শুক্রবার, ১১ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

এলপি গ্যাস ইন্ডাস্ট্রি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে

৩২ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা ধ্বংসের পথে, ব্যাংকের বিশাল বিনিয়োগ ও দেশের অর্থনীতি হুমকির মুখে, ১০ লাখ মানুষের জীবিকা অনিশ্চিত

নিজস্ব প্রতিবেদক

আন্তর্জাতিক বাজারে যখন এলপি গ্যাসের দাম ঊর্ধ্বমুখী, তখন বাংলাদেশের বাজারে নতুন করে দাম কমানোর ঘোষণা দিয়েছে বিইআরসি। আন্তর্জাতিক বাজার পরিলক্ষণ করলে দেখা যায়, গত মে মাসে প্রতি টন প্রোপেনের দাম ছিল ৪৯৫ ডলার আর বিউটেনের ৪৭৫ ডলার। চলতি জুনে যা বেড়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে প্রতি টন ৫৩০ ডলার ও ৫২৫ ডলার। গত মে মাসে বিইআরসি কর্তৃক প্রতি ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম নির্ধারণ করা হয় ৯২০ টাকা, সেখানে কি না জুনে দাম বেড়ে যাওয়ার পরও তা কমিয়ে নিয়ে আসা হয় ৮৪২ টাকায়। আন্তর্জাতিক বাজারে যখন এলপি গ্যাসের দাম টনপ্রতি প্রায় ৪৫ ডলার বৃদ্ধি পেল, তখন বিইআরসি ১২ কেজি সিলিন্ডারে ৭৮ টাকা দাম কমিয়ে যেন এক ছেলেখেলা শুরু করেছে। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ার পরও সিলিন্ডারপ্রতি দাম কমে যাওয়া যেন এলপি গ্যাস ব্যবসায়ীদের জন্য এক অশনি বার্তাই বহন করছে।

২০১৩ সালে বাংলাদেশে এলপিজির চাহিদা ছিল মাত্র ৮০ হাজার মেট্রিক টন কিন্তু বর্তমানে তা ১২ লাখ মেট্রিক টন ছাড়িয়েছে। ধারণা করা হয়, ২০২৫ সালের মধ্যে ২৫ লাখ মেট্রিক টন এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টনে পৌঁছে যাবে। এখন পর্যন্ত এ খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকা এবং এর সঙ্গে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে জড়িত আছেন প্রায় ১০ লাখ মানুষ। এ বিশাল বিনিয়োগের অধিকাংশই এসেছে ব্যাংক ঋণ থেকে। বিইআরসির সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনায় ও গণশুনানিতে বাংলাদেশের সব অপারেটর তাদের সকল প্রকার খরচ ও অন্যসব ব্যয় তুলে ধরেন। সেই সঙ্গে দাম নির্ধারণে সকল প্রকার বাধা তুলে ধরেন, যাতে বিইআরসি কর্তৃক দাম নির্ধারণে ভোক্তা ও অপারেটর কারও অধিকার ক্ষুণœ না হয়। গত এপ্রিলে প্রথমবারের মতো সিলিন্ডার ও অটোমোবাইলের জ্বালানিতে ব্যবহৃত অটো গ্যাসের দাম নির্ধারণ করে বিইআরসি। কিন্তু সে দাম নির্ধারণে ৩২ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগকে বাঁচিয়ে রেখে ১০ লাখ লোকের কর্মসংস্থানের কথা বিবেচনা না করেই বিইআরসির মনগড়া দাম নির্ধারণ যেন দেশের সুন্দর ও সমৃদ্ধ ব্যবসায়িক খাত তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাসে (এলপিজি) বিনিয়োগকৃত ৩২ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগকে বিপদে ফেলা এবং এ খাতের প্রবৃদ্ধিকে বাধা দেওয়ার এক বহুমুখী ষড়যন্ত্র হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে। বাংলাদেশ বিশ্বের অন্য যে কোনো উন্নয়নশীল দেশের মতো জ্বালানি অপর্যাপ্ততার মুখোমুখি। বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যে মোট জনসংখ্যার ৬% পরিবারের ব্যবহারের জন্য প্রাকৃতিক গ্যাসের (পাইপলাইন) সংযোগের মাধ্যমে সংযুক্ত করেছে, যা বাংলাদেশের মোট এনার্জি ব্যবহারের প্রায় ১২%। দামে কম এবং সহজলভ্যতার কারণে এলপিজি ধীরে ধীরে প্রাকৃতিক গ্যাসের স্থানটি দখল করে নেয় এবং গৃহস্থালির পাশাপাশি বাণিজ্যিক ও শিল্প খাতেও এটি বিকল্প জ্বালানি হিসেবে ধীরে ধীরে নিজের জায়গা করে নিচ্ছে। সেই সঙ্গে প্রাকৃতিক গ্যাসের রিজার্ভ হ্রাসের কারণে স্থানীয় শিল্পগুলো নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের জন্য ধীরে ধীরে এলপিজির দিকে ঝুঁকছে। এলপিজি সম্পূর্ণ আমদানিভিত্তিক পণ্য যার প্রায় ৯৮% আমদানিকৃত এবং বেশির ভাগ টার্মিনাল মোংলা ও চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

বলা বাহুল্য, কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) দাখিলকৃত রিটের অধীনে হাই কোর্ট গত বছরে বিইআরসিকে এলপি গ্যাসের দাম নির্ধারণের দায়িত্ব আরোপ করে এবং তারই ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো এলপি গ্যাসের দাম নির্ধারণ গণশুনানির আয়োজন করা হয়। আলোচনায় বলা হয়, সৌদি আরামকোর মাসিক ঘোষিত দামের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই প্রতি মাসে এলপি গ্যাসের দাম নির্ধারণ করা হবে এবং ব্যবসায়ী ও দাম নির্ধারণে ভোক্তা ও অপারেটর উভয়েই যাতে লাভবান হয় সেসব দিক মূল্যায়ন করা হবে। কিন্তু এ যেন এক ছেলেখেলা ছাড়া আর কিছুই নয়।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর