শুক্রবার, ৪ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

যত চ্যালেঞ্জ তত সুযোগ

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

যত চ্যালেঞ্জ তত সুযোগ

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল তাঁর তৃতীয় বাজেট এমন একটি সময় উপস্থাপন করেছেন, যখন পুরো বিশ্বের অর্থনীতি করোনা মহামারীর আঘাতে বিপর্যস্ত। চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী উৎপাদন, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, আমদানি-রপ্তানি বৃদ্ধি ও দারিদ্র্য বিমোচনের মতো সরকারের অগ্রাধিকার। কভিড-১৯ মোকাবিলায় দেশের মানুষকে টিকার আওতায় আনাও বড় চ্যালেঞ্জ। চ্যালেঞ্জ রয়েছে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলের মতো মেগাপ্রকল্পগুলো সময় মতো বাস্তবায়নেও। এমন একটি সময়ে সাহসী বাংলাদেশ বুক পেতে দিয়ে আরও একটি চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছে- স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, বাজেটে যত চ্যালেঞ্জ তত সুযোগও রেখেছেন অর্থমন্ত্রী। এখন এই সুযোগগুলো কাজে লাগিয়ে কৃষি ও শিল্পোৎপাদন বাড়াতে পারলে, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারলে, ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যবসার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য প্রণোদনার পাশাপাশি নীতি সহায়তা নিশ্চিত করতে পারলেই সামনের চ্যালেঞ্জগুলোকে সুযোগে রূপান্তরিত করা যাবে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বাজেট উপস্থাপনকালে নিজেই বলেছেন, ‘সরকার বিশ্বাস করে এভরি চ্যালেঞ্জ ক্রিয়েটস লট অব অপরচুনিটিস অ্যান্ড উয়িন্ডোজ ফর মুভিং ফরোয়ার্ড। সে কারণে কভিড-১৯ এর কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে সৃষ্ট ক্ষতের পাশাপাশি কিছু সুযোগও তৈরি হবে যা গ্রহণে সরকার সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করবে।’

বিশ্লেষকরা বলেন, চলমান পরিস্থিতিতে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ঘোষিত বাজেট বাস্তবায়ন। কারণ প্রায় ৬ লাখ কোটি টাকার বাজেটে

এবার যে ঘাটতি ধরা হয়েছে সেটি সরকারের রীতি অনুযায়ী ৫ শতাংশের সীমা ছাড়িয়ে ৬ শতাংশে উঠে গেছে। করোনা পরিস্থিতিতে দেশীয় শিল্পকে উজ্জীবিত রাখতে নানা ধরনের প্রণোদনা ও করছাড় সুবিধা দিতে হয়েছে। এতে করে লক্ষ্য অনুযায়ী রাজস্ব আদায় নিয়েও শঙ্কা রয়েছে। শঙ্কা রয়েছে সময় মতো দেশের মানুষকে টিকার আওতায় আনার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন নিয়েও। যখন কভিড-১৯ এর দ্বিতীয় ঢেউয়ের পর তৃতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা করা হচ্ছে। প্রস্তাবিত বাজেটে বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধিও বড় চ্যালেঞ্জ। চলতি অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল  ১৫ শতাংশ,  প্রথম ৮ মাসে তা হয়েছে ৮ দশমিক ৮ শতাংশ। ঋণপ্রবাহ থেকেই বোঝা যাচ্ছে, বেসরকারি খাতে যত বিনিয়োগ আশা করা হয়েছিল, বাস্তবে তার কাছাকাছিও হয়নি। কিন্তু এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য বাজেটে অর্থমন্ত্রী নানা ধরনের সুযোগ তৈরি করেছেন। বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য দিয়েছেন সম্ভাবনাময় শিল্পে কর ও ভ্যাট ছাড়। 

যেখানে যত সুযোগ : প্রস্তাবিত বাজেটে করপোরেট করহার কমানো হয়েছে, এটি বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে সহায়তা করবে। তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ২২টি খাতের পাশাপাশি ৬টি নতুন খাতকে করমুক্ত প্রস্তাব করা হয়েছে। বিশেষ করে মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন, আইটি ফ্রিল্যান্সিং ও ই-বুক তৈরিতে নতুন উদ্যোগ বাড়বে। শুধু তাই নয়, বিদেশ থেকে আমদানি কমাতে মাদারবোর্ড, ক্যাসিং, ইউপিএস, স্পিকার, সাউন্ড সিস্টেম, পাওয়ার সাপ্লাই, ইউএসবি ক্যাবল, সিসিটিভি এবং পেনড্রাইভ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানও পাবে ১০ বছর মেয়াদে কর অব্যাহতি সুবিধা। এসব খাতে করছাড়ের কারণে তরুণ প্রজন্ম বিনিয়োগে উৎসাহিত হবে। হালকা প্রকৌশল শিল্পও পেয়েছে ১০ বছরের কর অব্যাহতি। এতে করে ছোট ছোট যন্ত্রাংশ নির্মাণের কারখানা গড়ে উঠবে। ছোট শিল্পের পাশাপাশি দেশে ভারী শিল্পকে উৎসাহিত করতে কর অব্যাহতি রয়েছে। অন্যূন ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগে স্থাপিত অটোমোবাইল (থ্রি হুইলার ও ফোর হুইলার) উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান পাবে ২০ বছর কর অব্যাহতি। ১০ বছর কর অব্যাহতি পাচ্ছে ওভেন, ব্লেন্ডার, ওয়াশিং মেশিনসহ হোম ও কিচেন অ্যাপ্লায়েন্স উৎপাদনে স্থাপিত প্রতিষ্ঠান। কর অব্যাহতি রয়েছে কৃষিভিত্তিক শিল্পেও। ফল, শাক-সবজি প্রক্রিয়াজাতকরণ,  দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদন, এবং শিশুখাদ্য উৎপাদনকারী উদ্যোক্তাকে ১০ বছর মেয়াদে কর অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে। কৃষি যন্ত্রপাতি উৎপাদনকারী উদ্যোক্তাকেও ১০ বছর মেয়াদে কর অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে। এতে করে কৃষি উৎপাদনে ব্যবহৃত সেচযন্ত্র, পাওয়ার টিলার, ধান মিল ও ধান মাড়াই যন্ত্র সহজলভ্য হবে। এমনকি কর্মসংস্থান বাড়াতে দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচিও পাবে কর অব্যাহতি। কৃষি, ফিশারিজ, বিজ্ঞান ও আইটি খাতের সব ধরনের ডিপ্লোমা ডিগ্রি ও ভোকেশনাল শিক্ষা ছাড়াও অটোমোবাইল, মেকানিক্যাল, শিপ বিল্ডিং, লেদার,  রেফ্রিজারেশন, সিরামিকস, মেকানিস্ট, গার্মেন্ট ডিজাইনসহ স্বাস্থ্য খাতে ফার্মেসি, নার্সিং, ইন্টিগ্রেটেড মেডিকেল, রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং, আলট্রাসাউন্ড, ডেন্টাল, অ্যানিম্যাল হেলথ অ্যান্ড প্রডাকশন সার্ভিস, পোলট্রি ফার্মিংয়ের ওপর পেশাগত প্রশিক্ষণে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি হবে, যা দেশে কর্মসংস্থান বাড়ানোর পাশাপাশি বিদেশে দক্ষ জনশক্তি রপ্তানিতে সহায়তা করবে।  শিল্পের পাশাপাশি স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগেও করছাড় রয়েছে। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে মানসম্পন্ন চিকিৎসা ব্যবস্থাকে সুলভ করতে হাসপাতালের আয়কে ১০ বছরের জন্য কর অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে। এতে করে মানুষের চিকিৎসা সুবিধা বাড়বে। নারী উদ্যোক্তাদের সুবিধা দিতে এসএমই খাতের ৭০ লাখ টাকা পর্যন্ত বার্ষিক টার্নওভারের প্রতিষ্ঠানকে করমুক্ত সুবিধা দেওয়া হয়েছে। সুবিধা আছে পুঁজিবাজারেও। দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগে সুকুক বন্ডে বিনিয়োগে কর অব্যাহতি রয়েছে। এমন কি ক্ষুদ্রঋণের সুদের হার কমাতে এ খাতে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের ক্ষুদ্রঋণের আয় করমুক্ত সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এটি দরিদ্র ও নিম্নআয়ের মানুষের সুযোগ সৃষ্টি হবে। করোনা মহামারীর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প খাত বিশেষ করে নির্মাণ শিল্পকে উজ্জীবিত করতে কর ও ভ্যাটছাড় রয়েছে। সিমেন্ট ও স্টিল শিল্পে অগ্রিম করছাড়ের কারণে হাউসিং নির্মাণ শিল্পে ব্যবহৃত রড, সিমেন্টের দাম কমবে। এ ছাড়া স্থানীয় শিল্পের প্রবৃদ্ধির গতি ধরে রাখতে এলপিজি সিলিন্ডার উৎপাদনে রেফ্রিজারেটর, ফ্রিজার, এসি কমপ্রেসার, মোটরকার ও মোটরযান উৎপাদনে বিভিন্ন মেয়াদে রয়েছে ভ্যাট অব্যাহতি। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাল প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে ভ্যাট রেয়াত প্রস্তাব করা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সাবেক বিকল্প নির্বাহী পরিচালক ড. মাহবুব আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, একটি চ্যালেঞ্জিং সময়ে যে ধরনের সম্প্রসারণমূলক বাজেট দরকার ছিল, অর্থমন্ত্রী সে ধরনের বাজেটই দিয়েছেন। এ ছাড়া কোনো উপায়ও ছিল না। কারণ করোনা মহামারীকে সামাল দিতে বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা সুবিধা ছাড়াও টিকা কর্মসূচি নিশ্চিত করতে সরকারের ব্যয় বাড়ছে। এখন এই ব্যয় মেটাতে এনবিআরের যে লক্ষ্য দেওয়া হয়েছে সেটি অর্জন করা কঠিন হবে। এটি চ্যালেঞ্জ। কাক্সিক্ষত রাজস্ব আদায়ের শঙ্কা মাথায় নিয়েও বেসরকারি শিল্প খাতকে উজ্জীবিত করতে অর্থমন্ত্রী করপোরেট কর কমানোসহ বিভিন্ন খাতে যে কর অব্যাহতি সুবিধা দিয়েছেন, সেটি সাহসী সিদ্ধান্ত। এই সুযোগ নিয়ে বেসরকারি খাত বিনিয়োগে এলে উৎপাদন বাড়বে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। গতি ফিরে আসবে অর্থনীতিতে। আর অর্থনীতি গতি পেলে তখন অন্য চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা সহজ হবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর