শুক্রবার, ২৮ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

সংক্রমণ বাড়ছে সীমান্ত জেলায়

চাঁপাইনবাবগঞ্জে চলছে লকডাউন, ঝুঁকিপূর্ণ জেলাগুলো চিহ্নিত, বেশি টেস্টের পরামর্শ

নিজস্ব প্রতিবেদক

সংক্রমণ বাড়ছে সীমান্ত জেলায়

ভারতের সঙ্গে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় বাড়ছে সংক্রমণ। সংক্রমণ বাড়ায় এর মধ্যেই চাঁপাইনবাবগঞ্জে লকডাউন দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আরও ১৪টি সীমান্তবর্তী জেলায় সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী। কার্যকর লকডাউন, করোনা পরীক্ষা বাড়ানো এবং আক্রান্তের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের আইসোলেশন করে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ দিয়েছেন জনস্বাস্থ্যবিদরা। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনে দেখা যায়, ১০ থেকে ১৬ মের তুলনায় ১৭ থেকে ২৩ মে এ এক সপ্তাহে ২২ জেলায় নতুন রোগী বৃদ্ধির হার শতভাগ বা তার বেশি ছিল। এর মধ্যে ১৫ জেলা-ই সীমান্তবর্তী। এ জেলাগুলোর মধ্যে নয়টির প্রতিটিতে এক সপ্তাহে শনাক্ত আক্রান্তের সংখ্যা পঞ্চাশের নিচে। এ জেলাগুলোর মধ্যে আছে ভারতের সীমান্তবর্তী চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও, লালমনিটরহাট, কুড়িগ্রাম, জয়পুরহাট, রাজশাহী, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, যশোর, সাতক্ষীরা, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, জামালপুর, রাঙামাটি ও বান্দরবান। এ ছাড়া এ তালিকায় আছে নাটোর, গাইবান্ধা, খুলনা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, কক্সবাজার ও নরসিংদী।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের এনেস্থেসিওলজিস্ট ডা রাজীব শাহরিয়ার বলেন, ‘সীমান্তে সংক্রমণের অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। কার্যকর লকডাউন না হলে ভয়াবহ পরিণতি হবে। লকডাউনের পাশাপাশি সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় প্রচুর এন্টিজেন টেস্ট, কন্টাক্ট ট্রেসিং, আইসোলেশন করা প্রয়োজন। আমের ভরা মৌসুমে রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জের হাটগুলোয় বছরের সবচেয়ে বড় জনসমাগম হয়। সেখানে নো মাস্ক নো বাই সেল- এ রীতি কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সব ভারতফেরত মানুষকেই ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের বাহক বিবেচনায়  আইসোলেশনে আনতে হবে। শনাক্তকরণের জন্য টার্গেটেড পিসিআর করলে দ্রুত জানা যাবে কোন ভ্যারিয়েন্ট দিয়ে হচ্ছে সংক্রমণ।’

আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী কাজী শাহেদ জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় বিভাগটিতে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া একই সময়ে বিভাগের আট জেলায় শনাক্ত হয়েছে আরও ১৭০ আক্রান্ত। বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টার করোনাবিষয়ক এসব তথ্য জানা যায়। এর আগে বুধবার বিভাগে কেউ করোনায় মারা যায় নি। জেলার করোনা শনাক্তের হার আগের দিন ছিল ২১.৭ শতাংশ। তবে বুধবার তা বেড়ে হয়েছে ৪২ শতাংশ। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী জানান, রামেক হাসপাতালে করোনা ডেডিকেটেড ওয়ার্ড বাড়ানো হচ্ছে। জেলা প্রশাসক আবদুল জলিল জানান, সীমান্ত অঞ্চলগুলোয় সংক্রমণের হার বেশি তাই সেদিকে বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছে। কেউ যাতে সীমান্ত পেরিয়ে আসার পর কোয়ারেন্টাইন ছাড়া যেতে না পারেন, সেজন্য প্রশাসন সতর্ক আছে। রাজশাহী বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদফতরের সহকারী পরিচালক নাজমা আক্তার স্বাক্ষরিত প্রতিবেদনসূত্রে জানা যায়, ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষায় রাজশাহী বিভাগে ১৭০ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। এর আগের দিন চলতি বছর করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হওয়ার পর সর্বোচ্চ ২৭৫ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছিল। গত ২৪ ঘণ্টায় সবচেয়ে বেশি শনাক্ত হয়েছে রাজশাহী জেলায় ৭০ জন।

আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক, যশোর সাইফুল ইসলাম জানান, গতকাল যশোরে মাত্র দুজনের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ও পরীক্ষণ টিমের প্রধান অধ্যাপক ড. মো. ইকবাল কবীর জাহিদ জানান, গতকাল ৩৫ জনের নমুনা পরীক্ষা করে দুটি নমুনায় করোনার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। যশোর স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে জানানো হয়েছে, এর আগের দিন বুধবার জেলায় ২৪ এবং মঙ্গলবার ৩৬ জনের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়। যশোরে করোনা শনাক্তের হার প্রতিদিনই ওঠানামা করছে। সীমান্তবর্তী এ জেলাটিকে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে পাসপোর্ট যাত্রী আসার বিষয়টি। যশোর সিভিল সার্জন অফিসের মেডিকেল অফিসার ডা. মো. রেহেনেওয়াজ জানান, ২৬ এপ্রিল থেকে বুধবার পর্যন্ত ভারতফেরত যাত্রীর মধ্যে ১০ জনের করোনা শনাক্ত হয়। গতকাল জেলায় যে দুজনের করোনা শনাক্ত হয়েছে তার একজন ভারতফেরত যাত্রী। সব মিলিয়ে ভারত থেকে দেশে ফেরা ১১ জনের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়, যার সবাইকে যশোর জেনারেল হাসপাতালে করোনা ইউনিটে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। যশোরের সিভিল সার্জন ডা. শেখ আবু শাহীন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা আগের মতোই সতর্ক ও সজাগ আছি। সরকার যদি বাড়তি কোনো নির্দেশনা দেয় আমরা সেভাবে কাজ করার জন্যও প্রস্তুত আছি।’

আমাদের সাতক্ষীরা প্রতিনিধি মনিরুল ইসলাম মনি জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত হয়েছেন ২৫ জন। এ পর্যন্ত করোনা পজিটিভে জেলায় ৪৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর সর্দি, কাশি, শ্বাসকষ্টসহ উপসর্গ নিয়ে মৃত্যু হয়েছে ২০৭ জনের। সরকারের দেওয়া স্বাস্থ্যবিধি না মেনে অবাধে ভারতঘেঁষা সীমান্তবর্তী হাটবাজার, শপিং মল এবং ভোমরা স্থলবন্দর এলাকায় জনসাধারণের অবাধে ঘোরাফেরার কারণে প্রতিদিনই সাতক্ষীরা মেডিকেলে কলেজে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে।

গত ৫ মে সন্ধ্যায় ভারত থেকে দেশে ফিরেছেন ১৪২ বাংলাদেশি। তার মধ্যে ১১ জন করোনা পজিটিভ। সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন হুসাইন সাফায়াত জানান, এপ্রিলের শুরু থেকে সাতক্ষীরায় করোনা আক্রান্ত বাড়ছে। জেলায় এ পর্যন্ত ১ হাজার ৪৫৯ জন আক্রান্ত হয়েছেন। সাতক্ষীরায় প্রতিদিনই সংক্রমনের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের দিনাজপুর প্রতিনিধি মো. রিয়াজুল ইসলাম জানান, হিলি স্থলবন্দরে আসা ভারতীয় ট্রাকের চালক ও তাদের সহযোগীরা বন্দর এলাকায় স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। এ কারণে স্থলবন্দরের ব্যবসায়ী, সীমান্তবর্তীসহ উপজেলার সাধারণ মানুষের মাঝে আতঙ্ক রয়েছে। হাকিমপুর পৌরসভার মেয়র জামিল হোসেন চলন্ত জানান, প্রতিনিয়ত ভারতে করোনার প্রভাব বাড়ছে যা আতঙ্কের। ভারতীয় ট্রাকের চালক ও সহযোগীদের করোনা টিকার কার্ড বা নেগেটিভ সনদ নিয়ে দেশে প্রবেশ করতে এক মাস আগে চিঠি দেওয়া হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। হাকিমপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মকর্তা ডা. তৌহিদ আল হাসান জানান, হাকিমপুর উপজেলায় গত সাত দিনে ছয়জনের দেহে করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে বন্দরসংশ্লিষ্ট আছেন একজন এবং অন্যরা স্থানীয় বাসিন্দা।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি মো. রফিকুল আলম জানান, চাঁপাইনবাবগঞ্জে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় ২৫ মে থেকে প্রশাসন সাত দিনের বিশেষ লকডাউন ঘোষণা করেছে। কিন্তু ঢিলেঢালা লকডাউন পালিত হচ্ছে। শহরের উপকণ্ঠ বারঘরিয়ায় লোকজনকে অবাধে চলাচল করতে দেখা গেছে। বুধবার শিবগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে সাপ্তাহিক হাট বসতে দেখা গেছে। ওই দিন ২০২ জনের করোনা পরীক্ষায় ১৩১ জনের পজিটিভ রিপোর্ট আসে। গতকাল ৫৫ জনের নমুনা পরীক্ষায় ২৪ জনের পজিটিভ রিপোর্ট এসেছে। সিভিল সার্জন ডা. জাহিদ নজরুল চৌধুরী জানান, জেলার করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় সাত দিনের বিশেষ লকডাউন দেওয়া হয়েছে। তবে এটা ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট নয় বলে তিনি জানান। আমাদের মেহেরপুর প্রতিনিধি মাহবুবুল হক পোলেন জানান, মেহেরপুরে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে করোনা আক্রান্ত। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে মেহেরপুরে এক দিনে সর্বোচ্চ ১৮ জন আক্রান্ত হয়েছেন। বর্তমানে জেলায় করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ৪৮। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ১৬, গাংনীতে ২২ ও মুজিবনগরে ১০ জন। ইতিমধ্যে জেলায় ৮৪৮ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন এবং ২১ জনের মৃত্যু হয়েছে। সিভিল সার্জন ডা. মো নাসির উদ্দিন বলেন, ‘হাসপাতালে শয্যা প্রস্তুত আছে, আইসিইউ আছে। আমাদের স্বাস্থ্যকর্মীরা বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে মানুষকে সচেতন করছেন।’

সর্বশেষ খবর