মঙ্গলবার, ২৫ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

ঘূর্ণিঝড় ইয়াস মোকাবিলায় ব্যাপক প্রস্তুতি

নিজস্ব প্রতিবেদক

ঘূর্ণিঝড় ইয়াস মোকাবিলায় ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে সরকার। প্রস্তুত করা হয়েছে আশ্রয় কেন্দ্রগুলো। প্রস্তুত রয়েছে মেডিকেল টিম। এ ছাড়া শুকনা খাবার, বিশুদ্ধ পানিসহ মোমবাতি ও দিয়াশলাই মজুদ রাখা হচ্ছে। করোনার কারণে আশ্রয় কেন্দ্রে রাখা হচ্ছে হ্যান্ড স্যানিটাইজার, পর্যাপ্ত মাস্কসহ অন্যান্য জিনিসপত্র। তবে ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ ধেয়ে আসার খবরে উপকূলের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় আছেন উপকূলবাসী।

বাংলাদেশের উপকূল থেকে ৬০০ কিলোমিটার দূরে বঙ্গোপসাগরে পাক খেতে থাকা ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ ঘণ্টায় ৪ কিলোমিটার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে উত্তর উত্তর-পশ্চিমে, ভারতের উড়িষ্যা আর পশ্চিমবঙ্গ উপকূলের দিকে। টানা কয়েক দিনের তাপপ্রবাহের মধ্যে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বাতাসে আর্দ্রতা বেড়ে যাওয়ায় অসহনীয় গরম অনুভূত হচ্ছে সারা দেশে। আবহাওয়া অফিস বলছে, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বৃষ্টি শুরু হলে আজ মঙ্গলবার থেকে গরমের তীব্রতা ধীরে ধীরে কমে আসতে পারে। পূর্ব মধ্য বঙ্গোপসাগরের বর্তমান অবস্থান থেকে উত্তর উত্তর-পশ্চিম দিকে এগিয়ে কাল বুধবার প্রথম প্রহরে উড়িষ্যার উত্তর উপকূল এবং পশ্চিমবঙ্গ উপকূলের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারে ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’।

বুধবারই ঘূর্ণিঝড়টি উড়িষ্যা-পশ্চিমবঙ্গ-খুলনা এলাকা দিয়ে উপকূল অতিক্রম করতে পারে বলে মনে করছেন বাংলাদেশের আবহাওয়াবিদরা। ভারতীয় আবহাওয়া অফিস বলছে, অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড়ের আকারে ইয়াস বুধবার দুপুর নাগাদ পশ্চিমবঙ্গের পারাদ্বীপ ও সাগরদ্বীপের মাঝামাঝি এলাকা দিয়ে উপকূল অতিক্রম করতে পারে। সে সময় বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ হতে পারে ঘণ্টায় ১২৫ কিলোমিটার। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে সাগর বিক্ষুব্ধ থাকায় চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ২ নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত দেখিয়ে যেতে বলেছে বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদফতর। উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থানরত সব মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে।

আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ জানান, সোমবার সন্ধ্যা ৬টায় ঘূর্ণিঝড়ের অবস্থান ছিল চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৬৫৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিমে; কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৫৯০ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিমে; মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৬৩০ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৫৮৫ কিলোমিটার দক্ষিণে। ওই সময় ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৫৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৬২ কিলোমিটার; যা দমকা বা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ৮৮ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়ছিল। অনুকূল পরিস্থিতির কারণে ঘূর্ণিঝড়টি আরও ঘনীভূত হয়ে উত্তর উত্তর-পশ্চিমে অগ্রসর হতে পারে। ২৬ মে বুধবার ভোর নাগাদ উত্তর উড়িষ্যা-পশ্চিমবঙ্গ-খুলনা উপকূলের কাছ দিয়ে উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগর এলাকায় পৌঁছাতে পারে।

গরম কমার অপেক্ষা : জ্যৈষ্ঠের প্রথম সপ্তাহে টানা কয়েক দিন ধরে মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। এরই মধ্যে সাগরে লঘুচাপ সৃষ্টির পর গরমের তীব্রতা বেড়েছে শনিবার থেকে। শনিবারই আন্দামান সাগরে একটি লঘুচাপের সৃষ্টি হয়, যা ক্রমান্বয়ে শক্তি সঞ্চয় করে সুস্পষ্ট লঘুচাপ, নিম্নচাপ ও গভীর নিম্নচাপের ধাপ পেরিয়ে সোমবার ভোরে ঘূর্ণিঝড়ের রূপ পায়। গত একদিনে দেশের কোথাও কোথাও সামান্য বৃষ্টি হয়েছে। আবার অধিকাংশ জায়গায় মেঘলা আবহাওয়ায় ভ্যাপসা গরম অনুভূত হচ্ছে।

গতিপথ ও ঝুঁকি : ঘূর্ণিঝড় ইয়াস উপকূলের দিকে এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে সরকারের তরফ থেকেও দুর্যোগকালীন প্রস্তুতি এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। তবে ঝড়ের এখনকার গতিপথ ঠিক থাকলে বাংলাদেশের ক্ষতির ঝুঁকি কম হবে বলে আশা করছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান। গতকাল সচিবালয়ে ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি বিষয়ে একটি সভা হয়। আবহাওয়া অধিদফতরের পরিচালক সামছুদ্দিন আহমেদও তাতে অংশ নেন। সভা শেষে প্রতিমন্ত্রী বলেন, এটি এখনো অতটা শক্তিশালী হতে পারেনি। উত্তর-পশ্চিম অংশে সরাসরি উড়িষ্যার দিকে এর গতিপথ। যদি এই গতিপথ একই রকম থাকে তবে বাংলাদেশে উপকূলে ক্ষতির কোনো প্রভাব হবে না বলে আমরা আশা করছি। ঝড়ের গতিবিধির ওপর নজর রাখা হচ্ছে জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, যদি কোনো কারণে এটা দিক পরিবর্তন করে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম দিকে আসে, তবে আমরা যেন মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে আসতে পারি, আশ্রয় কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত করা হয়েছে। আমাদের ভলান্টিয়াররা প্রস্তুত আছেন। প্রস্তুত আছেন আমাদের জেলা প্রশাসকরা। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-

খুলনা : ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় খুলনার কয়রায় ১১৮টি, দাকোপে ১২৩টি, ডুমুরিয়ায় ১৯টি, বটিয়াঘাটায় ১৮টি ও পাইকগাছায় পাঁচটি আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এসব কেন্দ্রের ধারণক্ষমতা ১ লাখ ৯০ হাজার ৩৭০ জন। জেলা ত্রাণ পুনর্বাসন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পাঁচ হাজার ৩২০ জন্য স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত রয়েছে।

বাগেরহাট : ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ মোকাবিলায় উপকূলীয় জেলা বাগেরহাটে প্রস্তুত রাখা হয়েছে ৯৭৩ আশ্রয় কেন্দ্র। এসব আশ্রয় কেন্দ্রে ঘূর্ণিঝড়ের সময় করোনা স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্রায় ৩ লাখ লোকের থাকাসহ গবাদি পশুও রাখা যাবে। এ ছাড়া আশ্রয় কেন্দ্রে রাখা হচ্ছে হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্কসহ পর্যাপ্ত পানি ও স্যানিটেশনের ব্যবস্থা।

মোংলা বন্দরের প্রস্তুতি : সুন্দরবনসহ মোংলা আন্তর্জাতিক সমুদ্রবন্দর ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দিকে ধেয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট এই ঘূর্ণিঝড়টি মোকাবিলায় মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ ব্যপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। খোলা হয়েছে কন্ট্রোল রুম। বন্দরের গুরুত্বপূর্ণ সব কর্মকর্তাকে কর্মস্থলে থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

পটুয়াখালী : বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ মোকাবিলায় পটুয়াখালীতে দুর্যোগ প্রস্তুতি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। গতকাল জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত সভায় সভাপতিত্ব করেন জেলা প্রশাসক মতিউল ইসলাম চৌধুরী। জেলা প্রশাসক জানান, ঘূর্ণিঝড় ইয়াস মোকাবিলায় জেলায় ৮০৩টি আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

কলাপাড়া : ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ মোকাবিলায় পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় ১৬৭টি আশ্রয় কেন্দ্র, নবনির্মিত ২টি মুজিব কিল্লা ও ১৫টি মেডিকেল টিম প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

উৎকণ্ঠায় চট্টগ্রামের উপকূলবাসী : ঘূর্ণিঝড় ইয়াস পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছে। ফলে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় আছেন চট্টগ্রামের উপকূলবাসী। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগে বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী আনোয়ারা-বাঁশখালী উপজেলার মানুষদের মধ্যে উৎকণ্ঠা বেশি। 

বরিশালে ১১৭১টি আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত : ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ এর ভয়াবহতা থেকে উপকূলের মানুষের জানমাল রক্ষায় প্রস্তুতি শুরু করেছে প্রশাসন। এ লক্ষ্যে বরিশাল জেলায় প্রস্তুত রাখা হয়েছে ৩১৬টি সাইক্লোন শেল্টার এবং আরও ৭৫৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

পিরোজপুরে আশ্রয় কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত : ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ মোকাবিলায় উপকূলীয় জেলা পিরোজপুরে আশ্রয় কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত করাসহ নানা পদক্ষেপ নিয়েছে জেলা প্রশাসক। আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে মোট ৫৫৭টি।

সর্বশেষ খবর