বৃহস্পতিবার, ২৭ মে, ২০২১ ০০:০০ টা
দক্ষিণখানে ছয় টুকরা লাশ

খুনের পরিকল্পনাকারী স্ত্রী ও ইমাম রিমান্ডে

নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজধানীর দক্ষিণখানে আজহারুল ইসলামকে (৩০) খুনের পরিকল্পনাকারী ছিলেন তার স্ত্রী আসমা আক্তার (২৫)। আর এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন আসমার প্রেমিক দক্ষিণখানের সরদারবাড়ি জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা মো. আবদুর রহমান (৫৪)। আবদুর রহমান খুন করার পর আজহারের লাশ ছয় টুকরা করে মসজিদের সেপটিক ট্যাংকে ফেলে দেন। এরপর মসজিদের ইমামের কক্ষের মেঝের রক্ত মুছে নিজে গোসল করে ফজরের নামাজে যথারীতি ইমামতি করেন আবদুর রহমান। হত্যাকান্ডের একদিন পর জুমার নামাজ পড়াতে গিয়ে দুইবার তার ভুল হয়েছিল। গ্রেফতারকৃত আজহারের স্ত্রী আসমা আক্তার এবং ইমাম আবদুর রহমানকে জেরা করে এসব তথ্য পেয়েছে র‌্যাব। তাদের দুজনকেই পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইমামের সঙ্গে পরকীয়া সম্পর্কের জেরেই এ নৃশংস হত্যাকান্ড ঘটানো হয়েছে। গতকাল রাজধানীর কুর্মিটোলায় র‌্যাব সদর দফতরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, নিহত আজহারের স্ত্রী আসমাকে মঙ্গলবার রাতে রাজধানীর আবদুল্লাহপুর থেকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আসমা এ হত্যাকান্ডের মূল পরিকল্পনাকারী বলে স্বীকার করেছেন। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইমাম আবদুর রহমানের সঙ্গে আসমার প্রেমের সম্পর্ক শুরু হয়। স্বামী ও চার বছরের সন্তানকে কোরআন শিক্ষা দেওয়ার জন্য আবদুর রহমান নিয়মিত বাসায় আসার সুবাদে আসমার সঙ্গে পরকীয়ার সম্পর্ক শুরু হয়। মার্চ মাসে আজহার বিষয়টি টের পান। অনৈতিক কাজ করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরাও পড়েন আবদুর রহমান। এ ঘটনার পর আজহার তাকে বাসায় আসতে নিষেধ করেন। এরপর আজহার বাসা পরিবর্তন করে দক্ষিণখানের মধুবাগ এলাকায় হাজী মার্কেটের সামনে চলে যান। এতেও চিড় ধরেনি আসমা-ইমামের অনৈতিক সম্পর্কে। নিয়মিত দেখা হতো তাদের। গার্মেন্টে চাকরি করতে যাওয়ার পর সারাদিন মোবাইল ফোনে ইমামের সঙ্গে ফোনে কথা বলতেন আসমা। কিন্তু আজহার বিষয়টি ধরে ফেলেন। এরপর থেকে আসমা তার স্বামীকে হত্যার পরিকল্পনা করতে থাকেন। এ নিয়ে তিনি ইমামের সঙ্গে কথাও বলেন। ইমামকে ভাড়াটিয়া কিলার গ্রুপ ঠিক করতে বলেন। কিন্তু ইমাম তাকে জানান যে ভাড়াটিয়া কিলার দিয়ে হত্যা করলে ঘটনা যে কোনো সময় ফাঁস হয়ে যেতে পারে। তারা কথোপকথনের জন্য পৃথক মোবাইল ফোন ব্যবহার করতেন। এক পর্যায়ে আবদুর রহমান ভাড়াটে কাউকে দিয়ে হত্যা না করিয়ে নিজেই হত্যা করবেন বলে আসমার সঙ্গে পরিকল্পনা করেন। ঈদ উদযাপন করতে আজহার স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে তার গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে যান। সেখানে আসমা পরকীয়ার বিষয়টি নিয়ে নিজেই তার স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া বাধিয়ে দেন। আসমার পরিকল্পনা হচ্ছে, তার স্বামী ঢাকায় চাকরিতে গিয়ে একবার হলেও ইমামের সঙ্গে দেখা করলে, তাকে খুন করবে। ঈদের পর গার্মেন্টকর্মী আজহার স্ত্রী ও সন্তানকে টাঙ্গাইলে রেখে ঢাকায় আসেন। ১৯ মে গার্মেন্টে ডিউটি করার পর ইমামের ফোন পেয়ে সরদারবাড়ি জামে মসজিদে চলে যান আজহার। রাতে এশার নামাজ মসজিদে আদায় করার পর বিষয়টি নিয়ে আলাপ করার জন্য তিনি ও ইমাম আবদুর রহমান একসঙ্গে ইমামের কক্ষে যান। সেখানে স্ত্রীর সঙ্গে পরকীয়ার বিষয়টি নিয়ে দুজনের কথা কাটাকাটি হয়। সারাদিন গার্মেন্টে কাজ করে ক্লান্ত আজহারের চোখে ঘুম ঘুম ভাব ছিল। আবদুর রহমান হত্যার উদ্দেশে আগেই চাপাতি ও ছুরি কিনে রুমে রেখেছিলেন। এ ছাড়া কোরবানির পশু জবাইয়ের ছুরি তো সবসময় রুমে ছিলই। রুমেই আজহারকে হত্যার চেষ্টা করেন আবদুর রহমান। এ সময় জীবন বাঁচাতে ইমামের রুম থেকে দৌড়ে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেন আজহার। কিন্তু মসজিদের সিড়িতে পড়েন যান আজহার। এ সময় পশু জবাইয়ের ছুরি নিয়ে ছুটে এসে আজহারের ঘাড়ের ডান পাশে কোপ বসান আবদুর রহমান। এতে ঘটনাস্থলেই আজহারের মৃত্যু হয়। পরে রাত ৯টা থেকে ১২টা পর্যন্ত ইমাম পর্যায়ক্রমে আজহারুলের মৃতদেহ ছুরি ও চাপাতি দিয়ে ছয় টুকরা করেন। ফজরের নামাজের ওয়াক্ত শুরু হওয়ার আগেই ইমাম একেকটি টুকরা মসজিদের নিচতলায় সিঁড়ির নিচে সেপটিক ট্যাংকে ফেলে দেন। তিনি কক্ষের এবং সেপটিক ট্যাংকের আশপাশের রক্তের দাগ নিজে পরিষ্কার করেন। এরপর ট্যাংকের ঢাকনার ওপর দুটি সিমেন্টের বস্তা রেখে দেন। নিজের পরনের কাপড় পরিষ্কার করে ফজরের নামাজে ইমামতি করেন। র‌্যাব কর্মকর্তা আল মইন আরও বলেন, ২৪ মে মসজিদের সেপটিক ট্যাংক থেকে দুর্গন্ধ ছড়ালে খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে আজহারের দেহের খন্ডিত অংশগুলো উদ্ধার করে। পরে এ ঘটনায় জড়িত থাকার সন্দেহে মসজিদের ইমাম মাওলানা মো. আবদুর রহমানকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। প্রাথমিক তদন্তে হত্যাকান্ডের ঘটনায় নিহতের স্ত্রীর নাম উঠে এলে তাকে পরদিন উত্তরার আবদুল্লাহপুর থেকে গ্রেফতার করা হয়। রমজান মাসের সাত দিন আগে আজহারকে হত্যার পরিকল্পনা করেন ইমাম আবদুর রহমান ও নিহতের স্ত্রী আসমা আক্তার। হত্যা পরিকল্পনার আলোচনা করতে ইমাম তার এক ছাত্রের নামে একটি সিম ও মোবাইল ফোন কিনে দেন আসমাকে। ওই ফোনে হত্যাকান্ড সম্পর্কে তারা শলাপরামর্শ করতেন। আজহারকে হত্যার আগে ও পরে ওই ফোনেই তাদের মধ্যে কথোপকথন হয়। মাওলানা মো. আবদুর রহমান দক্ষিণখানে সরদারবাড়ি জামে মসজিদে ৩৩ বছর ধরে ইমামতি করে আসছিলেন। হত্যাকান্ডের ঘটনায় নিহতের ভাই মোহাম্মদ হাসান বাদী হয়ে দক্ষিণখান থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। ওই মামলায় এক নম্বর আসামি করা হয়েছে ইমাম মাওলানা মো. আবদুর রহমানকে এবং দুই নম্বর আসামি করা হয়েছে নিহত আজহারের স্ত্রী আসমা আক্তারকে।

গ্রেফতার আসমার বয়স মাত্র ২৫ বছর। এর মধ্যেই তিনটি বিয়ে করেছেন তিনি। তার গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে। সেখানে এক কৃষককে বিয়ে করেছিলেন। ওই ঘরে এক সন্তানও রয়েছে। পরে নিহত আজহারের বড় ভাইকে ২০১৫ সালে বিয়ে করেন। এরপর দেবর আজহারের সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িতে পড়েন আসমা। মাত্র এক বছরেরও কম সময়ে ওই সংসার ভেঙে আজহারকে নিয়ে ঢাকায় পাড়ি জমান আসমা। ২০১৬ সালে তারা বিয়ে করেন। তাদের ঘরে আরিয়ান নামে চার বছরের এক পুত্রসন্তান রয়েছে। আজহারকে হত্যা করতে পারলে ইমাম আবদুর রহমানকে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন আসমা আক্তার। এদিকে গতকাল ওই মামলায় আবদুর রহমান ও আসমা আক্তারকে আদালতে হাজির করা হলে আদালত পাঁচ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করে। এর আগে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দক্ষিণখান থানার এসআই অনুজ কুমার সরকার প্রত্যেককে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করে আসামিদের ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করেন। মহানগর হাকিম নিভানা খায়ের জেসি রিমান্ড শুনানি শেষে পাঁচ দিনের রিমান্ডের আদেশ দেন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর