মঙ্গলবার, ২৫ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

আমদানি বিটুমিনে পদে পদে ভেজাল

নিজস্ব প্রতিবেদক

ড্রামের গায়ে লেখা থাকে ‘মেড ইন ইউএই’। সাগরপথে আসা এসব বিটুমিন পৌঁছে যায় দেশের আনাচে কানাচে। শেষে এর প্রলেপ পড়ে সড়ক থেকে মহাসড়কে। আমদানিকারকরা দাবি করেন, আরব আমিরাতে উৎপাদিত এ বিটুমিন খুবই মানসম্মত, কোনো ভেজাল নেই। কিন্তু খাঁটি তথ্য হলো, সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) কোনো ধরনের বিটুমিন উৎপাদনই করে না, নেই কোনো বিটুমিন উৎপাদনের কারখানা।

অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসা তথ্য বলছে, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞায় থাকা মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরান থেকে সাগরপথে আমিরাতের বন্দরে নোঙর করে বিটুমিনের জাহাজ। বিটুমিনের সবকিছু ইরান থেকেই প্রস্তুত হয়ে আসে। বাকি থাকে লেবেল লাগানোসহ বিটুমিন ভেজাল বানানোর কাজ। একেকটি জাহাজ আমিরাত উপকূলে নোঙর করে। এখানে শুরু হয় বিটুমিনের সঙ্গে কেরোসিনসহ বিভিন্ন কেমিক্যাল-আবর্জনা মেশানোর কর্মযজ্ঞ। এরপর বাকি আনুষ্ঠানিকতা সেরে সেগুলো পুনর্যাত্রা করে বাংলাদেশের গন্তব্যে। আর আমিরাতে উৎপাদিত খাঁটি বিটুমিন পরিচয়ে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খালাস হচ্ছে লাখ লাখ টন নিম্নমানের ভেজাল বিটুমিন। বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা থাকা দেশ ইরানে উৎপাদিত বিটুমিন আমিরাত হয়ে বাংলাদেশে কীভাবে দেশে আসছে? কীভাবে বিটুমিনের সঙ্গে ভেজাল মিশিয়ে নিম্নমানের বিটুমিন দেশে নিয়ে আসছে সেসবসহ বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য-উপাত্ত উঠে এসেছে অনুসন্ধানে।

বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, সংযুক্ত আরব আমিরাতের নাম ব্যবহার করে নানা কৌশলে নিম্নমানের বিটুমিন আসছে বাংলাদেশে। যার ফলে রাস্তাগুলো টিকছে না। এক রাস্তা বারবার মেরামত করতে হচ্ছে। এতে গচ্চা যাচ্ছে সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকা। বিটুমিনের গ্রেড নির্ধারণ কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাকারিয়াও বলেছেন, বিটুমিন আমদানির প্রক্রিয়ায় গলদ আছে। যেখানে পদে পদে মানহীনতার ঝুঁকি আছে সেই আমদানিকে নিরুৎসাহ করার পক্ষে মত তাঁর।

বিটুমিন বা পিচ রাস্তা তৈরির অন্যতম অপরিহার্য উপাদান। চাহিদার তুলনায় দেশি উৎপাদন মাত্র ১৩ ভাগ। বাকি চাহিদা মেটাতে গড়ে উঠেছে আমদানিকারকদের সিন্ডিকেট। কিন্তু আমদানি বিটুমিনের মান নিয়ে অভিযোগ বিস্তর। খোদ সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোও আমদানি বিটুমিনকে নিরুৎসাহ করে আসছে। সড়কে ব্যবহার বেশির ভাগ বিটুমিনের ড্রামের গায়ে উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে লেখা থাকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের নাম। আমদানিকারকরাও একই কথা বলছেন। অনুসন্ধানে নেমে জানার চেষ্টা করা হয় কারা আসলে এ নিম্নমানের বিটুমিনের উৎপাদনকারী। জানা গেল ইউএই বিটুমিন উৎপাদনই করে না।

অনুসন্ধানের প্রথম পর্যায়ে ইউএইভিত্তিক বিটুমিন রপ্তানিকারক একটি প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে ঢুঁ মারেন এই প্রতিবেদক। প্রতিষ্ঠানটির নাম গ্লোবাল ইনফিনিটি জেনারেল ট্রেডিং এফজেডই। ওয়েবসাইটের তথ্যমতে, ২০১২ সাল থেকে ‘গ্যালাক্সি এনার্জি’ নামে প্রতিষ্ঠানটি আন্তর্জাতিকভাবে নিবন্ধিত। বিটুমিন রপ্তানির দিক থেকে নিজেদের দুবাইভিত্তিক নেতৃত্বদাতা দাবি করে প্রতিষ্ঠানটি উল্লেখ করে, বছরে প্রায় ২ লাখ টন বিটুমিন উৎপাদন করছে তারা।

এরপর বিটুমিনের ক্রেতা পরিচয়ে যোগাযোগ করা হয় প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীলদের সঙ্গে। বিক্রয় বিশেষজ্ঞ ও হিসাব ব্যবস্থাপক টিনা তাঘাভি তুলে ধরলেন তাদের ‘উৎপাদিত’ বিটুমিনের মান, দর এবং আনুষঙ্গিক তথ্য। ৮০-১০০ গ্রেডের বিটুমিন কিনতে চাইলে তিনি এর দাম জানান টনপ্রতি ১৭০ ডলার। ওয়েবসাইটে নিজেরা উৎপাদন করেন দাবি করলেও টিনা জানালেন, ইউএইর কোথাও তাদের বিটুমিনের কোনো প্লান্ট নেই। মূলত প্রতিবেশী একটি দেশ থেকে তাদের চাহিদামতো বিটুমিন আসে। ইরানের আল আব্বাস বন্দর থেকে বিটুমিনের জাহাজ সরাসরি এসে ভেড়ে ইউএইর জেবেল আলী পোর্টে।

টিনার সঙ্গে কথা হয় রবিবার (২৩ মে) সকালে। তিনি জানান, তাদের ব্র্যান্ডের নিবন্ধন দুবাইতে এবং এ শহরে তাদের প্রতিষ্ঠানের অফিসও আছে। বিটুমিন বিক্রয়, লেনদেন এবং রপ্তানি সংক্রান্ত সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় দুবাইতে। ওই শহরে প্রতিষ্ঠানের গুদামও রয়েছে। কিন্তু তারা বিটুমিন উৎপাদন করেন না। পণ্যটি আসে ইরান থেকে। দুবাইতে শুধু লেবেল লাগানোর কাজটি হয়। বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের জন্য তিনি কয়েকটি এলসির নথি দেখান। যে এলসির অধীনে ইতিমধ্যে বাংলাদেশে তারা ইরানি বিটুমিন রপ্তানি করেছেন। এমনকি বাংলাদেশের একাধিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাদের ব্যবসায়িক সম্পর্কের কথাও তুলে ধরেন টিনা। অবশ্য তিনি কোনো প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।

এবার যোগাযোগের পালা ইরানে। গতকাল সোমবার বেলা ১১টায় ইরানি একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। ইসফাহান বিটুমিন প্রোডাকশন কোম্পানি নামে প্রতিষ্ঠানটির ঠিকানা ইরানের ইসফাহানের সেগঝি ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন। বছরে প্রায় ২ লাখ টন বিটুমিন উৎপাদনের ধারণক্ষমতা রয়েছে। প্রতিষ্ঠানের এক বিক্রয় কর্মকর্তার কাছে জানতে চাই, বাংলাদেশ থেকে পাওয়া অর্ডার কীভাবে তারা রপ্তানি করবেন? তিনি জানালেন, পুরো প্রক্রিয়াটি তারাই ব্যবস্থা করে থাকেন। তিনি বলেন, নিয়মিতই তারা বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে বিটুমিন রপ্তানি করছেন। তবে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা থাকায় সরাসরি এটি করা যায় না। তাই নিকটবর্তী ইউএইর বিভিন্ন বন্দর ব্যবহার করেন। এজন্য ইউএইতে অবস্থানরত বিভিন্ন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে লিয়াজোঁ করতে হয় তাদের।

এদিকে ইউএইতে বাংলাদেশ কনস্যুলেট সূত্রও নিশ্চিত করে বলেছেন, দেশটি বিটুমিন উৎপাদন করে না। পাশের দেশ থেকে বিটুমিনের চালান সে দেশে ঢোকার পর সেগুলো রিফাইন হয়। তারপর বিভিন্ন দেশে পুনরায় রপ্তানির প্রক্রিয়া শুরু হয়। কনস্যুলেট সূত্র জানান, আবুধাবি, হামরিয়াহ উন্মুক্ত জোন, ফুজাইরাহ এবং আজমানে রিফিলিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ইউএই থেকে বিটুমিন বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়। আরব আমিরাতে একটি বিটুমিন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত প্রবাসী শ্রমিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমিরাতে বিটুমিন তৈরির কোনো কারখানা নেই কিংবা রিফাইনারি নেই। বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা থাকায় ইরান থেকে চোরাপথে আমিরাতে বিটুমিন আনা হয়। সে বিটুমিন বিভিন্ন মোড়কে আরব আমিরাতের নাম ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশে সরবরাহ করা হচ্ছে।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রতিবেশী দেশ থেকে আনা বিটুমিনগুলো সেখানে ড্রাম কিংবা বাল্কে ভরে রপ্তানি করা হয় অন্যান্য দেশে। দাম কমানোর জন্য সেখানে বিটুমিনের সঙ্গে মেশানো হয় অন্যান্য উপাদান। একে তো বাতাস ঢুকে বিটুমিনের মান আরও খারাপ হয়, তার ওপর ক্ষতিকর উপাদান মেশানোর কারণে সেগুলো আলকাতরার চেয়েও খারাপ হয়ে যায় বলে মনে করেন যোগাযোগ ও বিটুমিন বিশেষজ্ঞরা।

বিটুমিনের গ্রেড নির্ধারণ কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাকারিয়া বলেন, কোনো রাস্তার ধারে যদি একটি বিটুমিনের ড্রাম ফেলে রাখা হয় কিছুদিন পর দেখবেন সেটি শক্ত হয়ে গেছে। বাতাস ঢুকলে বিটুমিনের মান পরিবর্তন হবেই। এজন্য সবচেয়ে উত্তম হলো বিদেশ থেকে না এনে যদি দেশেই উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায়। সেখান থেকে সরাসরি এনে যথাযথ মান ঠিক রেখে যদি সংশ্লিষ্ট এলাকায় ব্যবহার করা যায় তা হলেই বিটুমিনের রাস্তা টিকবে।

তাঁর পরামর্শ, ২০৪১ সালের উন্নত দেশের উপযোগী রাস্তা নির্মাণে, আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে বাড়াতে হবে দেশি আন্তর্জাতিক মানের বিটুমিন উৎপাদন। আর সেটি দেশে সম্ভব বলেও মনে করছেন এই বিশেষজ্ঞ।

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, আবুধাবিতে এত তেল নেই। সে হিসেবে আশপাশের কোনো দেশ নিম্নমানের বিটুমিন ছেড়ে দিচ্ছে। সেগুলোই আমাদের দেশে ঢুকছে। তার মানে আন্তর্জাতিক বাজার এবং বিটুমিনের সরবরাহ নিয়ে আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে কেনাবেচা হওয়ায় এর মূল উৎপাদক দেশও চিহ্নিত করা যায় না। তিনি বলেন, মধ্যস্থতা করার কারণে শুধু খরচই বাড়ছে না বিটুমিনের মান আরও খারাপ হয়ে যাচ্ছে।

বিটুমিন বিশেষজ্ঞ ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) সহকারী অধ্যাপক ড. নাজমুস সাকিব বলেন, ইউএই থেকে বিটুমিন আমদানি হয় এ ধরনের গুজব শোনা যায়। মান নিয়ন্ত্রণ করা হয় না। মূলত এসব বিটুমিন অন্য একটি দেশ থেকে একটি প্রক্রিয়ায় এনে ইউএই ব্র্যান্ডিং করে। তারপর সেগুলো বাংলাদেশে আনা হচ্ছে। বিটুমিন এমন একটি পণ্য যা কোনোভাবেই কোন দেশের উৎপাদিত তা স্পষ্ট করা সম্ভব নয়। ড্রামের গায়ে তো যে কোনো কিছুই লিখে দেওয়া যেতে পারে। লিখে দিলেই যে এটির উৎপাদক ইউএই হয়ে যাবে তা মনে করার সুযোগ নেই। যদি আমরা একটি বায়োলজিক্যাল মেটারিয়ালের সোর্সটা না জানি তার মান আগেই বোঝা মুশকিল।

বিশ্লেষকরা আরও বলছেন, অজানা উৎস থেকে আসা এসব বিটুমিন কোনোরকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই দেশে আসছে, আর ব্যবহার হচ্ছে বেশির ভাগ সড়কে। যার ফলে সড়কের বেহাল অবস্থা সব সময়। সড়ক সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশে সড়কের দুঃখই হলো আমদানি করা ভেজাল বিটুমিন। মানহীন বিটুমিনের একমাত্র উৎস হলো আমদানি; যা একেবারে তরলজাতীয়। আমদানি বিটুমিন স্থানীয়ভাবে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে উৎপাদিত বিটুমিনের তুলনায় একেবারেই মানহীন বলে উল্লেখ রয়েছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) একটি প্রতিবেদনে। এ ধরনের বিটুমিনের পরিবর্তে দেশে উৎপাদিত গাঢ় বিটুমিন ব্যবহার নিশ্চিত করতে বলেছিল সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগও নিম্নমানের বিটুমিন ব্যবহারে নিরুৎসাহ।

এদিকে নিম্নমানের বিটুমিন আমদানি ঠেকাতে কয়েক দফায় উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। বিদেশ থেকে নিম্নমানের বিটুমিন আমদানি বন্ধ করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে চিঠি দিয়েছিল বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। পেট্রোলিয়ামজাত পণ্য মজুদকরণ, বিপণন, বিতরণ ও সরবরাহকরণ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের উপমহাব্যবস্থাপক জাকির হোসেন চৌধুরী স্বাক্ষরিত এক পত্রে সব ব্যাংকের প্রধানকে বিইআরসির লাইসেন্স ছাড়া কেউ যাতে নিম্নমানের কিংবা ভেজাল বিটুমিন আমদানি করতে না পারে সে ব্যাপারে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। ২০১৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বর স্বাক্ষরিত এক পত্রে কমিশনের সচিব মো. হাবিবুর রহমান উল্লেখ করেন, ‘আমদানিনীতি আদেশের আলোকে পেট্রোলিয়ামজাত পণ্য আমদানির লক্ষ্যে এলসি খোলার সময় বিইআরসির লাইসেন্স পরীক্ষা করা বাধ্যতামূলক।’

কিন্তু যথাযথ মনিটরিং না থাকায় রাস্তার সর্বনাশ করা ভেজাল বিটুমিনের আমদানি একদন্ডও কমেনি। বছরে আমদানি হচ্ছে ৪ লাখ টনের বেশি। শুধু তাই নয়, ভেজাল বিটুমিন আমদানির আড়ালে হচ্ছে বিপুল অঙ্কের অর্থ পাচারও। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত ১০ বছরে শুধু নিম্নমানের বিটুমিন আমদানির আড়ালে পাচার হয়ে গেছে অন্তত ১৪ হাজার কোটি টাকা। আর এ বিটুমিনে সড়কের ক্ষতি তো অনেক।

সর্বশেষ খবর