বৃহস্পতিবার, ২৭ মে, ২০২১ ০০:০০ টা
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আদেশ

আমদানির বিটুমিন খালাসে মান পরীক্ষা বাধ্যতামূলক

নিজস্ব প্রতিবেদক

দেশে আমদানি হওয়া পেট্রোলিয়াম বিটুমিন পণ্য খালাসের আগে সরকার-নির্ধারিত তিন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গুণগতমান পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করেছে সরকার। এ আদেশ জারি করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট- বিএসটিআই, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েট ও ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড-ইআরএলের মাধ্যমে পণ্যের গুণগতমান পরীক্ষা করতে হবে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোহাম্মদ মনির হোসেন হাওলাদার স্বাক্ষরিত এ আদেশ ২৫ মে জারি করা হয়। আদেশে উল্লেখ করা হয়, আমদানি ও রপ্তানি (নিয়ন্ত্রণ) আইনে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে আমদানি নীতি আদেশ, ২০১৫-২০১৮-এর এ সংশোধন করেছে সরকার। ওই আদেশে আরও বলা হয়, পেট্রোলিয়াম কোক ও পেট্রোলিয়াম বিটুমিন ছাড়া পেট্রোলিয়াম তেলের রেসিডিউসমূহসহ সব পণ্য আমদানিনিষিদ্ধ, তবে পেট্রোলিয়াম বিটুমিন আমদানির ক্ষেত্রে এইচ এস কোড ২৭১৩.২০.১০ এবং ২৭১৩.২০.৯০ নম্বরের পণ্য খালাসের আগে গুণগতমান পরীক্ষা করতে হবে।

জানা গেছে, আমদানিতে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে দেশে দীর্ঘদিন যাবৎ ভেজাল বিটুমিন আসছেই। এত দিন বিটুমিনের নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেনি কেউ। বিটুমিন আমদানির পুরো প্রক্রিয়াই প্রশ্নবিদ্ধ। ফলে মান পরীক্ষা ছাড়াই দেশে বিটুমিন এসেছে। তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নতুন ওই আদেশ যথাযথভাবে কার্যকর হলে বিটুমিন ব্যবহারের ইতিবাচক ফল আসতে পারে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

জানা গেছে, টেকসই সড়ক নির্মাণে উন্নতমানের বিটুমিনের নিশ্চয়তা চায় সরকার। এ লক্ষ্যে বিটুমিনের উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, আমদানিকারক, মান নিয়ন্ত্রণকারী ও ব্যবহারকারী প্রতিষ্ঠান এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড- এনবিআরের মধ্যে সমন্বয় করতে বলেছে সরকার। এ তথ্য উঠে এসেছে সরকার গঠিত বিটুমিনের গ্রেড নির্ধারণ কমিটির প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, দেশে ভালো মানের সড়কের জন্য প্রয়োজন উন্নতমানের বিটুমিন। সড়কের জন্য ভালো মানের বিটুমিনের বিকল্প নেই। তাই সঠিক মান নির্দিষ্টকরণের লক্ষ্যে পরীক্ষা-নিরিক্ষা করেই বিটুমিন ব্যবহারের সুপারিশ করেছে বিটুমিনের গ্রেড নির্ধারণ কমিটি।

জানা গেছে, বিটুমিনের মান নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের সাবেক ডিন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাকারিয়াকে সভাপতি করে একটি ‘বিটুমিনের গ্রেড নির্ধারণ কমিটি’ গঠন করে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর-এলজিইডি। কমিটি গত বছর ৯ মার্চ বিটুমিনের গ্রেড নির্ধারণের লক্ষ্যে সভা করে। ওই সভার কার্যবিবরণীতে চারটি সিদ্ধান্তের উল্লেখ করে বলা হয়, এক. বুয়েট কর্তৃক স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের জন্য তৈরি রোড ডিজাইন স্ট্যান্ডার্ড অনুসরণ করে সড়ক উন্নয়ন ও মেরামত করা। দুই. ট্যারিফ ভলিউম বিবেচনায় এলজিইডির সড়কে ৬০ থেকে ৭০ গ্রেডের বিটুমিন ব্যবহার করা। তিন. ট্যারিফ ভলিউমের ওপর ভিত্তি করে বিশেষ ক্ষেত্রে জাতীয় মহাসড়ক বা ন্যাশনাল হাইওয়ে, আঞ্চলিক মহাসড়ক বা রিজওনাল হাইওয়ে, বিমানবন্দর সড়ক, উপজেলা সড়ক ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সড়কের জন্য রোড ডিজাইন ও মিক্স ডিজাইন নিশ্চত করে পারফরম্যান্স গ্রেড বিটুমিন ও পলিমার মোডিফাইড বিটুমিন ব্যবহার করা। চার. বিটুমিনের উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, আমদানিকারক, মান নিয়ন্ত্রণকারী ও ব্যবহারকারী প্রতিষ্ঠান এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআরের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা।

এ প্রসঙ্গে সরকার-গঠিত ‘বিটুমিনের গ্রেড নির্ধারণ কমিটি’র সভাপতি ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের সাবেক ডিন ও অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাকারিয়া বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড-ইআরএল বিটুমিন তৈরি করে এবং বিদেশ থেকেও কিছু বিটুমিন আমদানি হয়। যে বিটুমিনই আসুক না কেন, যথাযথ মান পরীক্ষায় যদি উত্তীর্ণ না হয় তবে তা বাতিল করে দেবেন কর্তৃপক্ষ। কারণ বিটুমিনের মান খারপ হলেই রাস্তার ওপরের অংশ নষ্ট হয়ে যায়। বিটুমিনের কোয়ান্টিটি ও গ্রেডের ওপর তার কনস্ট্রাকশন সফল হবে কি না তা অনেকটা নির্ভর করে। শুধু বিটুমিন আমদানির পর পরীক্ষা করলে হবে না। প্রতিদিন পরীক্ষা করতে হবে। এটা যদি না করি তাহলে কোনো অবস্থাতেই সড়ক টিকবে না।’

দেশের বিশিষ্ট যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েটের অধ্যাপক ড. শামসুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বিটুমিনের ব্যবহার ভালোভাবে করতে সরকারের দক্ষ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। বিটুমিনের যে পরিমাণ চাহিদা আছে তার একটি অংশ ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড-ইআরএল ভালো মানের বিটুমিন উৎপাদন করে। কিন্তু ঠিকাদারা সস্তায় বিটুমিন সংগ্রহ করছেন। বিটুমিনের ব্যবহার ভালোভাবে করতে দক্ষ ব্যবস্থাপক লাগবে।’

ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি-আইইউটির সহকারী অধ্যাপক আইইউটি ও বিটুমিন বিশেষজ্ঞ ড. নাজমুস সাকিব সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেছিলেন, ‘এমন একটি শিপ বা জাহাজ থেকে বিটুমিন নেওয়া হচ্ছে যেটি তিন থেকে চার মাস সাগরে ভাসছে। সেখানেই শিপের পরিত্যক্ত তেল ও তেলজাতীয় ক্ষতিকর পদার্থ বিটুমিনে মেশানো হচ্ছে। এক কথায় বলতে গেলে চোরাই প্রক্রিয়ায় মানহীনভাবে তৈরি বিটুমিন বাংলাদেশে আসছে। স্বাভাবিকভাবেই মানহীন ও রাজস্ব ফাঁকির সুযোগ থাকাই ভেজাল বিটুমিনের দামও কিছুটা কম হয়। এ অল্প দামে পাওয়া খারাপ বিটুমিন সারা দেশের রাস্তা নির্মাণে ব্যবহৃত হচ্ছে। আসলে আবর্জনাকে আমরা রাস্তায় বিটুমিন হিসেবে ব্যবহার করছি।’

বন্দরনগর চট্টগ্রামে বিটুমিনের বেশ কয়েকটি গুদাম ঘুরে দেখা গেছে আমদানির পর বিটুমিনগুলো কীভাবে রাখা হচ্ছে। জাহাজ থেকে বন্দরে আনা বিটুমিনের ড্রামগুলো যাচ্ছেতাইভাবে রাখা হয়েছে শেডে। খুঁজতে খুঁজতে একটি ব্যক্তিমালিকানাধীন গোডাউনে বিটুমিনের ড্রামের দেখা মিলল। যেখানে খোলা আকাশের নিচে, ময়লা-কাদার মধ্যেই অবৈজ্ঞানিকভাবে রাখা হয়েছে বিটুমিন। দেখলেই বোঝা যায় মানের কী অবস্থা।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর