বুধবার, ২ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

নামে মাত্র লকডাউন

মাস্ক ব্যবহার করছে না মানুষ, ছড়িয়ে পড়ছে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট, বাড়ছে সংক্রমণ ও মৃত্যু, গণপরিবহন, বিপণিবিতান ও কাঁচাবাজারে উপেক্ষিত স্বাস্থ্যবিধি

মাহমুদ আজহার

নামে মাত্র লকডাউন

দেশজুড়ে চলছে নামকাওয়াস্তে ‘লকডাউন’ বা ‘বিধিনিষেধ’। বাড়ছে করোনা সংক্রমণ, বাড়ছে মৃত্যু। মানুষ এখন আর মানছে না স্বাস্থ্যবিধি। অধিকাংশ মানুষই এখন মাস্ক ব্যবহার করেন না। স্বাস্থ্যবিধি না মেনেই সারা দেশে অবাধে চলছে গণপরিবহন। বিপণিবিতানসহ কাঁচাবাজারগুলোতে বালাই নেই স্বাস্থ্যবিধির। দেশে এরই মধ্যে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট করোনার ৩১ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ১৫ জন করোনাকালে ভারত ভ্রমণ করেননি। এটাকে ‘বিপজ্জনক’ বলছেন জনস্বাস্থ্যবিষারদরা। তারা আশঙ্কা করেন, সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে কঠোর লকডাউন মানা না হলে করোনার ভারতীয় ধরন দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

এদিকে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে এখনো মালামাল আসা যাওয়া হচ্ছে। কোনো কোনো সীমান্তে অবৈধভাবেও যাতায়াত রয়েছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশজুড়ে গড়পড়তা লকডাউনের কোনো বিজ্ঞানভিত্তিক যুক্তি নেই। এলাকাভিত্তিক কার্যকর লকডাউন করতে হবে। মানুষকে মাস্ক ব্যবহার করাসহ স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে।

স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, গতকাল এক দিনে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের মধ্যে আরও ৪১ জনের মৃত্যু হয়েছে; সংক্রমণ ধরা পড়েছে আরও ১ হাজার ৭৬৫ জনের মধ্যে। দৈনিক শনাক্ত ও মৃত্যুর এই সংখ্যা ৩ সপ্তাহের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে গত ৬ মে ১ হাজার ৮২২ জন আক্রান্তের খবর দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদফতর। আর এক দিনে ৫৬ জনের মৃত্যুর খবর এসেছিল ৯ মে। গত কয়েক দিন ধরে সংক্রমণ ও মৃত্যু সংখ্যা কিছুটা কম থাকলেও আবার তা বাড়তে শুরু করেছে। এ দিকে করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে চলমান ‘লকডাউন’ বা ‘বিধি-নিষেধ’ আগামী ৬ জুন পর্যন্ত বাড়িয়েছে সরকার। গত ৩০ মে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এতে বলা হয়, করোনাভাইরাসজনিত রোগ কভিড-১৯ সংক্রমণের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় আগের সব বিধি-নিষেধের সময়সীমা আগামী ৬ জুন মধ্যরাত পর্যন্ত বর্ধিত করা হলো। স্বাস্থ্যবিধি মেনে আন্তজেলাসহ সব ধরনের গণপরিবহন আসন সংখ্যার অর্ধেক যাত্রী নিয়ে চলাচলের সুযোগ রেখে সবশেষ ৩০ মে পর্যন্ত ‘লকডাউন’ বাড়ানো হয়। এ ছাড়া হোটেল-রেস্তোরাঁ ও খাবার দোকানসমূহে আসন সংখ্যার অর্ধেক সেবাগ্রহীতাকে সেবা দেওয়ার সুযোগ রাখা হয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, যেভাবে এখন দেশজুড়ে লকডাউন দেওয়া হচ্ছে তার বিজ্ঞানসম্মত কোনো যুক্তি নেই। যেই এলাকায় সংক্রমণ, সেই এলাকায় লকডাউন থাকা উচিত। সরকার এতদিন পর সেই পথেই যাচ্ছে। মনে রাখতে হবে লকডাউন মানেই লকডাউন। নির্দিষ্ট এলাকায় লকডাউন করতে হবে, লকডাউনের মতো করেই। সেই এলাকায় কাউকে ঢুকতে দেওয়া হবে না, বের হতে দেওয়া হবে না। এখন আবার সংক্রমণের হার বাড়ছে বিশেষ করে সীমান্ত এলাকায়। এর দুটি কারণ আছে। প্রথমত, ঢাকা থেকে ঈদের ছুটিতে মানুষ বাড়ি যায়, তখন সংক্রমণ ছড়ানোর ঝুঁকি নিয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত, ভারতের সঙ্গে স্থলবন্দরগুলোতে পণ্যসহ সীমিত পরিসরে মানুষের যাতায়াত আছে। আবার অবৈধভাবেও মানুষ যাতায়াত করছে। এটা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে পারছে না সরকার। মালামাল আনা নেওয়ার ক্ষেত্রে যারা গাড়ি চালক বা এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তাদের ব্যাপারে তারা ঠিকমতো কোয়ারেন্টাইন করছে কি-না তার নজরদারি বাড়াতে হবে। এটা করতে না পারলে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়বেই।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সীমান্তে যারা সংক্রমিত তাদের চিকিৎসা জোরদার করতে হবে। দেশের প্রতিটি উপজেলাগুলোতে করোনার প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া নিশ্চিত করতে হবে। জেলা হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ থাকতে হবে। বিশেষ করে এখন সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে আইসিইউ নিশ্চিত করতে হবে।’ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ মানুষের মুখে মাস্ক নেই। সামাজিক দূরত্বও মেনে চলতে অনীহা। প্রতিদিন বিকাল থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ভ্যানে এবং ফুটপাথে পোশাকসহ নানা নিত্যপণ্য বিক্রি করতে দেখা যায়। সেখানে ক্রেতারাও হুমড়ি খেয়ে পড়েন। অধিকাংশ ক্রেতা-বিক্রেতার মুখে থাকে না মাস্ক। গতকাল বিকালে রাজধানীর শাহজাদপুরে সুবাস্তু টাওয়ারের সামনে ফুটপাথে ভ্যানে বাচ্চাদের গরমের কাপড় বিক্রি করছিলেন রফিক নামে এক যুবক। তার মুখে ছিল না মাস্ক। সেখানে প্রায় সাত-আটজন ক্রেতার মধ্যে দুজনের মুখে ছিল মাস্ক। মাস্ক কেন ব্যবহার করছেন না জানতে চাইলে রফিক হেসে বলেন, আমরা সারাদিন হাঁড়ভাঙা পরিশ্রম করি। আমাদের করোনা হবে না। এটা বড়লোকদের রোগ, গরিবের না। একাধিক ক্রেতার কাছে জানতে চাইলে তারাও বিষয়টিকে হেসে উড়িয়ে দেন। খিলগাঁও তালতলা-বটতলা এলাকায় প্রতিদিনই বিকাল থেকে দীর্ঘ রাত পর্যন্ত বিভিন্ন সুস্বাদু খাবারসহ বিভিন্ন দোকান খোলা রাখা হয়। সেখানেও প্রতিদিন তরুণ-তরুণীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের ভিড় থাকে লক্ষ্যণীয়। কিন্তু অধিকাংশ মানুষের মাস্ক ব্যবহারে অনীহা। এ ব্যাপারে প্রশাসন বা নির্বাহী মেজিস্ট্রেটদের নেই তেমন তদারকি। রাজধানীর বিভিন্ন বিপণিবিতান ও কাঁচাবাজারেও বালাই নেই স্বাস্থ্যবিধির। এখন আর আগের মতো তদারকিও হয় না। ভ্রাম্যমাণ আদালতের সংখ্যাও কম।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা জেলা সিভিল সার্জন ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান বলেন, ‘স্বাস্থ্যবিধি মানার ওপর করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নির্ভর করে। জীবন-জীবিকার জন্য মানুষ কাজে বের হচ্ছেন। কিন্তু অসচেতনতার কারণে অনেকেই মাস্ক ব্যবহার করছেন না। ফলে আক্রান্ত হচ্ছেন তারা, বাড়ছে মৃত্যুঝুঁকি। ঢাকা জেলায় সংক্রমণ অনেক কমে এসেছে। মহানগরেও সংক্রমণ হার ৪-৫ শতাংশের মধ্যে থাকছে। কিন্তু এখন ঝুঁকি দেখা দিয়েছে সীমান্ত এলাকার জেলাগুলোতে। সেখানে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। করোনা প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্ট তৈরি করে। মাস্ক ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে যে কোনো ভ্যারিয়েন্ট থেকেই সুরক্ষা পাওয়া সম্ভব। তাই গণপরিবহন, কাঁচাবাজার, বিপণিবিতান এবং কর্মস্থলে অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে।’

গণপরিবহনে উপেক্ষিত স্বাস্থ্যবিধি : স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার শর্তে দেশে গণপরিবহন চলাচলের অনুমতি দিলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন। শর্ত মেনে চলছে না গণপরিবহন। রাজধানীতে গণপরিবহনগুলোতে দাঁড়িয়েও যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, হ্যান্ড স্যানিটাইজার রাখা কিংবা মাস্ক পরিধান করতে অনীহা দেখা গেছে চালক ও হেলপারের মধ্যে। বাস মালিক সমিতির নির্দেশনায় ছিল, মাস্ক ছাড়া কোনো যাত্রী গাড়িতে ওঠানো যাবে না। চালক, সুপারভাইজার, হেলপার এবং টিকিট বিক্রিতে নিয়োজিতরাও মাস্ক পরবে। তাদের হাত ধোয়ার জন্য পর্যাপ্ত সাবান-পানি, ধারণক্ষমতার অর্ধেক যাত্রী বহন করার পরিপ্রেক্ষিতে বিআরটিএর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যাত্রীদের কাছ থেকে বর্তমান ভাড়ার অতিরিক্ত ৬০ শতাংশ ভাড়া আদায় করা যাবে। যাত্রার শুরু ও শেষে গাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করাসহ জীবাণুনাশক দিয়ে জীবাণুমুক্ত করতে হবে। কিন্তু যাত্রীদের কাছ থেকে শুধু ভাড়াই বেশি আদায় করা হচ্ছে, শর্ত ও বিধি-নিষেধ মানা হয় না। লঞ্চের চিত্রও একই। কোথাও তদারকি নেই। হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক বা তাপমাত্রা মাপার যন্ত্র ব্যবহার করতে দেখা যায়নি। গাদাগাদি করে তোলা হচ্ছে যাত্রী। সদরঘাট থেকে হাতিয়াগামী এক লঞ্চ যাত্রী বলেন, ‘লঞ্চে স্বাস্থ্যবিধি বলতে কিছুই নেই। ওঠার সময় হ্যান্ড স্যানিটাইজিং হয় না। যাত্রী তো দূরের কথা লঞ্চের আনসার সদস্যরাও মাস্ক পরছেন না। সিঙ্গেল কেবিনে দুই থেকে তিনজন পর্যন্ত উঠছেন। ডেকে গাদাগাদি করে যাচ্ছে সবাই। কোথাও কোনো তদারকি নেই। ভাড়া কিন্তু ৬০ ভাগ বেশি ঠিকই আদায় করা হচ্ছে। তবে ব্যতিক্রম দেখা গেছে রেল স্টেশনে। নগরীর কমলাপুর স্টেশনে গিয়ে দেখা গেছে, স্টেশনে ঢোকার মুখে প্রতিটি যাত্রীকে হ্যান্ড স্যানিটাইজিং করা হচ্ছে। শরীরের তাপমাত্রাও মাপা হচ্ছে। ভিতরে জীবাণুনাশক ছিটানোর পাশাপাশি পানি দিয়ে ধোয়া হচ্ছে। ট্রেনে পাশাপাশি দুই সিটের মধ্যে এক সিটে বসিয়ে যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে। রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন বলেন, ‘এখন আমাদের ১০৮টি আন্তনগর ট্রেন রয়েছে। তার মধ্যে ২৮ জোড়া তথা ৫৬টি ট্রেন চালাব। এতে অর্ধেক আসন ফাঁকা থাকবে। টিকিট অনলাইন থেকে সংগ্রহ করতে হবে। সংক্রমণের কারণে কাউন্টারে কোনো টিকিট রাখা হয়নি।’

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর