শনিবার, ২২ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

বেরিয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর তথ্য

পল্লবী হত্যাকান্ড : সাবেক এমপি আউয়াল চার দিনের রিমান্ডে, আসামি মানিক বন্দুকযুদ্ধে নিহত

নিজস্ব প্রতিবেদক

বেরিয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর তথ্য

সাবেক এমপি এম এ আউয়াল

২০১৪ সালে বাইচান্স এমপি হয়েছিলেন বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের সাবেক মহাসচিব এম এ আউয়াল। এর আগে দেশের একজন প্রভাবশালী হাসপাতাল ব্যবসায়ীর তদবিরে বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের মহাসচিব হন তিনি। তবে এমপি বনে যাওয়ার পর থেকে ওই ব্যবসায়ীকেই এড়িয়ে চলতেন। নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী তৈরি করে জোরপূর্বক অন্যের জমি দখল করতেন তিনি। রাজধানীর কলাবাগান বাসস্ট্যান্ডের দক্ষিণে সুলতানা টাওয়ারে হ্যাভেলি প্রপার্টিজের অফিস খুলে হোয়াইট কালার ক্রিমিনাল হয়ে পর্দার আড়াল থেকে অপরাধের কলকাঠি নেড়েছেন। তবে সর্বশেষ লক্ষীপুর-১ আসনের জটিলতার কারণে পার্টির চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী আউয়ালকে মহাসচিব পদ থেকে সরিয়ে দেন। পরে তিনি  জাকের পার্টি থেকে প্রার্থী হলেও ঋণ খেলাপি হওয়ায় প্রার্থিতা বাতিল হয়।

গত ৭ মে এম এ আউয়ালকে আসামি করে রাজধানী ঢাকার পল্লবী থানায় মামলা করেন মেজর মোস্তফা (অব.)। সেখানে বাউন্ডারি ভেঙে জমি দখলের অভিযোগ আনেন তিনি।

রাজধানীর মিরপুরে ইস্টার্ন হাউজিং এলাকায় র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মো. মানিক (৩২) নামে এক যুবক নিহত হয়েছে। সে সাবেক এমপি এম এ আউয়ালের ভাড়াটে কিলার ছিল বলে জানিয়েছে র‌্যাব। ছেলের সামনে বাবাকে খুনের ঘটনার সময় এই মানিকও ছিল। অন্যদিকে, এই হত্যাকান্ডে জড়িত অভিযোগে গ্রেফতার লক্ষীপুর-১ আসনের সাবেক এমপি ও তরিকত ফেডারেশনের সাবেক মহাসচিব এম এ আউয়ালসহ (৫০) তিনজনকে চার দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দিয়েছে আদালত। গত ১৬ মে পল্লবীতে শিশু সন্তানের সামনে সাহিনুদ্দিন নামে এক ব্যবসায়ীকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, গত রবিবার বিকালে রাজধানীর পল্লবীর ডি-ব্লকের ৩১ নম্বর রোডে দুই তরুণ দুই পাশ থেকে এক ব্যক্তিকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপাচ্ছেন। এক পর্যায়ে ওই ব্যক্তি মাটিতে লুটে পড়েন। এরপর হামলাকারীদের একজন চলে যান। অন্যজন ওই ব্যক্তির ঘাড়ে কোপাতে থাকেন মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত। র‌্যাব গত বুধবার গভীর রাতে কিশোরগঞ্জের ভৈরবে অভিযান চালিয়ে সাবেক এমপি আউয়ালকে গ্রেফতার করে। এর আগের রাতে চাঁদপুরের হাইমচর থেকে নূর মোহাম্মাদ হাসান (১৯) ও পটুয়াখালীর বাউফল থেকে জহিরুল ইসলাম ওরফে বাবুকে (২৭) গ্রেফতার করে। সুমন বেপারীসহ দুজনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। এ নিয়ে ওই হত্যায় সাতজনকে গ্রেফতার করা হয়।

নিহত সাহিনুদ্দিনের মা আকলিমা বেগমের অভিযোগ, পল্লবীর ১২ নম্বর সেকশনের বুড়িরটেকে (আলীনগর) তার ও তাদের স্বজনদের ১০ একর জমি রয়েছে। আশপাশের কিছু জমি দখল করে সেখানে হ্যাভেলি প্রপার্টিজ ডেভেলপার লিমিটেড নামের আবাসন প্রকল্প গড়ে তোলেন আউয়াল। তাদের জমি জবর-দখলে ব্যর্থ হয়ে আউয়াল ভাড়াটে সন্ত্রাসী দিয়ে সাহিনুদ্দিনকে খুন করেছেন। গত বছরের নভেম্বরেও সন্ত্রাসীরা সাহিনকে কুপিয়ে আহত করেছিল। সেই ঘটনায় করা মামলায় পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করেনি। উল্টো আউয়ালের দেওয়া মিথ্যা মামলায় সাহিনুদ্দিনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। সপ্তাহখানেক আগে সাহিনুদ্দিন জামিনে মুক্তি পান।

র‌্যাব বলছে, এম এ আউয়ালের নির্দেশেই সুমন নামে এক সন্ত্রাসীর নেতৃত্বে সাহিনুদ্দিনকে হত্যা করা হয়। আউয়াল কিলারদের টাকা দিয়ে এই হত্যা করিয়েছেন। বন্দুকযুদ্ধে মানিক নিহত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন র‌্যাব-৪ অধিনায়ক (সিও) অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মোজাম্মেল হক।

মোজাম্মেল হক জানান, বৃহস্পতিবার (২০ মে) রাতে মিরপুরের ইস্টার্ন হাউজিং এলাকায় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযানে যান র‌্যাব সদস্যরা। সেখানে সাহিনুদ্দিন হত্যার সঙ্গে জড়িত কয়েকজন আসামি অবস্থান করছিল। র‌্যাবের উপস্থিতি টের পেয়ে তারা গুলি চালাতে শুরু করে। র‌্যাব সদস্যরাও আত্মরক্ষার্থে গুলি চালান। পরে একজনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে দ্রুত তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে জানা যায়, তার নাম মানিক। সে পল্লবীর সাহিনুদ্দিন হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত পাঁচ নম্বর আসামি। এর আগে ২০ মে র‌্যাব সাবেক এমপি আউয়ালসহ তিনজনকে এবং ডিবি ও থানা পুলিশ চারজনকে গ্রেফতার করে। র‌্যাবের মিডিয়া উইং পরিচালক খন্দকার আল মঈন জানান, জমি নিয়ে বিরোধের জেরে এমপি আউয়ালের নির্দেশে সুমনের নেতৃত্বে সাহিনুদ্দিনকে খুন করা হয়। হত্যার জন্য আউয়াল কিলারদের টাকা দিয়েছেন। তার কলাবাগানের অফিসে কিলারদের সঙ্গে বৈঠক করে হত্যার নির্দেশ দেওয়া হয়। মামলাটি বর্তমানে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের মিরপুর বিভাগ তদন্ত করছে।

রিমান্ডে সাবেক এমপি আউয়াল : মামলার তদন্ত কর্মকর্তার ১০ দিনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট নিবানা খায়ের জেসি গতকাল আউয়ালসহ তিনজনকে চার দিনের রিমান্ডের আদেশ দেন। রিমান্ডে নেওয়া অন্য দুই আসামি হলেন নূর মোহাম্মাদ হাসান (১৯) ও জহিরুল ইসলাম ওরফে বাবু (২৭)। র‌্যাব বলছে, এ খুনের মূল পরিকল্পনাকারী লক্ষীপুর-১ আসনের সাবেক এমপি ও তরিকত ফেডারেশনের সাবেক মহাসচিব এম এ আউয়াল। তার নির্দেশে স্থানীয় সন্ত্রাসী মনির, মানিক, সুমন বেপারী, হাসানসহ অন্যরা ৫ থেকে ৭ মিনিটের মধ্যে রামদা ও চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে সাহিনুদ্দিনকে হত্যা করে। এরপর সুমন মুঠোফোনে সাবেক এমপি আউয়ালকে জানান, ‘স্যার, ফিনিশ।’ মুঠোফোনের কল রেকর্ড পরীক্ষা করে র‌্যাব এ তথ্য পেয়েছে বলে বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়। র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন সাংবাদিকদের বলেন, ঘটনার চার-পাঁচ দিন আগে আউয়ালের কলাবাগানের অফিসে আসামি তাহের ও সুমন চূড়ান্ত পরিকল্পনা করে। পল্লবী এলাকার সন্ত্রাসী সুমনের নেতৃত্বে ১০-১২ জন হত্যায় অংশ নেয়। তাদের সহযোগী হিসেবে আরও কয়েকজন ছিল। আউয়াল জমি বেচাকেনা করতেন। সুমনের নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাসী গ্রুপ দিয়ে তিনি জমি দখল ও আধিপত্য বিস্তার করতেন। সুমন আউয়ালের কাছ থেকে প্রতি মাসে ১০-১২ হাজার টাকা পেতেন। ক্ষেত্রবিশেষ কাজ অনুযায়ী অতিরিক্ত টাকা পেতেন। সুমন এলাকায় চাঁদাবাজি, ছিনতাই, রিকশা টোকেন-বাণিজ্য, মাদক, জুয়াসহ অন্যান্য অপরাধমূলক কর্মকান্ড চালাত। তার বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য আইনে পল্লবী থানায় অন্তত ছয়টি মামলা রয়েছে। এম এ আউয়াল তরিকত ফেডারেশনের মহাসচিব থাকাকালে ২০১৪ সালে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ১৪-দলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে লক্ষীপুর-১ আসনে নৌকা প্রতীকে এমপি হন। ২০১৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তাকে তরিকত ফেডারেশনের মহাসচিব পদ থেকে অব্যাহতি দিলে তিনি ইসলামী গণতান্ত্রিক পার্টি নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন। তিনি এর চেয়ারম্যান।

সর্বশেষ খবর