শনিবার, ২৯ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

বেড়েছে কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত

পূর্ববিরোধের জেরে রাজধানীতে ছুরিকাঘাতে তরুণ খুন

সাখাওয়াত কাওসার

বেড়েছে কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত। তুচ্ছ ঘটনায় বখে যাওয়া কিশোরদের এক গ্রুপ হামলে পড়ছে অন্য গ্রুপের সদস্যদের ওপর। ধাওয়া, পাল্টা-ধাওয়ার বাইরেও ঘটছে খুনের ঘটনা। অল্প বয়সী এই কিশোরদের হাতে লাগছে রক্তের দাগ। অস্থির হয়ে উঠছে সমাজের পরিবেশ। তাদের থাবা থেকে বাদ পড়ছে না জন্মদাতা বাবা-মা এমনকি শিক্ষকও। বিরূপ প্রভাব পড়ছে পরিবার ও সমাজে। বেশ কয়েকজন সমাজ ও মনোবিজ্ঞানীর বক্তব্য হলো- দুই-একটা অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটলে কিশোর গ্যাংয়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা। আবার কয়েক দিন পরই বিষয়টি তারা ভুলে যাচ্ছেন। দীর্ঘমেয়াদি সমাধান নিয়ে কেউ ভাবছেন না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই কিশোররা আগামীর ভবিষ্যৎ। এই প্রজন্মকে রক্ষা করতে না পারলে ভয়াবহ সংকটে পড়বে দেশ।

রাজধানীর কদমতলীতে ক্রিকেট খেলা নিয়ে সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বের জেরে আরাফাত ইয়াছিন নামে এক তরুণ খুন হয়েছেন। বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১০টায় ছুরিকাঘাতের পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল সকাল ৬টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে মারা যায় সে। ওই রাতে শনিরআখড়া আরএস সুপার টাওয়ারের সামনে শুভ ও প্রিন্সসহ ১৫ থেকে ২০ জন তরুণ আরাফাতকে ছুরিকাঘাত করে। গুরুতর অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। 

র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপস্্) কর্নেল কে এম আজাদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘কিশোর গ্যাং’ নিয়ন্ত্রণের জন্য র‌্যাবের পক্ষ থেকে কিছু বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এই প্রক্রিয়ায় প্রয়োজনে পরিবারের অভিভাবকদেরও নিয়ে আসা হবে। দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষায় র‌্যাবের পক্ষ থেকে প্রয়োজনে আরও বিস্তর উদ্যোগ নেওয়ার পরিকল্পনাও রয়েছে। 

এদিকে রাজধানীর উত্তরায় ইফতারির দাওয়াত রক্ষা না করার ক্ষোভে বান্ধবীসহ বন্ধুকে ডেকে নিয়ে শাকিল হোসেন নামে এক তরুণকে তারই বন্ধুরা কুপিয়ে খুন করে। এ ঘটনায় অপর বন্ধু সাগর গুরুতর আহত হন। ৯ মে রাতে উত্তরা পূর্ব থানা এলাকায় ঘটনাটি ঘটে। গত ১৬ মে দিনদুপুরে পল্লবীতে আগাম ঘোষণা দিয়ে সাহিনুদ্দিন নামের এক ব্যবসায়ীকে যে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়, সেই ভিডিওচিত্র দেখে মানুষজন শিউরে উঠেছে। হত্যায় অংশ নেওয়া সবাই কিশোর। যারা পল্লবী এলাকার জার্সি বাহিনীর সদস্য। এই বাহিনীকে শুরু থেকেই নিজের আধিপত্য ধরে রাখতে পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছেন মিরপুর এলাকারই এক তরুণ ওয়ার্ড কাউন্সিলর। গত ২৩  এপ্রিল কুমিল্লার তিতাসে কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত থেকে ছেলেকে রক্ষা করতে গিয়ে হামলার শিকার হয়েছেন কলেজ শিক্ষক শেখ মোহাম্মদ উল্লাহ। তিনি গাজীপুর খান মডেল সরকারি স্কুল অ্যান্ড কলেজের ইসলামের ইতিহাসের প্রভাষক। তার অপরাধ ছিল বখাটে কিশোর তোফাজ্জলের বাবাকে তার ছেলে সম্পর্কে অবহিত করা। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের তালিকা করার জন্য প্রতিটি থানায় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটলে আমরা জড়িতদের আইনের আওতায় আনছি। কিন্তু কিশোরদের এসব সমস্যা দূর করা কেবলই আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে দিয়ে সম্ভব নয়। তিনি আরও বলেন, সামাজিক এবং পারিবারিক স্ট্রাকচার চেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে- এটি আতংকের বিষয়। আগে যৌথ পরিবার থাকায় অনেক ধরনের সমস্যার সমাধান শুরুতেই হয়ে যেত। কিন্তু একক পরিবারের পক্ষে যা কোনোভাবেই সম্ভব হয়ে ওঠে না। নির্মল বিনোদন থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে শিশু-কিশোররা। আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে খেলার মাঠের সংখ্যা।

অনুসন্ধান বলছে, করোনাকালে বেড়েছে কিশোরদের মধ্যেও অপরাধপ্রবণতাসহ ‘গ্যাং কালচার’ আসক্তি। লকডাউনে অবরুদ্ধ পরিস্থিতিতে শিশু-কিশোরদের অপরাধের ধরনও অনেকটা বদলেছে। অপরাধের সঙ্গে নতুন মাত্রা দিয়েছে প্রযুক্তি। অলস সময়ে কিশোরদের যৌনতার প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। চলতি বছরের শুরুর দিকে রাজধানীর কলাবাগানে ঘটে যাওয়া দিহান-আনুশকার ঘটনা এবং ভারতের  বেঙ্গালুরুতে বাংলাদেশি এক তরুণী তারই বন্ধুদের হাতে নির্যাতনের দৃশ্য ভাইরালের ঘটনা। কারণ শিশু-কিশোররা অনলাইন ঘেঁটে শুধু শিক্ষামূলক কনটেন্টই দেখছে না। আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে যায় না এমন অনেক অনৈতিক কন্টেন্টও সার্চ করছে। নিজেদের জীবনেও তার প্রয়োগ করার চেষ্টা চালাচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে কিশোররা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে সংঘবদ্ধ হয় ঘরে বসেই। ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার, ইমুর বিভিন্ন গ্রুপে বসে বসে পরিকল্পনা করে ‘গ্যাং কালচারের’। কোথায় কখন আড্ডা হবে, কতগুলো বাইক/গাড়ি থাকবে, কোন এলাকায় অবস্থান নিতে হবে। এমনকি কোথায় বসে কোন ধরনের মাদক গ্রহণ করবে, তাও ঠিক করে ফেলছে ঘরে বসে এসব গ্রুপে। অভিভাবকরা এবং আইন প্রয়োগাকারী সংস্থার সদস্যরাও টের পান না তাদের এসব পরিকল্পনার কথা।

তবে ‘কিশোর গ্যাং’ যে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার গলার কাঁটা হয়ে উঠছে, তা স্পষ্ট হয়েছে পুলিশ মহাপরিদর্শক ড. বেনজীর আহমেদের বক্তব্যে। গত ১১ জানুয়ারি তিনি বলেছেন, পুলিশের জন্য এই কিশোর গ্যাং বা কিশোর অপরাধীরাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এখন। র‌্যাবের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে কিশোর গ্যাংয়ের নিয়ন্ত্রক বা পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকায় কিছু বড় ভাইও রয়েছেন। বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকায় ২০১৭ থেকে ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত র‌্যাবের হাতে ২৮২ জন কিশোর অপরাধী গ্রেফতার হয়েছে।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নূর মোহাম্মদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সম্প্রতি কিশোর-কিশোরীদের ওপর আমি নিজেই এমন একটি সমীক্ষা চালিয়েছিলাম। সমীক্ষায় দেখা যায়, বর্তমানে কিশোর-কিশোরীরা স্মার্টফোনকেন্দ্রিক ইন্টারনেটের সুযোগকে অপব্যবহার করছে। তাই অন্তত এইচএসসি পর্যন্ত কিশোর-কিশোরীদের কাছে স্মার্ট ফোন না দেওয়া যেতে পারে। এর জন্য প্রয়োজনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সাহায্য নিতে হবে। সমাধানের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, কর্তৃপক্ষের উচিত হবে, শিশু-কিশোরদের জন্য ওয়ার্ডভিত্তিক একটি কমিটি গঠন করা। এই কমিটিতে শিক্ষক, চিকিৎসক, সমাজকর্মী, মনোবিজ্ঞানী, পুলিশ, প্রশাসন একই সঙ্গে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের অংশগ্রহণ থাকবে। তারা ওই এলাকার শিশু-কিশোরদের ব্যাপারে তথ্য রাখবেন। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তথ্য মতে, ঢাকায় অন্তত ৪০টির মতো কিশোর গ্যাং রয়েছে। ডিএমপি কমিশনার শফিকুল ইসলাম কিশোর অপরাধীদের তালিকা করতে থানা পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন। রাজধানীতে প্রতি মাসে গড়ে ২০টি হত্যার ঘটনা ঘটছে। এর বেশির ভাগ ঘটনায় কিশোর অপরাধীরা জড়িত বলে পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছে। আবার ২০১৮ সাল থেকে গত জানুয়ারি পর্যন্ত রাজধানীতে হওয়া ৩৬৩টি ছিনতাইয়ের নেপথ্যেও ছিল কিশোর অপরাধীরা। প্রায় একই চিত্র ঢাকার বাইরেও। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ভাসমান ছিনতাইকারীদের বড় অংশই কিশোর। তারা ডাকাতি, মাদক, চাঁদাবাজি, ইভ টিজিং, শ্লীলতাহানিতেও জড়িত। ঢাকার শিশু আদালতের নথি অনুযায়ী গত ১৫ বছরে রাজধানীতে কিশোর-তরুণদের সিনিয়র জুনিয়র দ্বন্দ্বে ৮৬টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। আর পুলিশের তথ্য মতে, গত ১৭ বছরে ঢাকায় কিশোর অপরাধীদের হাতে ১২০ জন খুন হয়েছে।

সর্বশেষ খবর