শুক্রবার, ১১ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা
৫০ মডেল মসজিদ উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী

মুষ্টিমেয় লোকের কারণে কোনো ধর্মকেই অপরাধী করা যায় না

নিজস্ব প্রতিবেদক

মুষ্টিমেয় লোকের কারণে কোনো ধর্মকেই অপরাধী করা যায় না

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে মডেল মসজিদের উদ্বোধন করেন -বাংলাদেশ প্রতিদিন

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিশ্বের কোনো জায়গায় জঙ্গিবাদ হলেই যেন ইসলামিক জঙ্গি এ ধরনের একটা নাম দেওয়া হয়। কিন্তু মুষ্টিমেয় লোকের কারণে কোনো ধর্মকে অপরাধী করা যায় না। গতকাল সারা দেশে নির্মাণাধীন ৫৬০ মডেল মসজিদের মধ্যে কাজ সমাপ্ত হওয়া ৫০টির উদ্বোধন অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে ধর্ম মন্ত্রণালয় আয়োজিত এ সংক্রান্ত মূল অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি অংশগ্রহণ করেন। ধর্ম প্রতিমন্ত্রী মো. ফরিদুল হক খান অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. নুরুল ইসলাম স্বাগত বক্তৃতা করেন। গণভবন থেকে মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়া, প্রেসসচিব ইহসানুল করিমসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে ‘বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের ইসলাম প্রচারের পথিকৃৎ’ শীর্ষক একটি ভিডিও চিত্র প্রদর্শিত হয়। উদ্বোধন শেষে প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠান থেকে খুলনা জেলা মডেল মসজিদ, রংপুর জেলার বদরগঞ্জ উপজেলা মডেল মসজিদ এবং সিলেট জেলার দক্ষিণ সুরমা উপজেলা মডেল মসজিদের ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। সারা দেশে প্রতিটি জেলা-উপজেলায় অপূর্ব স্থাপস্থ্যশিল্প ও দৃষ্টিনন্দন ৫৬০টি মডেল মসজিদ ও ইসলামী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে একসঙ্গে ৫০টি মডেল মসজিদ উদ্বোধনের মাধ্যমে সারা বিশ্বে এক অনন্য নজির সৃষ্টি করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এটাই হচ্ছে বিশ্বে প্রথম কোনো সরকারের একই সময়ে একসঙ্গে এত বিপুল সংখ্যক মসজিদ নির্মাণের ঘটনা। এসব মডেল মসজিদ নির্মাণ করতে সরকারের ব্যয় হচ্ছে ৮ হাজার ৭২২ কোটি টাকা। স্বপ্নের পদ্মা বহুমুখী সেতুর পর নিজস্ব অর্থায়নে এটা সরকারের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রকল্প। আগামী দুই বছরের মধ্যে ৫৬০টি মডেল মসজিদ নির্মাণ কাজ শেষ হবে। নান্দনিক নির্মাণশৈলীতে নির্মিত এসব মডেল মসজিদে রয়েছে একটি করে দৃষ্টিনন্দন মিনার। মূল মসজিদটি হবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমি বিশ্বের যেখানেই গেছি, এ বিষয়ে কথা উঠলে বলেছি, মুষ্টিমেয় লোক সন্ত্রাস ও জঙ্গি কর্মকান্ড করে ইসলামকে দোষারোপ করে। এই গুটিকয়েক লেবাসধারীর কর্মকান্ডের ওপর ভিত্তি করে ধর্মকে দোষারোপ করা যায় না। তিনি বলেন, জ্ঞান বিজ্ঞান, শিল্প-সংস্কৃতির সবকিছুতে মুসলিমরা ছিল পথপ্রদর্শক। তারা কেন আজ পিছিয়ে থাকবে? মুসলিমদের মধ্যে সঠিক ইসলামের জ্ঞান অর্জনে সহায়তা ও তাদের ইতিহাস ঐতিহ্য সচেতন করতে এই মডেল মসজিদ ও ইসলামিক কালচারাল সেন্টার। এখানে তারা মূল কথাটা জানতে ও শিখতে পারবে। তিনি বলেন, আমরা সারা দেশে ৫৬০টি মডেল মসজিদ নির্মাণ করছি। এরমধ্যে ৫০টি আজ উদ্বোধন করছি। এই মসজিদ থেকে মানুষ যেন ইসলামের মূল কথাটা শিখতে পারে, জানতে পারে। জ্ঞান-বিজ্ঞান, সভ্যতাসহ সবকিছুতে মুসলমানরা অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। তারা পথপ্রদর্শক ছিল।

শেখ হাসিনা বলেন, আমরা চাই, যেন ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে সবাই সচেতন হয়। ইসলাম ধর্ম নারীদের অধিকার দিয়েছে। পিতার ও স্বামীর সম্পদে নারীর অধিকার দিয়েছে। এই মসজিদেও নারী-পুরুষের নামাজের ব্যবস্থা আছে। এর মাধ্যমে ধর্মীয় দৃষ্টিতে বাল্যবিয়ে, নারী-শিশুদের নির্যাতন ও মাদকের বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করতে হবে। এগুলো রোধে সামাজিকভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ধর্মের নামে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ প্রতিহত এবং এই সর্বনাশা পথে যেন দেশের যুবসমাজ জড়িয়ে না পড়ে সেজন্য দেশের আলেম-ওলামা, ধর্মপ্রাণ মুসলমান ও অভিভাবকদের এগিয়ে আসতে হবে। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ তৈরি করে, মানুষ খুন করে, বোমা মেরে, খুনখারাপি করে আমাদের পবিত্র ধর্মের নামে বদনাম সৃষ্টি করছে। যেটা আমাদের ধর্মের পবিত্রতাকেই কেবল নষ্ট করছে না, এর ইমেজও নষ্ট হচ্ছে সারা বিশ্বে। জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে যারা জড়িত, এই পথ সর্বনাশা পথ। এই পথ থেকে আমাদের যুবসমাজ যেন দূরে থাকে, আমাদের সবাইকে সেই প্রচেষ্টা চালাতে হবে। 

মডেল মসজিদ উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমাজের সর্বস্তরের জনগণকে নিয়ে তাঁর সরকার সন্ত্রাস-মাদক ও জঙ্গিবাদবিরোধী সামাজিক আন্দোলনের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে নিয়ে কমিটি করে সন্ত্রাস এবং জঙ্গিবাদের পাশাপাশি মাদক, নারী ও শিশু নির্যাতন এবং পাশবিকতার বিরুদ্ধেও এই সমাজে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। এই মসজিদগুলোও আমরা সেভাবেই তৈরি করতে চেয়েছি, যেখানে ইসলাম সম্পর্কে সব ধরনের প্রচার ও প্রসার এবং এই ধর্ম সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান যেন আরও বৃদ্ধি পায়। তিনি বলেন, আমরা দেখেছি এই ধর্মের নাম নিয়ে কীভাবে জঙ্গিবাদ সৃষ্টি করা হয়েছে। কিছু লোক, শুধু আমাদের দেশে না, সারা বিশ্বেই দেখেছি ধর্মের নামে মানুষ খুন করা! মানুষকে খুন করলেই নাকি বেহেস্তে চলে যাবে। এখানে আমার প্রশ্ন, যারা এতদিন মানুষ খুন করেছেন, তারা কে কে বেহেস্তে গেছেন, সেটা কি কেউ বলতে পারবে? বলতে পারবে না। লেবাসধারী মুসলমানদের প্রসঙ্গে অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি বক্তব্যের উদ্ধৃত করে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- আমরা লেবাসসর্বস্ব ইসলামে বিশ্বাসী নই, আমরা বিশ্বাসী ইনসাফের ইসলামে।’ তিনি বলেন, মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের কর্মকান্ডে সবচেয়ে সর্বনাশ করে গেছে পবিত্র ইসলাম ধর্মের, যে ধর্ম শান্তির ধর্ম। যে ধর্ম মানুষকে অধিকার দিয়ে গেছে। আমি তো মনে করি, সারা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ধর্ম হলো ইসলাম ধর্ম। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, কিছু লোক জঙ্গিবাদ তৈরি করে, মানুষ হত্যা করে, খুনখারাপি করে আমাদের এই পবিত্র ধর্মের নামে বদনাম সৃষ্টি করছে। এই মডেল মসজিদগুলো নির্মাণ করা তাঁর দলের অনেক পুরনো সিদ্ধান্ত এবং এটি তাঁর নির্বাচনী ইশতেহারেও ছিল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই মসজিদগুলোর মাধ্যমে আমাদের ইসলামের সংস্কৃতি, ধর্মীয় শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, দ্বীনি দাওয়াতি কার্যক্রম- এগুলোর যাতে সঠিকভাবে পরিচালনা এবং প্রচার ও প্রসার ঘটানো যায় এবং সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ এগুলো থেকে যাতে মানুষ দূরে থাকে এবং আমাদের ধর্মের যে মূল বাণী তা যেন মানুষ শিখতে পারে, জানতে এবং চর্চা করতে পারে। সরকার প্রধান বলেন, ইসলামের প্রচার, প্রসারের জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কাজ করে গেছেন। ইসলামের প্রচারের জন্য জাতির পিতা ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমার জন্য বিপুল পরিমাণ জমি বরাদ্দ এবং কাকরাইলে একটি মসজিদ নির্মাণ করে দিয়েছেন। ’৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে আমরা বায়তুল মোকাররম মসজিদের দৃষ্টিনন্দন মিনারসহ ব্যাপক সংস্কার কাজ করেছি। তিনি বলেন, ইসলামের মূল প্রতিপাদ্য মানুষ যেন জানতে পারে, ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান বৃদ্ধি, ইসলাম প্রচার যেন হয় সেই চেষ্টাই আমরা করছি। ভোট দিয়ে তাঁর সরকারকে দেশ সেবার সুযোগ প্রদানের জন্য দেশবাসীকে পুনর্বার ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশবাসী আমাদের সমর্থন ও ভোট দিয়ে তাঁদের সেবা করার সুযোগ করে দিয়েছে বলেই সপরিবারে জাতির পিতা হত্যার মতো ঘৃণ্য হত্যাকান্ডের বিচার করতে পেরেছি। বাংলাদেশ আজ সব দিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। সারা বিশ্বে এ দেশের মানুষ মর্যাদার সঙ্গে মাথা উঁচু করে চলবে। পরে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে খুলনা, সিলেট ও রংপুরের বদরগঞ্জে নির্মিত মডেল মসজিদ এলাকার মুসল্লিদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মসজিদ করা হলো, সবাই এর যত্ন নেবেন। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন যেন থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখবেন এবং যত্ন নিয়ে ব্যবহার করবেন যেন এটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে। সত্যিকার ইসলাম ধর্মের মর্মবাণী যেন এদেশের মানুষ বুঝতে পারে, জানতে ও শিখতে পারে। শুধু আমাদের দেশে নয়, আমরা যে ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করি, সব ধর্মের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি, আমরা স্ব স্ব ধর্ম যত্ন সহকারে লালন-পালন করি এবং অনুসরণ করি- সেগুলো আন্তর্জাতিকভাবে তুলে ধরতে হবে। কারণ ইসলাম আমাদের সেই মানবতার শিক্ষাই দিয়েছে। এ সময় বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব যেন করোনাভাইরাস থেকে মুক্তি পায় সেজন্য সবাইকে দোয়া করার আহ্বানও জানান প্রধানমন্ত্রী।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর