মঙ্গলবার, ১ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

শঙ্কার মাঝে স্বস্তির খবর দেবেন অর্থমন্ত্রী

হাদিস দিয়ে বাজেট বক্তব্য শেষ করবেন

মানিক মুনতাসির

শঙ্কার মাঝে স্বস্তির খবর দেবেন অর্থমন্ত্রী

করোনাভাইরাস মহামারীর সংকটে নাস্তানাবুদ পুরো বিশ্ব। ব্যবসা-বাণিজ্যে ইতিহাসের ভয়াবহতম মন্দা পরিস্থিতি। জীবন-জীবিকা নিয়ে শঙ্কায় দেশের মানুষ। এই শঙ্কার মধ্যেই নতুন ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য আগামী ৩ জুন জাতীয় সংসদে বাজেট উপস্থাপন করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। সবাই তাকিয়ে আছেন কী স্বস্তির খবর দেবেন অর্থমন্ত্রী? এমন পরিস্থিতিতে কৃষি, খাদ্য, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থানকে অগ্রাধিকার দিয়ে বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে। এখন চলছে শেষ মুহূর্তের ঘষামাজা। অর্থমন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, এবারের বাজেটটি হবে সম্পূর্ণ জীবন-জীবিকার বাজেট। মানুষের জীবন ও জীবিকাকে রক্ষার লক্ষ্যেই এ বাজেট দেওয়া হবে। স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্যও থাকবে অতিরিক্ত বরাদ্দ। এদিকে মহামারী করোনাভাইরাস থেকে মুক্তি পেতে এ সংক্রান্ত একটি হাদিস পাঠ করে বাজেট বক্তব্য শেষ করবেন অর্থমন্ত্রী।

এ ছাড়া বৈশি^ক মহামারী করোনার কারণে উৎপাদন, বিপণন ও ভোগ সবই কমছে এবং আগামীতে আরও কমবে। সেজন্য নতুন কৌশল নিয়েই অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের নজর রয়েছে। আগামী বাজেটে জীবন-জীবিকা উভয়ের সমন্বয় করতে থাকবে উদ্যোগ। মহামারীর মধ্যে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। ফলে জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষা এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধির পরই কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিকে তৃতীয় অগ্রাধিকার খাত হিসেবে চিহ্নিত করে আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে কৃষি খাতকে। খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, সার, বীজের ভর্তুকি ও প্রয়োজনীয় উপকরণের পাশাপাশি এসব উপকরণ ব্যবহার ও আধুনিক কৃষি সম্পর্কে সম্যক ধারণা বাড়াতে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে বছরজুড়েই। এ জন্য পৃথকভাবে বরাদ্দ রাখা হবে জাতীয় বাজেটে।

সূত্র জানায়, করোনাভাইরাস মহামারীর এই সংকটকালে সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দেওয়ার চেষ্টা থাকছে আগামী অর্থবছরের (২০২১-২২) জাতীয় বাজেটে। দেশে উৎপাদিত এবং বেশি ব্যবহার হয় এমন বেশির ভাগ পণ্যের দাম নাগালে রাখতে দেশি শিল্পে ব্যাপক হারে রাজস্ব ছাড় দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে দেশে কম্পিউটারসহ কিছু পণ্যের উৎপাদন উৎসাহিত করতে সেসব পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে বেশি হারে শুল্ক আরোপ করা হচ্ছে। তবে শুল্ক ছাড় পাচ্ছে কৃষিযন্ত্র, স্বাস্থ্য সুরক্ষা পণ্য। এতে ওই সব পণ্যের দাম কমতে পারে। তবে আগের মতোই আসন্ন বাজেটেও বিড়ি, সিগারেটসহ তামাকজাতীয় পণ্যের ওপর বাড়তি কর আরোপের ঘোষণা আসছে। এ ছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবিধার্থে কমানো হতে পারে করপোরেট কর হার।

বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে জড়িত অর্থ বিভাগ ও এনবিআরের কর্মকর্তারা জানান, বাজেটে এমন কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হবে, যাতে ভোগ্যপণের দাম না কমে। এমনিতেই মানুষের হাতে টাকার সরবরাহ কম। ফলে শুল্ক কাঠামোয় এমন কিছু পরিবর্তন আনা হবে, যাতে করে নতুন করে দাম বাড়বে না চাল, ডাল, চিনি, লবণ, দেশে উৎপাদিত পেস্ট, পাউরুটি, সাবান, বোতলজাত পানি, ফলের জুস, মসলা, প্রক্রিয়াজাত খাদ্যদ্রব্যের। আবার কর অব্যাহতি-রেয়াতি সুবিধা এবং আমদানি করা সমজাতীয় পণ্যে শুল্ক আরোপ করায় বিদেশি খেলনার দাম বাড়লেও কমবে দেশি খেলনার দাম। আমদানি করা সম্পূর্ণ মোটরসাইকেলের চেয়ে দেশে সংযোজিত মোটরসাইকেল কম দামে পাওয়া যাবে। আমদানি করা কম্পিউটারের দাম বাড়তে পারে। কমতে পারে দেশে উৎপাদিত কম্পিউটারের দাম।

এদিকে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ইতিমধ্যে বলেছেন, দেশের মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষার কথা মাথায় রেখেই আগামী বাজেট হবে জীবন-জীবিকার বাজেট। দুটি খাতই সমান ও সর্বাধিক গুরুত্ব পাবে আসছে বাজেটে। এ জন্য বরাদ্দও বাড়ানো হবে। এ ছাড়া এক বছর ধরে চলমান মহামারীর কারণে যেসব মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছেন তাদের জন্যও বাজেটে নতুন কিছু উদ্যোগ নেওয়া হবে। একই সঙ্গে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগের পরিকল্পনা থাকবে বাজেটে। এ জন্য ছোট-মাঝারি ক্ষুদ্র ব্যবসা ও শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে এ খাতের বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো হবে। একইভাবে এ খাতকে চাঙা করতে দেওয়া হবে নীতিগত সহায়তা।

এনবিআরের তথ্যমতে, কিছু খাতে কর অব্যাহতি দেওয়া হবে। এতে খরচ কমবে ক্লাউড সার্ভিস, সিস্টেম ইন্টিগ্রেশন, ই-লার্নিং প্ল্যাটফরম, ই-বুক পাবলিকেশন, মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্ট সার্ভিস ও ফ্রিল্যান্সিং খাতে। এ ছাড়া কর অব্যাহতি সুবিধা বহাল থাকায় সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, ডিজিটাল কনটেন্ট ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট, ডিজিটাল এনিমেশন ডেভেলপমেন্ট, ওয়েবসাইট ডেভেলপমেন্ট, ওয়েবসাইট সার্ভিস, আইটি প্রসেস আউটসোর্সিং, ওয়েবসাইট হোস্টিং, ডিজিটাল গ্রাফিক্স ডিজাইন, ডিজিটাল ডাটা এন্ট্রি অ্যান্ড প্রসেসিং, আইটি সাপোর্ট অ্যান্ড সফটওয়্যার মেইনটেন্যান্স সার্ভিস, সফটওয়্যার ল্যাব টেস্ট সার্ভিস, কল সেন্টার সার্ভিস, ওভারসিজ মেডিকেল ট্রান্সক্রিপশন্স সার্ভিস, সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন সার্ভিস, ডকুমেন্ট কনভারশন, রোবোটিক্স প্রসেস আউটসোর্সিং এবং সাইবার সিকিউরিটি সার্ভিস খাতে খরচ বাড়বে না।

আগামী অর্থবছর অধিক ব্যবহৃত চিকিৎসা সরঞ্জামাদি আমদানিতে রাজস্ব মওকুফ সুবিধা দিয়ে দাম কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। বিশেষভাবে হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরির উপাদান, মাস্ক, সুরক্ষা পোশাকসহ ৪৬ ধরনের পণ্য আমদানিতে সব ধরনের শুল্ক-কর অব্যাহতির প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে। হাসপাতালের আইসিইউ ও ভেন্টিলেশনে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি আমদানিতেও ছাড় দিয়ে এ দুই খাতে খরচ কমানোর চেষ্টা করা হয়েছে। করোনা পরীক্ষার দুই ধরনের কিট এবং রোগ নির্ণয়ের যন্ত্রপাতি আমদানিতেও শুল্ক থাকছে না। এ ছাড়া তিন স্তরের সার্জিক্যাল মাস্ক, প্লাস্টি ফেস শিল্ডস, সার্জিক্যাল পোশাক, বিশেষ ওভেন স্যুট, মেডিকেল প্রটেকটিভ গিয়ার, সুরক্ষা চশমা, জীবাণুনাশক আমদানিতে রাজস্ব ছাড় দেওয়ায় এসব পণ্যের দাম কমবে বলে জানিয়েছে এনবিআর সূত্র।

সূত্র জানায়, বিদ্যমান ভ্যাট আইন, ২০১২ আরও ব্যবসাবান্ধব ও যুগোপযোগী করতে আমদানি পর্যায়ে ভ্যাটের আগাম কর (এটি) হার কমানো হচ্ছে। ভ্যাট ফাঁকির জরিমানা ও সরল সুদ দুটোতেই ছাড় দেওয়া হচ্ছে। আগাম কর হার ৪ শতাংশ থেকে ৩ শতাংশ করা হচ্ছে। আর ভ্যাট ফাঁকির জরিমানা ও সরল সুদ হার দুটোই বাণিজ্য সহায়ক করতে যৌক্তিক করা হচ্ছে। বর্তমানে ফাঁকি দেওয়া ভ্যাটের দ্বিগুণ জরিমানা আরোপের বিধান রয়েছে। আগামী বাজেটে এটি কমিয়ে ভ্যাট ফাঁকির সমপরিমাণ জরিমানার বিধান করা হচ্ছে। এ ছাড়া সময়মতো ভ্যাট না দিলে ভ্যাট আইন অনুযায়ী মাসিক ২ শতাংশ হারে সরল সুদের বিধান রয়েছে। এটি বাজেটে এক শতাংশ করা হতে পারে। অন্যদিকে ভ্যাট আদায় বাড়াতে বাজেটে মনিটরিংয়ে জোর দেওয়া হচ্ছে। রিটার্নের সঙ্গে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের বার্ষিক আর্থিক বিবরণী জমা দেওয়ার বিধান রেখে সংশোধন করা হচ্ছে ভ্যাট আইন। এ জন্য আইনে নতুন ধারা যুক্ত করা হচ্ছে। বর্তমানে আর্থিক বিবরণী জমা দিতে হয় না। আইন সংশোধন করে এক বছরের আর্থিক বিবরণী পরবর্তী বছরের প্রথম ছয় মাসের (কর মেয়াদ) মধ্যে জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হচ্ছে।

সূত্র জানায়, করোনা মহামারী বিবেচনায় নিয়ে দরিদ্র ও সমস্যাগ্রস্ত মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়ানো হবে। এ জন্য এ খাতে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা। এটি চলতি বাজেটের চেয়ে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বেশি। চলতি বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৯৫ হাজার কোটি টাকা। পাশাপাশি আসছে বাজেটে বাড়ানো হবে ভর্তুকিও। এ খাতে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩৮ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা। প্রণোদনায় ১০ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। আসছে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি খাতে ও প্রণোদনা খাতে বরাদ্দ রাখা হতে পারে প্রায় ৪৯ হাজার কোটি টাকা।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আসন্ন বাজেটে (২০২১-২২) কৃষি খাতে সর্বোচ্চ ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। ভর্তুকিতে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে বিদ্যুৎ খাত। এ খাতে ভর্তুকি বরাদ্দ ৯ হাজার কোটি টাকা। প্রাকৃতিক তরল গ্যাসে (এলএনজি) ভর্তুকি ৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। রপ্তানি খাতে আগামী বছর ভর্তুকি বাবদ সরকারি বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে ৭ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। এ ছাড়া খাদ্যে ৬ হাজার কোটি টাকা, রেমিট্যান্সে ৪ হাজার কোটি, প্রণোদনা প্যাকেজ ঋণের সুদ পরিশোধে ২ হাজার কোটি টাকা এবং সর্বনিম্ন ৫০০ কোটি টাকা ভর্তুকি বাবদ দেওয়া হচ্ছে পাট খাতকে। এর বাইরে অন্য সব খাত মিলিয়ে ১ হাজার ৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকছে ভর্তুকি ও প্রণোদনা বাবদ।

সূত্র জানায়, আসন্ন বাজেটে কভিড-১৯ প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় অগ্রাধিকার খাতগুলোয় প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ নিশ্চিত করাই হবে প্রধান অগ্রাধিকার। এ জন্য স্বাস্থ্য, কৃষি, সমাজকল্যাণ, খাদ্য, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বিশেষ নজর দেওয়া হবে। কভিড-১৯ মোকাবিলায় আগামী বাজেটে ১০ হাজার কোটি টাকার তহবিল থাকছে। চলতি বাজেটেও এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা।

অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতা চূড়ান্ত করা হয়েছে। এখন শেষ মুহূর্তের ঘষামাজা করা হচ্ছে। অর্থমন্ত্রী তার বক্তৃতা শেষ করবেন এই বলে, “আল্লাহুম্মা ইন্নি আউযুবিকা মিনাল বারসি ওয়াল জুনুনি ওয়াল জুজামি ওয়া মিন ছাইয়্যি ইল আসকাম” (অর্থাৎ হে আল্লাহ, অবশ্যই আমি তোমার নিকট ধবল, উন্মাদ, কুষ্ঠরোগ এবং সব প্রকার দুরারোগ্য জটিল ব্যাধি থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি)। আবু দাউদ ১৫৫৪। উল্লেখ্য, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপনের সময় সুরা বাকারার ১৫৫ নম্বর আয়াত পড়ে বক্তব্য শেষ করেছিলেন অর্থমন্ত্রী।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর