বৃহস্পতিবার, ১০ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

বৈঠক হয়, পাল্টায় না পরিস্থিতি

জয়শ্রী ভাদুড়ী

প্রতারণার ফাঁদ পেতে নারী পাচার চলছে বহু বছর ধরেই। এই চক্রকে ঠেকাতে আইন, কর্মপরিকল্পনা, নজরদারি বাড়ানো হলেও পরিস্থিতি পাল্টায়নি কিছুতেই। ধরন পাল্টে এখন অনলাইনে প্রতারণার জাল পাতছে প্রতারক চক্র। ওতপেতে থাকা এসব প্রতারকের ফাঁদে পা দিয়ে পাচারের শিকার হচ্ছে অসংখ্য নারী-শিশু।

গত কয়েক মাসে একটি চক্রের টিকটক ভিডিওর পাতা ফাঁদেই পড়েছে সহস্রাধিক নারী ও শিশু। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, টিকটক, লাইকি যে মাধ্যমেই পরিচয় হোক, একটা সময় তারা মিলিত হয় ফেসবুকের একটি গ্রুপে। তারপর বড় পরিসরে যোগাযোগ হয়। এরপর প্রেমের সম্পর্ক গড়ার পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের পার্লার, সুপারশপ, শপিং মল এবং বড় প্রতিষ্ঠানে চাকরির প্রলোভন দিয়ে পাচার করে দেওয়া হয় নারীদের। পাচারকারীদের এই চক্রটি মূলত ভারত, বাংলাদেশ ও দুবাইজুড়ে বিস্তৃত। তাদের নেটওয়ার্কও খুব শক্তিশালী। ভারতের বেঙ্গালুরুতে এক বাংলাদেশি তরুণীর ওপর নির্যাতনের ছবি ভাইরাল হওয়ার পর সংঘবদ্ধ নারী পাচার চক্রের সন্ধান পাওয়া গেছে। তবে এই অনুসন্ধান নতুন কিছু নয়। কোনো অঘটন ঘটার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর হয়ে ওঠে। কিছু অপরাধী ধরাও পড়ে। সময়ের ব্যবধানে আবার সবকিছু আগের মতো চলতে থাকে। নারী পাচার ঠেকাতে অসংখ্য গোলটেবিল বৈঠক, সভা হলেও পরিস্থিতি বদলায়নি। ২০২০ সালের মানব পাচার তথা টিআইপি বা বৈশ্বিক ট্রাফিকিং ইন পারসন (টিআইপি) সূচকে বাংলাদেশ এক ধাপ এগিয়েছিল। টায়ার মাইনাস টু থেকে টায়ার টুতে উন্নীত হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশই এই অগ্রগতির প্রশংসা করেছিল। এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে দুই লাখ নারী-পুরুষ ও শিশু পাচার হয়েছে। প্রতি বছর ২০ হাজার নারী ও শিশু ভারত, পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যে পাচার হয়ে যায়। আরেক হিসাবে দেখা যায়, ভারতে অথবা ভারত হয়ে অন্য দেশে ৫০ হাজার নারী পাচার হয়ে গেছেন। ২০২০ সালে মানব পাচারের যে ৩১২টি মামলার বিচার হয়, সেগুলোর ২৫৬টি ছিল নারী পাচার ও যৌন সহিংসতা-সংক্রান্ত। পাচার রোধে ২০১২ সালে বাংলাদেশে নতুন আইন হয়েছে। ২০১৫ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত জাতীয় কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু বন্ধ হয়নি নারী-শিশু পাচার, বরং ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বিচারে দীর্ঘসূত্রতার কারণে নারী ও শিশু পাচার বাড়ছে বলে মনে করছেন জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সালমা আলী। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অনলাইনের সহজলভ্যতার ফায়দা লুটছে পাচারকারী চক্র। সেদিক থেকে সরকারের নজরদারি নেই বললেই চলে। বিচার ঝুলে থাকছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা পাচারকারীর তথ্য দিতে পারে না। নানা জটিলতায় এই মামলাগুলো ধুঁকছে। অনলাইনের কারণে সংঘবদ্ধ অপরাধীরা আরও বেশি সক্রিয় হয়ে গেছে। বিশেষ করে করোনাকালে এই প্রবণতা বেড়েছে। অথচ দেশ যখন ডিজিটাইজেশনের পথে এগোচ্ছিল, আমরা তখন নীতিমালা ঠিক করতে বলেছিলাম। কিছু গাইডলাইনও দিয়েছি। দেশের সংশোধনাগারগুলো ঘুরে ঘুরে অনেক পরামর্শ দিয়েছিলাম। এগুলো বাস্তবায়িত হয় না। আইনের ফাঁকে বেরিয়ে অপরাধীরা আরও বড় অপকর্ম করে বেড়াচ্ছে। তিনি বলেন, ‘দেশের ভিতরে রেড লাইট এরিয়ায় নজরদারি বাড়াতে হবে। নারী পাচার ঠেকাতে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে সরকারকে। পাচার হয়ে যাওয়া নারীদের অনেক সময় ফিরিয়ে আনা গেলেও মূল হোতারা অধরা থেকে যাচ্ছে। মামলার সাক্ষীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করায় আসামিরা তাদের চিনে ফেলছে। তারা ঝুঁকিতে পড়ে যাচ্ছে। এসব বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। সীমান্ত এলাকায় পাচারের পকেটগুলো চিহ্নিত করতে হবে। তৃণমূলে নারী পাচার রোধে প্ল্যান অব অ্যাকশন থাকতে হবে।’ এ ব্যাপারে তেজগাঁও বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) হাফিজ আল ফারুক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘নারী পাচারকারীরা অনলাইন প্ল্যাটফরম ব্যবহার করছে। আগে দালালের মাধ্যমে নারী পাচার হলেও এখন অনলাইন টুলস ব্যবহার করতে দেখা যাচ্ছে। এরকম একটা বড় সংঘবদ্ধ চক্রকে আমরা ধরতে পেরেছি। টিকটক ভিডিও বানানোর ফাঁদ পেতে তারা নারীদের প্রলোভন দেখাত। এসব ভিডিও কত দর্শক দেখছে সে অনুযায়ী আয় হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘টিকটক হৃদয় এসব থেকে বেশ টাকা আয় করতেন। তার সঙ্গে টিকটক ভিডিও বানিয়ে অর্থ আয়ের আশায় নারীরা তার আয়োজনে টিকটক হ্যাংআউট, পুলপার্টিতে যোগ দিতেন। গাজীপুরে হৃদয়ের আয়োজনে পুলপার্টিতে হাতিরঝিল থেকে ১৩-১৪টি বাসে করে ছেলেমেয়েরা গেছে। এরপর কুষ্টিয়াতে হ্যাংআউটের কথা বলে মেয়েদের নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে সাতক্ষীরায় নিয়ে গিয়ে বর্ডার পার করা হয় ভালো ব্যাকগ্রাউন্ডে ভিডিও বানানোর কথা বলে। এই চক্রের বেশ কয়েকজন এর মধ্যেই গ্রেফতার হয়েছে। বাকিদের ধরার চেষ্ট চলছে।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর