বুধবার, ২ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

সবচেয়ে বড় বাজেট কাল

আকার ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা, জোর স্বাস্থ্য খাতে

মানিক মুনতাসির

সবচেয়ে বড় বাজেট কাল

আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী। বিশাল আকারের এই বাজেটে সর্বাধিক গুরুত্ব পাবে মানুষের জীবন ও জীবিকা। জোর দেওয়া হবে স্বাস্থ্য খাতে। করোনা মহামারীতে ক্ষতিগ্রস্ত সবার জন্য কিছু না কিছু দেওয়ার চেষ্টা করবেন অর্থমন্ত্রী। নতুন করের বোঝা চাপাতে চান না অর্থমন্ত্রী। করোনা বাস্তবতায় সংসদের এবারের বাজেট অধিবেশন হবে সংক্ষিপ্ত।  মহামারীর কারণে মানুষের আয় যেমন কমেছে, ঠিক তেমন সরকারেরও আয় কমেছে। ফলে রাজস্ব ঘাটতি বেড়েছে। এ কারণে বাজেট ঘাটতিতে সৃষ্টি হবে নতুন রেকর্ড। আর সেই ঘাটতি মোকাবিলায় এবার কৌশল পরিবর্তন করে অভ্যন্তরীণ উৎসের চেয়ে বৈদেশিক উৎসের প্রতি নির্ভরতা বাড়ানোর চেষ্টা করবেন অর্থমন্ত্রী। নতুন করে করের জাল বিস্তৃত করে রাজস্ব আয় বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে এনবিআর।

বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তারা জানান, আসছে বাজেটের মোট আকার হতে পারে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার। বাজেটে মোট আয় ৩ লাখ ৯২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। সামগ্রিক ঘাটতি দাঁড়াবে প্রায় ২ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা। মানুষের হাতে টাকার সরবরাহ বাড়াতে সরকারি বিনিয়োগ বাড়ানোর পাশাপাশি বেসরকারি খাতেও বিনিয়োগ টানার চেষ্টা থাকবে বছরজুড়েই। এ জন্য বাজেটে মোট উন্নয়ন ব্যয় ২ লাখ ৩৭ হাজার ৭৮ কোটি টাকা। এরমধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ২ লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা ধরা হচ্ছে। আর মোট অনুন্নয়ন ব্যয় ৩ লাখ ৬১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ঘাটতি অর্থায়নে বৈদেশিক ঋণ নেওয়া হবে প্রায় ৯৮ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংক ঋণ নেওয়া হবে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা।  সূত্র জানায়, করোনাভাইরাস মহামারীতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। জীবিকার তাগিদে মৃত্যুঝুঁকি জেনেও প্রাত্যহিক কাজে যাচ্ছে মানুষ। কিন্তু টানা এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা করোনার তান্ডবে চরম মন্দা পরিস্থিতি বিরাজ করছে ব্যবসা-বাণিজ্যে। লাখ লাখ মানুষ হয়ে পড়েছে কর্মহীন। আড়াই কোটি মানুষের নতুন করে দরিদ্রের খাতায় নাম উঠেছে। এ অবস্থায় আসছে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে সর্বাধিক গুরুত্ব পাবে জীবন ও জীবিকা। অগ্রাধিকারের তালিকায় থাকছে স্বাস্থ্য সুরক্ষা, কর্মসংস্থান। ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও কৃষি খাতে থাকছে বিশেষ ছাড়ের ঘোষণা। থাকবে দেশীয় শিল্পের সুরক্ষার ঘোষণা। দরিদ্র মানুষকে সুবিধা দিতে বাড়বে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা। করোনা মহামারীতে মানুষ ও সরকারের আয় কমে যাওয়ায় সাধ ও সাধ্যের সমন্বয় ঘটানোর চেষ্টা থাকবে বাজেটে। সরকারি গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) তথ্যমতে, করোনা মহামারীতে নতুন করে ১ কোটি ৬৪ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। নতুন দরিদ্রদের বেশির ভাগই করোনার কারণে চাকরিহারা। সামষ্টিক অর্থনীতির বেশির ভাগ সূচকই নেতিবাচক পর্যায়ে। রাজস্ব আয়েও ধীরগতি। ফলে মানুষকে কষ্ট না দিয়ে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বাড়ানোর পরিকল্পনা করছেন অর্থমন্ত্রী। বাজেট বক্তৃতাতেও তিনি এ প্রসঙ্গে আলোকপাত করবেন। এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের চেয়ারম্যান ও গবেষণা সংস্থা পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, করোনাভাইরাস মহামারীতে আমাদের সবকিছুই ল-ভ- হয়ে গেছে। জীবন-জীবিকা থেমে গেছে। বহু মানুষ কাজ হারিয়েছে। প্রতিদিন প্রাণহানি ঘটছে। এতে দেশের অর্থনীতির যে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে সেটির স্বীকৃতি দিতে হবে। গত এক বছরে করোনার প্রভাবে অর্থনীতির কোন খাতে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তা সরকারকে নিজস্ব উদ্যোগে যাচাই-বাছাই করতে হবে। এর আলোকে আগামী অর্থবছরের বাজেটে অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনা নিতে হবে। যে পরিকল্পনা নেওয়া হবে তা হতে হবে বাস্তবভিত্তিক। একই সঙ্গে তা বাস্তবায়ন করতে অত্যন্ত শক্তিশালী মনিটরিং ব্যবস্থাও থাকতে হবে। তিনি বলেন, প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সুরক্ষা দিয়ে মানুষকে কাজের সুযোগ করে দিতে হবে। অনেকেই কাজ হারিয়েছেন। আবার অনেকেই নতুন করে দরিদ্র হয়ে গেছেন। করোনার কারণে দুই ধরনের দরিদ্র তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে যারা আগে থেকে দরিদ্র্য ছিল, তারা আরও দরিদ্র হয়েছে। যারা আগে দারিদ্র্যসীমার বাইরে ছিল, তাদের আয় কমে যাওয়ায় নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। গ্রামের তুলনায় শহর এলাকায় দারিদ্র্যের হার বেশি বেড়েছে। কাজহারা ও কর্মহীনদের কাজের ব্যবস্থা করতে হবে। বাজেটে এ সংক্রান্ত সুস্পষ্ট উদ্যোগ ও ঘোষণা থাকতে হবে এবং সে উদ্যোগ বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।  প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি : করোনা মহামারীর ফলে অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ছন্দপতন ঘটেছে। যার প্রভাব পড়েছে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে। এ জন্য আগামী অর্থবছরের জন্য জিডিপি প্রবৃদ্ধির টার্গেট কমিয়ে ধরা হচ্ছে। আগামী অর্থবছরের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। চলতি বাজেটে প্রবৃদ্ধির এই হার ধরা হয় ৮ দশমিক ২ শতাংশ। এদিকে করোনার কারণে মানুষের আয় কমে গেছে। মানুষের হাতে টাকার সরবরাহও কমেছে। যার ফলে মূল্যস্ফীতির চাপ সহনীয়ই থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আসছে বছরে মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৩ শতাংশের মধ্যে ধরে রাখার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। আগামী অর্থবছরে মোট জিডিপির আকার ধরা হচ্ছে ৩৪ লাখ ৮২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। বাজেটের অঙ্ক : বাজেট শুধুই আয়-ব্যয়ের অঙ্ক নয়। বাজেট হচ্ছে যে কোনো রাজনৈতিক সরকারের একটি উন্নয়নের ফিরিস্তি বা দলিলও। আগামী অর্থবছরের বাজেটের মোট আকার ধরা হচ্ছে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটের মূল আকার ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। অবশ্য করোনা বাস্তবতায় সংশোধিত বাজেটে তা কিছুটা কমিয়ে আনা হয়েছে। আসছে বাজেটে বিশাল পরিমাণ এই ব্যয়ের বিপরীতে মোট আয় ধরা হচ্ছে ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছর মোট আয় ধরা হয় ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। সেই হিসাবে আয় বাড়ছে ১১ হাজার কোটি টাকা। মোট আয়ের মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আয় ধরা হচ্ছে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরেও এনবিআরকে একই পরিমাণ রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া রয়েছে। প্রথমবারের মতো এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হচ্ছে না। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে করোনা মহামারী। এই করোনা বাস্তবতায় মানুষের আয় কমে গেছে। সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা পরিস্থিতি। যার ফলে চলতি বছরও রাজস্ব ঘাটতিতে রেকর্ড হতে যাচ্ছে। এ বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে এনবিআরের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হচ্ছে না বলে জানা গেছে। এ ছাড়া আগামী বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বহির্ভূত কর থেকে আসবে ১৬ হাজার কোটি টাকা। আর কর ব্যতীত প্রাপ্তি ধরা হচ্ছে ৪৩ হাজার কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে বৈদেশিক অনুদান পাওয়ার পরিমাণ ধরা হচ্ছে ৩ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। অনুন্নয়ন ও আবর্তক ব্যয় : আগামী বাজেটে সরকারের পরিচালন ব্যয় বা অনুন্নয়ন ধরা হচ্ছে ৩ লাখ ৬১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। করোনা মহামারীর ফলে সরকারের পরিচালন ব্যয় বেড়েছে। চলতি বছরের বাজেটে পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৪৮ হাজার ১৮০ কোটি টাকা। সে তুলনায় আসছে বছরে পরিচালন ব্যয় বাড়বে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। আর আবর্তক ব্যয় ধরা হচ্ছে ৩ লাখ ২৮ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ বাবদ ব্যয় ধরা হচ্ছে ৬২ হাজার কোটি টাকা। আর বিদেশি ঋণের সুদ ব্যয় ধরা হচ্ছে ৬ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা। উন্নয়ন ব্যয় : আসছে বাজেটে মোট উন্নয়ন ব্যয় ধরা হচ্ছে ২ লাখ ৩৭ হাজার ৭৮ কোটি টাকা। এরমধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ধরা হয়েছে ২ লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা, যা এরই মধ্যে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (এনইসি) অনুমোদন দিয়েছে। চলতি বছরের বাজেটে এডিপির আকার ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা। অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে এডিপির বাস্তবায়ন হয়েছে ৩৫ শতাংশেরও কম।  বাজেট ঘাটতি : দীর্ঘদিন পর এই প্রথমবারের মতো বাজেট ঘাটতি ৬ শতাংশের বেশি ধরা হচ্ছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে সরকারের আয় কমে যাওয়া। করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে সরকারের রাজস্ব আয়ে ধস নেমেছে। যার ফলে আগামী বছরের বাজেটে বাজেট ঘাটতি ধরা হচ্ছে প্রায় ২ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা। চলতি বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। এতদিন বাজেট ঘাটতি মোট জিডিপির ৫ শতাংশের মধ্যে ধরে রাখার বৃত্ত ভেঙে তা ৬ শতাংশের ওপরে চলে যাচ্ছে, যা মূলত সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করবে। শুধু তাই নয়, অনুদান বাদে আসছে বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ ধরা হচ্ছে ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। আর অনুদানসহ সামগ্রিক ঘাটতি ধরা হচ্ছে ২ লাখ ১১ হাজার ১৯১ কোটি টাকা। ঘাটতি অর্থায়ন : বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে সরকার বরাবরই দুই উৎসকে বেছে নেয়। এরমধ্যে বিদেশি ও অভ্যন্তরীণ উৎস। আগামী বাজেটে অভ্যন্তরীণ উৎসের নির্ভরতা কিছুটা কমিয়ে বৈদেশিক উৎসের প্রতি নির্ভরতা বাড়ানো হচ্ছে। আসছে বছরে অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ খাতের মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার ঋণ নেবে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা। আর জাতীয় সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেবে ৩২ হাজার কোটি টাকা। অন্যান্য খাত থেকে নেওয়া হবে ৫ হাজার ১ কোটি টাকা। বাজেটে বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৯৭ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা। বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ পাওয়ার যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে তাও এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ। অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতা : অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতা চূড়ান্ত করা হয়েছে। এখন শেষ মুহূর্তের ঘষামাজা করা হচ্ছে। অর্থমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতা শেষ করবেন এই বলে, “আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিনাল বারসি ওয়াল জুনুনি ওয়াল জুজামি ওয়া মিন সাইয়্যি ইল আসকাম” (অর্থ : হে আল্লাহ অবশ্যই আমি তোমার নিকট ধবল, উন্মাদ, কুষ্ঠরোগ এবং সকল প্রকার দুরারোগ্য জটিল ব্যাধি থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি)। আবু দাউদ ১৫৫৪। উল্লেখ্য, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপনের সময় সূরা বাকারার ১৫৫ নম্বর আয়াত পড়ে বক্তব্য শেষ করেছিলেন অর্থমন্ত্রী। এ ছাড়া অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট বক্তৃতায় তুলে ধরবেন দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক চিত্র।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর