বৃহস্পতিবার, ১০ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

ছলেবলে নানা কায়দায় ফাঁসানো হয় জালে

জিন্নাতুন নূর

কেস স্টাডি-১ : রাজধানীর শনির আখড়া এলাকার বাসিন্দা শিল্পী আক্তার (ছদ্মনাম)। ভালোবেসে ঘর বাঁধেন যার সঙ্গে, সেই যুুবকই ভালো বেতনে চাকরি দেওয়ার কথা বলে শিল্পীকে তুলে দিয়েছিলেন পাচারকারী চক্রের হাতে। এরপর সীমান্ত পার করে মেয়েটিকে নেওয়া হয় ভারতের চেন্নাইয়ে। সেখানে ঘরে আটকে রেখে তার ওপর চলে নির্যাতন। তিন মাস এই বন্দীদশায় কাটিয়ে মাসখানেক আগে পালিয়ে দেশে ফেরেন শিল্পী। সম্প্রতি একটি অডিওতে এই ভুক্তভোগী নিজের নির্যাতনের কথা বর্ণনা করেন। সেখানে কীভাবে পাচারকারী চক্রের খপ্পরে পড়ে নির্যাতনের শিকার হন সে বর্ণনা দেন। শিল্পী জানান, সংসারে অর্থকষ্ট থাকায় তাকে তার স্বামী ভারতে ভালো বেতনে চাকরি দেওয়ার কথা বলে ফাঁদে ফেলে। এরপর তাকে একটি মেয়ের হাতে তুলে দেওয়া হয়। মেয়েটি তাকে সাতক্ষীরায় নিয়ে যায়। সেখান থেকে সীমান্ত পার হয়ে তারা কলকাতায় যান। একটি ঘরে রাখা হয় তাদের। এরপর তাকে ভারতের পরিচয়পত্র বানিয়ে দেওয়া হয়। পরে বিমানে করে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় চেন্নাইয়ে। সেখানে একটি ঘরে আটকে রাখা হয়। এরপর তার ওপর চলে অবর্ণনীয় নির্যাতন। এ সময় তিনি কান্নাকাটি করলে মারধর করে তাকে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে বলে জানানো হয়। পালানোর সুযোগ খুঁজতে থাকেন শিল্পী। অবশেষে এবার ঈদুল ফিতরের আগে সুযোগ মতো পালিয়ে দেশে চলে আসেন।

কেস স্টাডি-২ : বিয়ের এক মাস পর বেড়াতে যাওয়ার কথা বলে ভারতের বেঙ্গালুরুর একটি নারী পাচার চক্রের কাছে রহিমাকে (ছদ্মনাম) বিক্রি করে দেয় তার স্বামী। এরপর বেঙ্গালুরুর বিভিন্ন হোটেলে নিয়ে রহিমাকে দিয়ে অনৈতিক কাজ করতে বাধ্য করানো হয়। এ কাজে রাজি না হলেই তার ভাগ্যে জুটত নির্মম শারীরিক নির্যাতন। তাকে খাবার খেতে দেওয়া হতো না। জ্বলন্ত সিগারেটের ছ্যাঁকায় পোড়ানো হতো রহিমার শরীর। রহিমাকে তিন বছর ধরে এই অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করতে হয়। এরপর পরিচিত একটি পরিবারের সহায়তায় দেশে ফিরিয়ে আনা হয় রহিমাকে। ওই সময় রহিমা গর্ভবতী ছিলেন। পাচারের শিকার নারী ও বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, বাংলাদেশ থেকে নারী-শিশু পাচারের ক্ষেত্রে আরও কৌশলী হচ্ছে পাচারকারী চক্রের সদস্যরা। সন্দেহ এড়াতে তারা পাচারে নিত্যনতুন কৌশল অবলম্বন করছে। ফলে দেশ থেকে নারী ও কন্যাশিশু পাচারের ঘটনা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) তথ্যে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত পাচারের শিকার হন মোট ১২ জন নারী। পাচারকারীরা এখন বৈধ কাগজপত্র দেখিয়েও বাংলাদেশি নারী ও শিশুদের ভারতে পাচার করে দিচ্ছে। পাচারের সময় তারা ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষকে পাচারের শিকার শিশু ও নারীকে নিজের পরিবারের সদস্য বলে পরিচয় দিচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখে ধুলো দিতে পাচারকারীরা ভুক্তভোগী নারী ও কন্যাশিশুদের নিজের মেয়ে, বোন ও স্ত্রী বলে পরিচয় দিচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীকে পাচারকারী ব্যক্তি বিয়ে করছে এবং ভারতে বেড়ানোর কথা বলে বা চাকরির আশ্বাস দিয়ে সেখানে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দিচ্ছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ পুলিশের পক্ষ থেকে ভারতে পাচার হওয়া নারীদের সে দেশের ‘আধার কার্ড’ বা পরিচয়পত্র তৈরিতে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বেঙ্গালুরু পুলিশকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। বর্তমানে ভারত থেকে ফিরে আসা অনেকেই পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের ফেসবুক পেজে যোগাযোগ করছেন। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে পাচারের শিকার ভুক্তভোগীরা দেশে ফিরে আসার পরও নিরাপদে থাকতে পারছেন না। কারণ পাচারকারীরা পুনরায় পাচার করার উদ্দেশ্যে তাদের ওপর নজর রাখে। থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশন নিউজের প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, পাচারের শিকার ভুক্তভোগীদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার পরও পাচারকারীরা তাদের ওপর নজর রাখে। পাচারকারী যদি তখন বুঝতে পারে ভুক্তভোগী সেই নারী আর আয়-রোজগার করতে পারছে না এবং পরিবারও সেই নারীকে সহযোগিতা করছে না, তখন তারা আবারও তাকে পাচার করার ফন্দি আঁটে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে, ভারতীয় সীমান্তে বৈধ কাগজপত্র দেখিয়ে পাচারকারীরা নারী-শিশুদের পাচার করছে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র হিসেবে তারা বিয়ের মিথ্যা সার্টিফিকেট বা ভুয়া পাসপোর্ট তৈরি করছে। কিছু পাচারকারী ভুক্তভোগীকে বিয়ে করে পরে ভারতে নিয়ে বিক্রি করে দিচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, ভারতের মুম্বাই, হায়দরাবাদ ও কলকাতায় দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশি নারী ও কন্যাশিশুদের পাচার করা হচ্ছে। বাংলাদেশের পাচারকারী সিন্ডিকেট নানা প্রলোভন দেখিয়ে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকার বিনিময়ে নারী-শিশুদের তুলে দিচ্ছে ভারতীয় সিন্ডিকেটের কাছে। হাতবদলের পর কলকাতা, মুম্বাই ও হায়দরাবাদের পাচারকারীরা এই নারী-শিশুদের সেখানকার পতিতালয়ে তুলে দিচ্ছে। আবার চীনের কিছু নাগরিক বিয়েসহ মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে বাংলাদেশি নারীদের পাচার করছে। কন্যাশিশু পাচারের অন্যতম বড় কারণ হচ্ছে বাল্যবিয়ে। মূলত মানব পাচারের বাজারে অতিরিক্ত চাহিদা থাকায় বাংলাদেশি নারী ও কন্যাশিশুদের পাচারের শিকার হতে হচ্ছে বেশি। এ জন্য করোনাকালেও দেশ থেকে নারী পাচারের মতো অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। আর এতে পাচারের সঙ্গে জড়িত সংঘবদ্ধ অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে উঠছে। তারা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, ফুটপাথে থাকা কন্যাশিশুদের কেউ কেউ ছোটবেলা থেকে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। আর এ ধরনের শিশুদের সহজেই টার্গেট করে পাচারকারী চক্রের সদস্যরা। দুবাইয়ে বাংলাদেশি নারী পাচারের ঘটনা এখন ‘ওপেন সিক্রেট’। এ ছাড়া নেপালেও নারীদের পাচার করা হচ্ছে। দুবাই ও নেপালে মেয়েদের পাচার করা হচ্ছে ট্যুরিস্ট ভিসায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা যায়, নারী পাচারকারীদের একটি চক্র নৃত্যশিল্পীদেরও পাচারের জন্য টার্গেট করে। ছোটখাটো অনুষ্ঠানে পারফর্ম করা নৃত্যশিল্পীরাই এ চক্রের প্রধান টার্গেট। কয়েকজন নৃত্য সংগঠক ও শিল্পী ছাড়াও পাড়া-মহল্লার বিভিন্ন ক্লাব ও ড্যান্স গ্রুপের লোকজন এ চক্রে জড়িত। দুবাইয়ে নারী পাচারকারী চক্রের মূল হোতা আজম খানসহ পাঁচজনকে এ অপরাধে গ্রেফতারও করে সিআইডি। বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দুবাইয়ে পাচার দমন-সংক্রান্ত আইন তেমন শক্তিশালী নয়। এ অবস্থা বাংলাদেশ থেকে নারী পাচারের ঘটনা আরও উসকে দিচ্ছে। সেখানে হোটেলসহ বিভিন্ন স্থানে বাংলাদেশি নারীদের জোর করে অবৈধ কাজ করানো হচ্ছে। কিন্তু স্থানীয় পুলিশ তাদের উদ্ধার করছে না। আবার বাংলাদেশ দূতাবাসও ভুক্তভোগীদের সেভাবে সাহায্য করতে পারছে না। দুবাই ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশসহ ভারতে পাচার করা হচ্ছে বাংলাদেশি নারীদের। বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি পাচার করা হচ্ছে ১০ থেকে ১৫ বছর বয়সী কিশোরীদের। আর মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ১৬ থেকে ১৮ বছরের কিশোরীদের বয়স বাড়িয়ে ২২ থেকে ২৩ বছর দেখিয়ে পাচার করা হচ্ছে। জানা যায়, জনশক্তি রপ্তানি উন্œয়ন ব্যুরোয় কর্মরত কিছু অসাধু ব্যক্তি, বিভিন্ন রিক্রুটিং এজেন্ট ও কিছু ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীর স্বজনরা নারী পাচারের সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সালমা আলী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘নারী পাচার প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, মানবাধিকার সংস্থা সবাইকে মিলে কাজ করতে হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেল এ বিষয়ে কাজ করছে কিন্তু জেলা পর্যায়ে এ বিষয়ে যে সচেতনতা তৈরির কথা তা হচ্ছে না। আর পাচারের ক্ষেত্রে যারা ঝুঁকিপূর্ণ তারা ঝুঁঁকিতেই রয়ে গেছে। দেশের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষেরও এ বিষয়ে গাফিলতি আছে।’ তার মতে, পাচারের ক্ষেত্রে যারা ঝুঁকিতে আছে, তাদের বিকল্প উপার্জনের ব্যবস্থা করতে হবে। পাচারের মামলায় ভুক্তভোগীকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ও আইনি সহযোগিতা দিতে হবে। পাচার-সংক্রান্ত স্পর্শকাতর মামলাগুলোর দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। অভিবাসন বিশেষজ্ঞদের মতে, অভিবাসনের নামে নারী পাচার, ভারতে নারী পাচার ও রোহিঙ্গা নারী-শিশু পাচার- এ তিনটি ইস্যু নারী পাচারের ক্ষেত্রে এখন সবচেয়ে বড় সংকট হিসেবে দাঁড়িয়েছে। তাদের মতে, শ্রম অভিবাসনের নামে যা হচ্ছে এটিও এক ধরনের পাচার। আগে যেখানে ১০ থেকে ১৫টি রিক্রুটিং এজেন্সি নারীকর্মী পাঠাত, সেখানে এখন ৫০০ থেকে ৬০০ এজেন্সি শুধু সৌদিতেই নারীকর্মী পাঠাচ্ছে। তারা জানান, গৃহকর্মী হিসেবে নারীদের বিদেশে না পাঠিয়ে নার্স ও পোশাকশ্রমিকসহ অন্যান্য খাতে পাঠানো উচিত। এতে নারীরা নিরাপদে থাকবেন।

সর্বশেষ খবর