মঙ্গলবার, ১৮ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

মানসিক বিকৃতি চরমে

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যের ছড়াছড়ি, নিয়ন্ত্রণের তাগিদ বিশেষজ্ঞদের

জিন্নাতুন নূর

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অসুস্থ মানসিকতা প্রদর্শনের মহামারী চলছে। সাধারণ পোস্টে  কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যের ঝড় বইছে। গুটিকয় বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষ অন্যদের বিষয়ে অশালীন বক্তব্য ও মন্তব্য করেই চলেছেন। ফলে দিন দিন সামাজিকভাবে হেয় হতে হচ্ছে অনেক নারীকে। এ ধরনের সাইবার বুলিংয়ে প্রতিনিয়ত জন্ম নিচ্ছে নানা ধরনের সমস্যা। লেখাপড়া ছেড়ে দিতে হচ্ছে অনেক মেয়েকে। বিঘ্ন ঘটছে সামাজিক জীবনের। পারিবারিক সম্মানহানির ভয়ে আত্মহত্যার পথও বেছে নিচ্ছে কেউ কেউ। এসব যেন দেখার কেউ নেই। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন সমাজে পচন ঠেকাতে এখনই সাইবার বুলিং কঠোর হাতে দমন প্রয়োজন।

জানা যায়, সাধারণ নারীদের তুলনায় বেশি হেনস্তার শিকার হতে হচ্ছে তারকা নারীদের। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক অভিনেত্রী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, একসময় তিনি ফেসবুকে নিয়মিত ছবি প্রকাশ করতেন। কিন্তু ছবিতে তার মেকআপ-গেটআপ নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করা শুরু করেন অনেকেই। তার পরিবার-পরিজন নিয়েও মন্তব্যকারীরা কথা তুলতে থাকেন। এক পর্যায়ে অশালীনতার সীমা ছাড়িয়ে গেলে মন্তব্যকারীদের তিনি ব্লক করে দিতে বাধ্য হন। বর্তমানে সাইবার বুলিং ধারণ করেছে এক জঘন্য রূপ। দেশে সাইবার বুলিংয়ে প্রবণতা বেড়েই চলছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সাইবার বুলিংয়ের শিকার পাঁচজন নারীর মধ্যে একজন নারী আত্মহত্যা করেন। বাংলাদেশে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীসহ ফেসবুক ব্যবহারকারীদের একটি বড় অংশ সাইবার বুলিংয়ের শিকার। তথ্য বলছে- দেশের ৪৯ শতাংশ স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থী সাইবার বুলিংয়ের নিয়মিত শিকার। ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে, দেশের তিন-চতুর্থাংশ নারীই  সাইবার বুলিংয়ের শিকার। দেশের প্রায় ১২ কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর মধ্যে উল্লেখ সংখ্যক নারী, আর এর উল্লেখ সংখ্যকই অনলাইন ব্যবহার করতে গিয়ে প্রায় হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। দেশে উল্লেখ সংখ্যক নারী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করলেও পুরুষদের মতো জোরালোভাবে তাদের মতামত প্রকাশ করতে খুব কমই দেখা যায়। নারীদের অনেকেই জানান, পাবলিক পোস্টে মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে তাদের নানা ধরনের হয়রানির শিকার হতে হয়। লক্ষ্য করে দেখা যায় যে- ফেসবুকে একজন তারকা নারীর কোনো পোস্টের কমেন্ট সেকশনে গেলে তার দেহ, পোশাক কিংবা পরিবার নিয়ে অসংখ্য কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করা হয়। এ ধরনের অযাচিত, অশোভন ও অপ্রাসঙ্গিক মন্তব্যের কারণে ব্যক্তিগতভাবে ভুক্তভোগীরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। আজকাল অনেক শিক্ষিত মানুষ বুঝে না বুঝে এভাবে অনলাইনে হয়রানি করার মাধ্যমে সাইবার বুলিংয়ের মতো অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাইবার বুলিং যে করে অর্থাৎ উত্ত্যক্তকারীর কোনো ধরনের নাম-পরিচয় পাওয়া যায় না। অর্থাৎ সচরাচর ফেক আইডি দিয়ে নারীদের বিভিন্ন ধরনের ছবি সংগ্রহ করে পরবর্তীতে ব্ল্যাকমেইল করা হচ্ছে। অনেক সময় মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার জন্য সাইবার বুলিং করা হচ্ছে। সাইবার বুলিংয়ের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য অনেকেই এখন নিজের প্রোফাইল লক করে রাখছেন। সাইবার বিশেষজ্ঞ ও পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এ ধরনের বুলিংয়ের শিকার হওয়ার পরও অনেকে আইনি সহায়তা নিতে চান না। ফলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ ধরনের সাইবার অপরাধীরা শাস্তির মুখোমুখি হন না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নারীর প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও দায়বদ্ধতার অভাব, সর্বোপরি মানবিক বোধের অভাব থেকে ফেসবুকে যা ইচ্ছা তাই লিখে যাচ্ছেন কেউ কেউ। তাদের মতে, যারা নারীর প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ ধরনের বিদ্বেষমূলক মন্তব্য ছড়ায় তারা অসুস্থ মানসিকতার, নিজেদের বিকৃত স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ব্যবহার করে। ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আক্রমণাত্মক, মিথ্যা বা ভীতি প্রদর্শক তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ ইত্যাদি ক্ষেত্রে ২৫(১) ধারায় বলা হয়েছে- যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ডিজিটাল মাধ্যমে ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে এমন কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ করেন যা আক্রমণাত্মক এবং মিথ্যা হওয়ার পরও কোনো ব্যক্তিকে বিরক্ত বা অপমান করে তাহলে তা হবে অপরাধ। এক্ষেত্রে শাস্তি হিসেবে অপরাধী সর্বোচ্চ ৩ বছরের কারাদন্ড বা সর্বোচ্চ ৩ লাখ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান খন্দকার ফারজানা রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নারীদের সম্মান ও সমতার চোখে দেখার ধারণাটা মূলত সমাজ থেকে উঠে আসতে হয়। আমাদের সমাজ এখনো সবাইকে সে শিক্ষা দিতে পারছে না। নারীকে এখনো সমাজে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের দৃষ্টিতে দেখা হয়। নারীকে এই ভিন্নদৃষ্টিতে দেখার অবস্থা যতদিন পরিবর্তন না হবে ততদিন পরিস্থিতির উন্নতি আশা করাটা দুরাশা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর