শুক্রবার, ২১ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

খুনের মামলায় সাবেক এমপি আটক

জমির জন্য দুই ভাইকে হত্যার চেষ্টা, জর্ডান থেকে আসার পর সাহিনুদ্দিনকে খুন, ভিডিও ফুটেজ দেখে খুনিদের শনাক্ত, জবানবন্দির ভিত্তিতে র‌্যাব ধরেছে আউয়ালকে

নিজস্ব প্রতিবেদক

খুনের মামলায় সাবেক এমপি আটক

হত্যা মামলায় গ্রেফতার সাবেক এমপি আউয়ালসহ অভিযুক্তরা। দিনদুপুরে কুপিয়ে হত্যার দৃশ্য -বাংলাদেশ প্রতিদিন

এক বছর আগে একই জমির জন্য দুই ভাই সাহিনুদ্দিন ও মাইনুদ্দিনকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল। মামলাও করে পরিবার। কিন্তু কারও কোনো শাস্তি হয়নি। কয়েক বছর আগে জর্ডানে ছিলেন সাহিনুদ্দিন (৩৩)। দেশে এসে বাবার রেখে যাওয়া সম্পদ দেখাশোনা করছিলেন। সম্প্রতি তাকেই খুন করা হয়। ভিডিও ফুটেজ দেখে খুনি শনাক্ত করেছে পুলিশ। গ্রেফতার একজনের জবানবন্দি ও তথ্য-প্রযুক্তির সহায়তায় লক্ষীপুর-১ আসনের সাবেক এমপি এম এ আউয়ালকে আটক করেছে র‌্যাব। 

র‌্যাব জানিয়েছে, খুনের মূল পরিকল্পনাকারী আউয়াল। আর মাঠে হত্যায় নেতৃত্ব দেয় সুমন। খুন শেষে সুমন ফোন করে আউয়ালকে জানায়- ‘স্যার ফিনিশ’। র‌্যাব ও পুলিশের অভিযানে খুনে জড়িত থাকার অভিযোগে এ পর্যন্ত গ্রেফতার হয়েছেন সাতজন। গতকাল ভোরে ভৈরব সদরের একটি মাজার থেকে সাবেক এমপি আউয়ালকে আটক করা হয়। র‌্যাবের পৃথক অভিযানে অভিযুক্ত জহিরুল ইসলাম বাবুকে পটুয়াখালীর বাউফল থেকে এবং ১৯ মে রাতে হাসানকে চাঁদপুরের হাইমচর এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। এর আগে ১৬ মে বিকালে সাহিনুদ্দিনকে হত্যা করা হয়। রাজধানীর পল্লবীর ১২ নম্বর ডি-ব্লকে ৩১ নম্বর রোডের ৩৬ নম্বর বাড়ির সামনে তার ছয় বছরের ছেলের সামনেই চাপাতি ও রামদা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয় তাকে। সাহিনুদ্দিনকে হত্যার ঘটনায় ওই রাতেই তার মা আকলিমা বেগম ২০ জনকে আসামি করে মামলা করেন। গত বছর হত্যাচেষ্টার অভিযোগে যে মামলা আকলিমা করেছিলেন, সেই মামলার অধিকাংশই এই হত্যা মামলার আসামি।

জানা গেছে, পল্লবীর উত্তর কালশীর সিরামিক এলাকার বাসিন্দা আকলিমার দুই ছেলের মধ্যে সাহিনুদ্দিন ছোট। তার বড় ছেলে মাইনুদ্দিন। বাউনিয়া মৌজার উত্তর কালশীর বুড়িরটেকের আলীনগর আবাসিক এলাকায় প্রায় পাঁচ কোটি টাকার ১০ একর জমি রেখে গেছেন আকলিমার প্রয়াত স্বামী। আর সেই জমি দখল করতেই তার সন্তানকে খুন করা হয়েছে বলে আকলিমার অভিযোগ।

আকলিমা বলেন, আগে যাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন জামিনে বের হয়ে এলাকায় তারা বুক ফুলিয়ে চলে। আমরা সব সময় ভয়ে থাকতাম। যা ভাবতাম শেষে সেটাই হলো। আমার ছেলেকে তারা হত্যা করল। তার স্বামীর রেখে যাওয়া ১০ একর জায়গা দখলের চেষ্টা করে আসছিলেন হ্যাভেলি প্রপার্টি ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের মালিক ও সাবেক এমপি আউয়াল।

তিনি জানান, গত বছরের জুলাইয়ে তার স্বামীর মৃত্যুর পর জমিটি দখল করতে তার দুই ছেলেকেই হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। আর সে জন্যই গত বছরের নভেম্বরে তার দুই ছেলের ওপর হামলা হয়েছিল। সাহিনুদ্দিন ও মাইনুদ্দিনকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ এনে গত বছরের ২৬ নভেম্বর মামলা করেছিলেন। গত ১৬ মে সাহিনুদ্দিনকে ফোন করে ডেকে নেওয়া হয়েছিল বিবাদ মিটমাটের কথা বলে। ডেকে নিয়ে করা হয় হত্যা। তিনি বলেন, এ হত্যাকান্ডের ৫/৬ দিন আগে আমি নিরাপত্তা চেয়ে থানায় জিডি করেছিলাম।

এদিকে আউয়ালসহ তিনজনকে আটকের ঘটনায় গতকাল বিকালে রাজধানীর কারওয়ানবাজারে র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সংস্থার লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, এম এ আউয়াল রাজধানীর পল্লবীতে সন্তানের সামনে বাবাকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যাকান্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ও হত্যা মামলার এক নম্বর আসামি। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার ব্যক্তিরা জানিয়েছেন- মূলত জমি সংক্রান্ত বিরোধের জেরে সাহিনুদ্দিনকে হত্যার ঘটনা ঘটানো হয়। ঘটনার ৪/৫ দিন আগে রাজধানীর কলাবাগানে নিজের অফিসে সাবেক এমপি আউয়াল, তার দুই সহযোগী তাহের ও সুমন হত্যার চূড়ান্ত পরিকল্পনা করেন। মাঠপর্যায়ে হত্যাকান্ড বাস্তবায়নের জন্য সুমনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। সুমনের নেতৃত্বে প্রায় ১০-১২ জন সক্রিয়ভাবে কিলিং মিশনে অংশ নেয়। ঘটনা শেষে সুমন মূল পরিকল্পনাকারী আউয়ালকে ফোন করে জানায়, ‘স্যার ফিনিশ’। এরপর হত্যায় জড়িতরা দেশের বিভিন্ন স্থানে গা-ঢাকা দেয়। ঘটনার পরদিন ১৭ মে দিপু নামে এক আসামিকে টাঙ্গাইলের নাগরপুর থেকে গ্রেফতার করে র‌্যাব-৪। পরে তাকে পল্লবী থানায় সোপর্দ করা হয়।

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, আউয়াল একজন আবাসন ও জমি ব্যবসায়ী। তার ছত্রছায়ায় সুমন সন্ত্রাসী গ্রুপ দ্বারা জমি দখল ও আধিপত্য বিস্তার করত। গ্রেফতার হওয়া আউয়ালের কাছ থেকে তারা মাসভিত্তিক ১০/১২ হাজার টাকা মাসোয়ারা পেত এবং ক্ষেত্রবিশেষে কাজ অনুযায়ী অতিরিক্ত টাকা পেত। এই সুমন এলাকায় চাঁদাবাজি, ছিনতাই, রিকশা টোকেন বাণিজ্য, মাদক, জুয়াসহ অন্যান্য অপরাধমূলক কর্মকান্ড চালাত।

গত বুধবার রাতে পৃথক অভিযানে পল্লবী ও রায়েরবাগ থেকে সাহিনুদ্দিন হত্যা মামলায় আরও দুই অভিযুক্তকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) মিরপুর বিভাগ। তারা হলো সুমন ব্যাপারী ও রকি তালুকদার।

গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে ডিবি জানায়, সম্প্রতি দাওয়াত দিয়ে ডেকে পল্লবীর ডি ব্লকের ৩২ নম্বর সড়কের ৫ নম্বর বাড়ির সামনে সাহিনুদ্দিনের ওপর নির্মম হামলা চালায় কয়েকজন। চাপাতি, ধারালো অস্ত্র দিয়ে হাত পা শরীর মাথায় কুপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে পালিয়ে যায় খুনিরা। এ ঘটনার পর রাতেই নিহতের মা আকলিমা বেগম সাবেক এমপি আওয়ালকে প্রধান আসামি করে ২০ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা আরও ১০-১২ জনের বিরুদ্ধে পল্লবী থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। ওই দিনই পল্লবী এলাকা থেকে মুরাদ নামে একজনকে গ্রেফতার করে থানা পুলিশ।

মামলার এজাহারে আকলিমা বেগম উল্লেখ করেছেন, গত ১৬ মে বিকাল ৪টার দিকে সুমন ও টিটু নামের দুই যুবক সাহিনুদ্দিনকে জমির বিরোধ মেটানো হবে জানিয়ে ফোন করে ডেকে নেয়। সাহিনুদ্দিন মোটরসাইকেলে পল্লবীর ডি-ব্লকের ৩১ নম্বর সড়কের ৪০ নম্বর বাসার সামনে গেলে সুমন ও টিটুসহ ১৪-১৫ জন মিলে তাকে টেনেহিঁচড়ে ওই বাড়ির গ্যারেজে নিয়ে যায়। এ সময় সাহিনুদ্দিনের ছয় বছরের ছেলে মাশরাফি গেটের বাইরে ছিল। গ্যারেজে ঢুকিয়ে তাকে সন্ত্রাসীরা চাপাতি, চায়নিজ কুড়াল, রামদা দিয়ে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে। এরপর তাকে ওই গ্যারেজ থেকে বের করে ৩৬ নম্বর বাড়ির সামনে আবার কুপিয়ে ফেলে রেখে চলে যায়। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। পরে লাশ ময়নাতদন্তের জন্য শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর