বুধবার, ৯ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

কানাডায় হেইট ক্রাইমের নির্মম শিকার পরিবারের চারজন

লাবলু আনসার, যুক্তরাষ্ট্র

কানাডায় হেইট ক্রাইমের নির্মম শিকার পরিবারের চারজন

কানাডায় গাড়িচাপা দিয়ে পরিবারের এই চার সদস্যকে হত্যা করা হয়। ৯ বছরের শিশু লড়ছে মৃত্যুর সঙ্গে -বাংলাদেশ প্রতিদিন

কানাডায় পাকিস্তানি এক পরিবারের চারজনকে গাড়িচাপায় হত্যা এবং আরেকজনকে গুরুতর আহত করা হয়েছে। অন্টারিয়ো প্রদেশের লন্ডন সিটির মেয়র এড হোল্ডার এবং সিটি পুলিশের প্রধান স্টিভ উইলিয়ামস পৃথকভাবে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ধর্মীয় বিদ্বেষমূলকভাবে এ হামলা চালানো হয়েছে এবং এটি মুসলিমবিদ্বেষ থেকে সুপরিকল্পিত একটি হত্যাযজ্ঞ। রবিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে লন্ডন সিটির এ গাড়ি হামলার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ এবং হতাহতদের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে এক টুইট বার্তায় কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো লিখেছেন, ‘অন্টারিয়ো প্রদেশের লন্ডনের খবর শুনে আমি মর্মাহত। রবিবারের ঘৃণিত ঘটনায় যারা প্রিয়জনদের হারিয়েছেন, আমরা তাদের পাশে আছি। আমরা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শিশুটিরও পাশে আছি। তার জন্য আমার হৃদয় ভেঙে যাচ্ছে। সুস্থ হয়ে উঠলে তুমি আমাদের অন্তরে ঠাঁই পাবে।’ হামলার তীব্র নিন্দা ও নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে অন্টারিয়ো প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ডগ ফোর্ড টুইটারে লিখেছেন, ‘ঘৃণা ও ইসলামবিদ্বেষের কোনো স্থান অন্টারিয়োতে নেই।’ লন্ডন শহরের মেয়রও এ ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। নিহতরা হলেন সাইদ আফজাল (৪৬) এবং তার স্ত্রী মাদিহা সালমান (৪৪), আফজালের মা (৭৪) এবং আফজাল-মাদিহা দম্পতির মেয়ে ইয়ুমনাহ আফজাল (১৫)। এ দম্পতির একমাত্র ছেলে ফায়েজ আফজাল (৯) নিকটস্থ হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। ২০ বছর বয়সী হামলাকারীর নাম নাথানিয়েল ভেল্টম্যান। গ্রিন লাইটের অপেক্ষায় থাকা পরিবারটিকে চাপা দিয়েই ঘাতক দ্রুতবেগে তার পিকআপ ভ্যান চালিয়ে সটকে পড়তে চেয়েছিল। অকুস্থল থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার দূরে একটি শপিং মলের পার্কিং লট থেকে তাকে পুলিশ গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে। গ্রেফতারের সময় ভেল্টম্যান কোনো বাদানুবাদ করেননি। গাড়িটিও পুলিশের কবজায় রয়েছে। পুলিশ কমিশনার উইলিয়ামস সোমবার সন্ধ্যায় বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করছি যে সেটি ছিল পরিকল্পিত একটি হামলা। মুসলমান বলেই পরিবারটি এ ধরনের নিষ্ঠুর হামলার শিকার হয়েছে।’ তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের ডিটেকটিভ পোল ওয়েইট বলেছেন, পরিবারের সবাই রাস্তা অতিক্রমের জন্য হাইড পার্ক রোড এবং সাউথ ক্যারিজ রোডের ইন্টারসেকশনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সিগন্যালে গ্রিন লাইট জ্বলে ওঠার অপেক্ষায় থাকাবস্থায় উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে কালো রঙের পিকআপ তাদের ওপর হামলে পড়ে। চাপা দিয়েই সটকে পড়েছিল পিকআপটি। তবে কীভাবে পিকআপ ভ্যানের চালক ভেল্টম্যানকে শনাক্ত করা হয়েছে এবং কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বাণিজ্যিক কেন্দ্রের পার্কিং লট থেকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়েছে তা বিস্তারিতভাবে জানাননি তদন্ত কর্মকর্তারা। উল্লেখ্য, ২০১৭ সালে কানাডার কুইবেক সিটির একটি মসজিদে ঢুকে এক বন্দুকধারী নামাজরত ছয় মুসল্লিকে গুলি করে হত্যা করেছিল। সেই ধর্মবিদ্বেষী আক্রমণের পর এটি হচ্ছে একই ধরনের বিদ্বেষমূলক হামলার দ্বিতীয় ঘটনা। লন্ডনের মেয়র হোল্ডার বলেন, গ্রেফতার তরুণ এর আগে কোনো ধরনের অপরাধে কখনো গ্রেফতার হননি অথবা চিহ্নিত কোনো অপরাধ চক্রের সদস্য বলেও তদন্ত কর্মকর্তারা মনে করছেন না। অভিযুক্ত ঘাতককে বৃহস্পতিবার (আগামীকাল) পুনরায় আদালতে হাজির করার কথা। নিহতদের দাফন-কাফনের খরচ বহনের জন্য ওয়েবসাইটে তহবিল সংগ্রহের যে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, ভিকটিমদের মধ্যে ৪৬ বছর বয়সী লোকটি ছিলেন ফিজিওথেরাপিস্ট এবং ক্রিকেট খেলার ভক্ত। তার ৪৪ বছর বয়সী স্ত্রী ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী এবং অন্টারিয়োর ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটিতে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পিএইচডি করছিলেন। তরুণীটি সম্প্রতি নবম গ্রেডে গ্র্যাজুয়েশন করেছে। প্রবীণতম মহিলাটি ছিলেন গোটা পরিবারের অভিভাবক। এই পরিবারের ঘনিষ্ঠজন জাহিদ খান বলেন, দাদি, বাবা, মা এবং টিনেজ কন্যা, অর্থাৎ তিন প্রজন্মের সবাইকেই টার্গেট করা হয়েছিল নিঃশেষ করতে। ১৪ বছর আগে তারা পাকিস্তান থেকে নিরাপদ ও উন্নত জীবনের প্রত্যাশায় কানাডায় এসে বসতি গড়েছিলেন। লন্ডন মসজিদের নিয়মিত সদস্যও ছিলেন সবাই। উল্লেখ্য, এ সিটির মোট জনসংখ্যার ১০ ভাগই মুসলমান। জাহিদ খান পরিবারের হতভাগ্য সদস্যদের স্মৃতিচারণাকালে বলেন, ‘আমি পাকিস্তান থেকে কানাডায় আসার পরই এ পরিবারের সঙ্গে মিলিত হয়েছি। তাদের পরামর্শে লন্ডন সিটিতে বাড়ি কিনি।’ লন্ডন মসজিদের কর্মকর্তা নাওয়াজ তাহির বলেন, ‘ঘটনাটি গোটা মুসলিম কমিউনিটিতে আতঙ্কের বিস্তার ঘটিয়েছে। ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা যে এভাবে টার্গেটে পরিণত হয়েছেন, এ নৃশংসতার মধ্য দিয়ে তার প্রকাশ ঘটল। অথচ এ সমাজে আমরা পরস্পরের বন্ধু-সতীর্থ বলেই মনে করি। এমনি অবস্থায় একটি পরিবারকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার ঘটনায় সবাই হতভম্ব ও আতঙ্কগ্রস্ত।’ এ ধরনের বিদ্বেষী মনোভাবাপন্নদের বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন নাওয়াজ। ‘দ্য ন্যাশনাল কাউন্সিল অব কানাডিয়ান মুসলিম’-এর প্রেসিডেন্ট মোস্তফা ফারুক বলেন, ‘কানাডায় এটি সন্ত্রাসী হামলা। সন্ত্রাস হিসেবেই একে বিবেচনা করতে হবে এবং প্রশাসনকে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। হামলাকারীকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।’ তদন্ত কর্মকর্তারা বলেছেন, হামলাকারীর বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে। ধর্মীয় বিদ্বেষের প্রসঙ্গও রয়েছে মামলায়। কানাডার প্রধানমন্ত্রী টুইটে আরও উল্লেখ করেন, ‘লন্ডনসহ গোটা কানাডার মুসলিম সম্প্রদায়কে জানাতে চাই যে আমরা তোমাদের পাশে আছি। আমাদের সমাজে ইসলাম-বিদ্বেষের কোনো ঠাঁই নেই। এ ধরনের ঘৃণা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। একে অবশ্যই থামাতে হবে।’ ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নতুন নেতা জগমিৎ সিং অন্য টুইটে বলেন, ‘ইসলাম-বিদ্বেষের ঠাঁই নেই কানাডায়। আর এটি হচ্ছে সন্ত্রাস। তাই অভিযুক্তের সর্বোচ্চ শাস্তি হতে হবে।’

সর্বশেষ খবর