকে ১ কোটি পর্যন্ত বিভিন্ন প্রচারণায় ব্যয় ধরা হয়েছে। এ সংক্রান্ত আগ্রহ ব্যক্তকরণের জন্য গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। যেসব বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ‘এক্সপ্রেশন অব ইন্টারেস্ট’ চাওয়া হয় সেগুলো হলো- ১. ডায়াবেটিস এবং হাইপারটেনশন বিষয়ক সচেতনতা, ২. করোনা বিষয়ক সচেতনতা, ৩. জেলা পর্যায়ে ডিজিটাল তথ্য বোর্ড স্থাপন, ৪. রাস্তার খাবার, ভাজাপোড়া বিষয়ে দেশব্যাপী সচেতনতা, ৫. বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ বিষয়ে সচেতনতা, ৬. নিরাপদ খাদ্য বিষয়ে সচেতনতা, ৭. নবজাতকের পরিচর্যা বিষয়ে সচেতনতা, ৮. পানিবাহিত রোগ সম্পর্কে সচেতনতা, ৯. মাতৃমৃত্যু রোধকল্পে সচেতনতা, ১০. লবণ ও চিনি গ্রহণে সচেতনতা বিষয়ক প্রচারণা।

জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহের মধ্যে আগ্রহ ব্যক্তকরণের জন্য দরপত্রে সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। কিন্তু আগ্রহ ব্যক্তকরণের দরপত্র জমা দেওয়ার পরপরই মন্ত্রীর নির্দেশে সব প্রস্তাবনা মন্ত্রণালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সে সময় এ বিভাগের লাইন ডিরেক্টর ছিলেন ডা. মো. আবু জাহের। তিনি জানান, ‘মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, সব কাগজপত্র মন্ত্রী চেয়েছেন।’ দীর্ঘ তিন মাস এসব টেন্ডারের কাগজপত্র মন্ত্রণালয়ে আটকে থাকে। অথচ এ সময়ই প্রচারণা কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা ছিল। এ সময়ে লাইন ডিরেক্টর পদ থেকে ডা. মো. আবু জাহেরকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তার বদলে দুদকে অভিযুক্ত ডা. সাইফুল ইসলামকে লাইন ডিরেক্টর পদে পদায়ন করা হয়। উল্লেখ্য, ডা. সাইফুল দুর্নীতি দমন কমিশনের তালিকাভুক্ত সন্দেহভাজন। ২০১৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর কমিশন দায়েরকৃত একটি দুর্নীতি মামলার (মামলা নং-১৬) তিনি ৮ নম্বর আসামি। দুর্নীতি দমন কমিশন অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ পদে না দিতে এবং বিভাগীয় প্রধান বা লাইন ডিরেক্টর না করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে গত বছরের মার্চে লিখিত অনুরোধ জানায়। একই সময় কমিশন স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি তালিকা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রেরণ করে। এই তালিকার ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করে এবং কিছু কর্মকর্তাকে বদলি করে। কিন্তু এর মধ্যেই ডা. সাইফুলকে গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়নে সবাই বিস্মিত হন। সে সময় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব ছিলেন মো. আবদুল মান্নান। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে মো. আবদুল মান্নান বলেন, ‘মন্ত্রীর অনুরোধে তাকে (সাইফুলকে) পদায়ন করা হয়।’

ডা. সাইফুল লাইন ডিরেক্টর হওয়ার পরপরই আবার প্রচারণা সংক্রান্ত টেন্ডার প্রক্রিয়া সচল হয়। কিন্তু ততদিনে এই টেন্ডারের কার্যকারিতাই নষ্ট হয়ে গেছে। জুনের মধ্যে তিন মাস প্রচারণা কার্যক্রম চালানোর সময় নেই। কিন্তু ডা. সাইফুলকে রুখবে কে? স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. খুরশীদ আলমকে এ ব্যাপারে একজন দরপত্রদাতা অভিযোগ করলে তিনি বলেন, ‘ডা. সাইফুল মন্ত্রীর খাস লোক। এ ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না।’ ঈদের আগের দিন তড়িঘড়ি করে ৯টি প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়। উল্লেখ্য, ৩০ জুন চলতি অর্থবছর শেষ হয়ে যাচ্ছে। ১০ জুনের মধ্যে চলতি অর্থবছরের সব কার্যক্রম শেষ করার নির্দেশনা আছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের। এর মধ্যে এ কাজ অসম্ভব। প্রচারণা না করে টাকা ভাগবাটোয়ারা করার জন্যই এটি করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এখন ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে এজি থেকে বিল উত্তোলন করা হবে বলে জানা গেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটি প্রচারণা কার্যক্রমে বলা হয়েছে ৪০টি উপজেলায় অ্যাডভোকেসি মিটিং হবে, ১০ মিনিটের নাটিকা হবে, ৩০ সেকেন্ডের একটি বিজ্ঞাপন বানিয়ে তা ৪০০ বার প্রচার করতে হবে। ২০টি বিল বোর্ড লাগতে হবে। ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যে এ কার্যক্রম সম্পন্ন করা অসম্ভব। অনেকে অভিযোগ করেছে, কাজ দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্টরা অগ্রিম ১০ থেকে ২৫ শতাংশ টাকা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নিয়েছেন। এ প্রক্রিয়ার সংগে মন্ত্রণালয়ের জন-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার নামও এসেছে। অভিযোগ উঠেছে, তার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এসব টেন্ডার ভাগবাটোয়ারা হয়েছে। এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও বিস্তর অভিযোগ। সম্প্রতি সরকারি চাকরি করে যারা বিভিন্ন ব্যবসায়িক কার্যক্রমে জড়িত তাদের একটি তালিকা তৈরি করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। ওই তালিকায় এই জনসম্পৃক্ত কর্মকর্তার নাম আছে। সরকারি চাকরি করেও তিনি একটি কোচিং সেন্টার পরিচালনা করেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তাধীন। আর্থিক লেনদেনের বিনিময়ে কাজ পাইয়ে দেওয়া হয়েছে এ জন্যই পুরো টেন্ডার প্রক্রিয়ায় পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন ২০০৬ ও পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা ২০০৮ অনুসৃত হয়নি। টেন্ডারে আর্থিক প্রস্তাব উন্মুক্তকরণের সময়ে কারিগরি প্রস্তাবের নম্বর বলা বাধ্যতামূলক। কিন্তু ডা. সাইফুল সরকারি আইন ও বিধিবিধান না মেনে আর্থিক প্রস্তাব উন্মুক্ত করেছেন। এ সময় তিনি কারিগরি প্রস্তাবে প্রাপ্ত নম্বর বলেননি। পরে যে প্রতিষ্ঠানের সংগে তার লেনদেনের অংক চূড়ান্ত হয়েছে, সেই প্রতিষ্ঠানকে নম্বর কমবেশি করে কাজ দিয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের লাইফ স্টাইল, হেলথ এডুকেশন অ্যান্ড প্রমোশনের এরকম দুর্নীতির তথ্য নতুন নয়। গত অর্থবছরও একই ঘটনা ঘটেছিল।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর