বুধবার, ২ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা
স্বামীকে ছয় টুকরো করেন স্ত্রী

ক্ষোভ মিটেছে, ফাঁসিতে ঝুলতে রাজি

নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজধানীর মহাখালীতে খন্ডিত লাশ উদ্ধারের ঘটনায় নিহত ময়না মিয়ার প্রথম স্ত্রী ফাতেমা খাতুন শিল্পীকে গ্রেফতার করে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে হত্যায় সংশ্লিষ্ট থাকার কথা স্বীকার করে খুনের রোমহর্ষক বর্ণনা করেছেন তিনি। বলেছেন, ‘ভালোবাসা পেতে কত কিছুই না করেছি। টাকা দিয়েছি। তাবিজ করেছি। কিন্তু পাইনি ভালোবাসা। তাই খুন করেছি স্বামীকে। আমার মনের ক্ষোভ মিটছে এখন। হাসি মুখে ফাঁসিতে ঝুলতেও এখন রাজি আমি।’ ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) গুলশান বিভাগ সূত্র এসব তথ্য দিয়ে বলেছেন, স্বামী খুনে তার কোনো অনুশোচনা নেই। এদিকে গতকাল দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে যুগ্ম কমিশনার (ডিবি-উত্তর) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, গ্রেফতারকৃত শিল্পী পুরো ঘটনার বর্ণনা দিয়েছে। স্বামীর সঙ্গে মনোমালিন্যের জের ধরেই নৃশংস এ হত্যাকান্ড। এর আগে, রাজধানীর বনানীর ৪ নম্বর থানা রোডের ১৮ নম্বর বাসার একটি ইলেক্ট্রনিক কোম্পানির অফিস থেকে শিল্পীকে গ্রেফতার করা হয়। লাশের টুকরোগুলো গুম করার পর শিল্পী আবারও স্বাভাবিক জীবনযাপন শুরু করেছিলেন। গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) মর্গে নিহতের লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢামেক ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. মোহাম্মদ মাকসুদ। সংবাদ সম্মেলনে ডিবি উত্তরের যুগ্ম কমিশনার বলেন, গত ২৩ মে থেকে ময়না মিয়া কড়াইল বস্তিতে তার স্ত্রী শিল্পীর বাসায় ছিলেন। পারিবারিক কলহ, টাকা-পয়সা বণ্টন ও একাধিক বিয়েকে কেন্দ্র করে তাদের মনোমালিন্য চরম আকার ধারণ করে। পরে ময়নাকে হত্যার পরিকল্পনা করেন ফাতেমা। সে মোতাবেক দুই পাতা ঘুমের ওষুধ কিনে এনে বেশ কয়েকটা ট্যাবলেট জুসের সঙ্গে মিশিয়ে শুক্রবার রাতে ময়নাকে খাওয়ানো হয়। এতে ময়না সারারাত ও পরের দিন অচেতন থাকার পর শনিবার সন্ধ্যার দিকে কিছুটা স্বাভাবিক হয়। ঘুম থেকে উঠে আবার স্ত্রীকে গালমন্দ করে আক্রমণ করতে গেলে নিজেই বিছানায় লুটিয়ে পড়েন। এ সময় ময়না পানি পানি বলে আর্তনাদ করলে ফাতেমার ঘুমের ট্যাবলেট মেশানো জুস আবার তার মুখে ঢেলে দেন। এক পর্যায়ে ময়না মিয়া নিস্তেজ হয়ে খাটে পড়ে গেলে ফাতেমা তার ওড়না দিয়ে ময়নার দুই হাত শরীরের সঙ্গে বেঁধে রাখে এবং মুখ স্কচটেপ দিয়ে আটকে দেয়। পরে ময়নার বুকের ওপরে বসে চাকু দিয়ে গলা কাটা শুরু করেন শিল্পী। কিছুটা গলা কাটার পর ময়না মিয়া ধস্তাধস্তি করে শিল্পীর হাতে খামছি ও কামড় দেন। এতে শিল্পীর রাগ আরও বেড়ে যায়। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে তারা দুজনই খাট থেকে নিচে পড়ে গেলে, ফাতেমা আবার ময়নার বুকের ওপর বসে গলার বাকি অংশ কেটে দেয়। এতে মৃত্যু ঘটে ময়নার। সারারাত এবং পরদিন রবিবার সারা দিন লাশ ওভাবেই ফ্লোরে পড়ে ছিল।

হত্যার ২৪ ঘণ্টা পর রবিবার রাতে ধারালো দা দিয়ে লাশ ছয় টুকরো করেন ফাতেমা। একটি লাল রঙের কাপড়ের ব্যাগে মাথা, শরীরের মূল অংশকে একটি রঙের ড্রামে ও দুই হাত, দু পা একটি বড় কাপড়ের ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখে। পরে ১৩০০ টাকা দিয়ে একটি রিকশা ভাড়া করে। প্রথমে শরীরের মূল অংশ রাখা ড্রামটি ফেলে আসে মহাখালী কাঁচা বাজার সংলগ্ন এলাকায়, এরপর মহাখালী বাস স্ট্যান্ডে দুই হাত দুই পা ভর্তি ব্যাগ ফেলে বাসায় চলে আসে শিল্পী। পরে খন্ডিত মস্তকটি একটি লাল ব্যাগে ভরে বনানী ১১ নম্বর ব্রিজের কাছে গুলশান লেকে ফেলে দেয়। বাসায় ফিরে স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে থাকে শিল্পী। ধারণা ছিল ময়নার লাশ কেউ শনাক্ত করতে পারবে না। শিল্পীও সন্দেহের বাইরে থাকবে।

ডিবি কর্মকর্তা হারুন অর রশীদ আরও বলেন, প্রথমে ময়না মিয়ার পরিচয় শনাক্ত করা হয়। এরপর মোবাইল ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে ফাতেমাকে গ্রেফতার করা হয়। ইতিমধ্যে তিনি ঘটনার সবকিছু স্বীকার করেছেন। তার দেখানো মতে ভিকটিমের রক্তমাখা জামাকাপড়, ধারালো ছুরি ও দা, বিষাক্ত পেয়ালা ও শিলপাটা উদ্ধার করা হয়েছে। এ ঘটনায় বনানী থানায় হত্যা মামলা করেন নিহত ময়না মিয়ার দ্বিতীয় স্ত্রী নাসরিন আক্তার। মামলাটি আরও অধিকতর তদন্ত করে এর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হবে। শিল্পী একাই এ হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটিয়েছে বলে স্বীকার করেছেন। আমরা খুব দ্রুত এ মামলার চার্জশিট দিতে সক্ষম হব। ডিবির একটি সূত্র জানায়, মানুষের বাসা বাড়িতে কাজ করে মাসে ১২-১৫ হাজার টাকা আয় করতেন শিল্পী। দুই সন্তানকে নিয়ে কড়াইল বস্তির ওই বাসায় ভাড়া থাকলেও সবসময় চাইতেন স্বামী ময়না মিয়াও তাদের সঙ্গে থাকুক। সন্তানরা এক খাটে আর ময়না মিয়াকে নিয়ে আলাদা থাকার জন্য আরেকটি খাট কিনতে চেয়েছিলেন তিনি। এমনকি ময়না মিয়া তার বাসায় গেলে ভালো ভালো খাবারও রান্না করতেন। চাওয়া মাত্র দিয়ে দিতেন জমানো টাকা। স্বামীকে বশে আনতে নিয়েছিলেন তাবিজও। কিন্তু এতকিছুর পরও ময়নার ভালোবাসা পেতেন না। উল্টো ময়না মিয়া নাসরিন আক্তার নামে আরেক নারীকে বিয়ে করেন। দ্বিতীয় ওই স্ত্রীর প্রতি ময়না মিয়ার বেশি ভালোবাসা মেনে নিতে পারতেন না শিল্পী। পুলিশের হাতে গ্রেফতারের পর শিল্পী বার বার বলতে থাকেন, আমি নারী সুখ পাই নাই, অন্য নারীকেও সুখ পাইতে দিব না। আমি ওর (দ্বিতীয় স্ত্রী) চেয়ে কোনো অংশে কম, যে সুখ পাইলাম না। আমি পালাইতে পারতাম, কিন্তু পালাই নাই। কারণ আমি এটাই চেয়েছি। আর কেউ যাতে এ ঘটনায় ফেঁসে না যায় সে জন্য আগেই দুই সন্তানকে বাবার বাড়ি ময়মনসিংহে পাঠিয়ে দিয়েছি।

হত্যার বিচার চাইলেন দ্বিতীয় স্ত্রী : স্বামীর লাশ বুঝে নিতে গতকাল দুপুরে ঢামেক মর্গে গিয়ে ময়না মিয়ার দ্বিতীয় স্ত্রী নাসরিন আক্তার বলেন, ৮ বছর আগে ময়না মিয়ার সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তখন ময়না ময়মনসিংহ এলাকায় অটোরিকশা চালাতেন। রিহান (১৬ মাস) নামে তাদের এক ছেলে রয়েছে। ২৩ মে কিশোরগঞ্জ থেকে সিলেটে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার কথা বলে ময়না চলে আসেন। ওই দিন রাত থেকে মোবাইলে অনেকবার কল করেও ময়নার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি তিনি। এরপর পুলিশের মাধ্যমে খবর পাই ময়না প্রথম স্ত্রীর হাতে খুন হয়েছেন। আমি স্বামী হত্যার বিচার চাই। গত রবিবার রাতে রাজধানীল মহাখালীর আমতলী সড়ক থেকে ময়না মিয়ার মাথা, হাত, পা ছাড়া গলা কাটা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। একইদিন রাতে মহাখালীর আমতলী এলাকা থেকে কাটা দুই হাত ও পা উদ্ধার করা হয়। সর্বশেষ গত সোমবার বিকালে মহাখালীর ওয়ারলেস এলাকার টিএনটি মাঠ সংলগ্ন ঝিল থেকে ময়না মিয়ার খন্ডিত লাশ মস্তক উদ্ধার করা হয়। সর্বমোট ছয় অংশে ভাগ ছিল ময়না মিয়ার পুরো শরীর।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর